ইসরাইল ও পশ্চিমারাই এর জন্য দায়ী

বেলেন ফার্নান্দেজ
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরাইলি হামলার জবাবে ১৩ এপ্রিল ইসরাইলে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে তেহরান। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই বাধা দিতে সক্ষম হয়।
এ ছাড়া সবসময় পাশে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ইসরাইলের ক্ষয়ক্ষতিও হয় সামান্যই। এদিকে ইরানের ওপর হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার পর বিষয়টিকে ‘সমাপ্ত বলে মনে করা যেতে পারে’ বলে ঘোষণা দেয় তেহরান। যদিও ইসরাইল অন্য কাউকে সাধারণত শেষ কথা বলতে দেয় না।
এদিকে পশ্চিমে তেহরানের এমন ‘আগ্রাসন’ নিয়ে সমালোচনার ঝড় অব্যাহত আছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের এমন বেপরোয়া হামলার কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে আবারও দেখিয়েছেন, ইরান আসলে নিজের উঠোনেই বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করে। অন্যদিক চেক প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছে, ইরানের দীর্ঘমেয়াদি এমন আগ্রাসী আচরণ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপদে বসবাসে বাধা দিচ্ছে।
অন্যদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কে সেই পুরোনো স্লোগানের পাশাপাশি ইরানের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি অবজ্ঞা বলে অভিহিত করেছেন। আর ইসরাইলে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত স্টিফেন সিবার্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসরাইলের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আজ রাতে সব ইসরাইলির ওপর ইরান সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে নজিরবিহীন নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে।
সবশেষে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যিনি এ ঘটনার কারণে সপ্তাহান্তে তার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি ঘোষণা করেছেন : ইসরাইলের নিরাপত্তার বিষয়ে ইরান ও তার মিত্রদের হুমকির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশ্রুতি লোহার মতো শক্ত।
মনে রাখা দরকার, ইসরাইলের ওপর ইরানের এ হামলা গাজা উপত্যকায় ইহুদি হত্যাযজ্ঞ চালানোর ছয় মাসের কিছু বেশি সময় পরে ঘটেছে। ইতোমধ্যে ইসরাইলিরা ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে শিশুই রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৮০০। শুধু তাই নয়, আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এখনো নিখোঁজ রয়েছে, যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হতাহতের এ সংখ্যা ভয়ংকর হলেও নিঃসন্দেহে তা ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
গাজায় ইসরাইলি হামলায় ৭৬ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। পুরো উপত্যকাটিকে ইসরাইলি বাহিনী মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়। সে অঞ্চলের মানুষের দুর্ভিক্ষ ও অনাহারে পতিত হওয়ার পেছনে ইসরাইলি বাহিনী দায়ী হলেও সেখানকার স্কুল, হাসপাতাল থেকে শুরু করে মৌলিক সব ধরনের অবকাঠামো ধ্বংসে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এবার সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গ। প্রকৃতপক্ষে চেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হচ্ছে, এ গণহত্যা কিছুই নয়, যদি না তা দীর্ঘমেয়াদি আক্রমণাত্মক আচরণ হয়। যদি পুরো বিষয়টি অত্যন্ত নজিরবিহীন জঘন্য না হতো, তাহলে এটা দাবি করা প্রায় হাস্যকর হবে যে, এ অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে উপেক্ষা করে বিশৃঙ্খলা বপনের অভিপ্রায়ে ইরান এমন হামলা চালিয়েছে।
কিন্তু অপরাধের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হিসাবে ইসরাইলের বড় ধরনের ভূমিকা এ ধরনের যুক্তিকে দুর্বল করে দেয় এবং ‘আত্মরক্ষা’র নামে ইসরাইলের নিরবচ্ছিন্ন আগ্রাসনে নিরীহ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ১ এপ্রিল চালানো ইসরাইলের হামলা ছিল শুধুই পূর্ব অনুমাননির্ভর প্রতিশোধ, তাই নয় কি?
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আটকে দেওয়ার বিষয়ে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া খুবই রূঢ় প্রকৃতির। ঋষি সুনাক যেভাবে ‘কেউ আর রক্তপাত দেখতে চায় না’ বলে দাবি করেছেন, সেটা এই বাস্তবতাকে হিসাবে নিতে ব্যর্থ হয়েছে যে, যতক্ষণ না এটি ফিলিস্তিনিদের রক্তকে বোঝাচ্ছে, ততক্ষণ সব ঠিক আছে।
দুর্ভাগ্যবশত, ইরানের ঘটনাটি গাজা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য বাইডেন প্রশাসনকে সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে এ গণহত্যায় মার্কিন দায়ের বিষয়ে। সর্বোপরি, এটি অস্ত্রশিল্পের জন্য একটি দুঃখজনক ব্যাপার হবে, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি সক্রিয় ক্রেতার কাছে এতগুলো অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে হয়। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যখন সর্বাত্মক গণহত্যা শুরু হয়েছিল, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অস্ত্র আমদানির ৬৯ শতাংশই এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
তবে মার্কিন নীতিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য পুরোনো ইরানি হুমকির ব্যাপারটি সামনে আনার বিষয়টিও উপেক্ষা করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়ে ‘অশুভের অক্ষ’ (এক্সিস অফ এভিল) তথা শত্রুদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তেহরানের অন্তর্ভুক্তির কথা স্মরণ করা যায়।
২০০২ সালে স্টেট অফ দি ইউনিয়ন ভাষণে যিনি ইরানকে ‘আক্রমণাত্মকভাবে’ গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং ‘সন্ত্রাস রপ্তানি’ করার জন্য নিন্দা করেছিলেন। সেসময় ‘অক্ষ’ নাম দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরেও ব্যাপক ধ্বংস ও সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই করেনি।
দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া ২২ বছর থেকে বর্তমান ধ্বংসাত্মক যুগেও সেই ইরানি আতঙ্ক আগের মতোই রয়েছে। সাম্প্রতিক হামলার পর সম্ভবত অনেকে যে কথাটি বলা থেকে বিরত থাকবেন তা হলো, ‘কিন্তু আপনি কি হামাসের নিন্দা করেন?’ এখন বলা হতে পারে, ‘কিন্তু আপনি কি ইরানের নিন্দা করেন?’
প্রকৃতপক্ষে নিন্দার যোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে গাজার গণহত্যাও উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমারা নির্লজ্জভাবে যে ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারে’র ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তা দেওয়া উচিত গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার ওপর। এবং ইরানের এই ‘অভূতপূর্ব আক্রমণের’ পর পশ্চিমা নেতারা যখন ইসরাইলের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ক্রমাগত বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, তখন আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, আপনি যা বপন করবেন, তা আপনাকেই কাটতে হবে-কাজেই ইরান এক্ষেত্রে আগ্রাসী নয়।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস
বেলেন ফার্নান্দেজ : লেখক ও আলজাজিরার কলামিস্ট