সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সোপান হতে পারে ঈদ
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বছর ঘুরে ঈদ কড়া নাড়ছে দরজায়। এবার সাধারণ, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ খুব স্বস্তিতে নেই। যেখানে ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে সংসার নির্বাহ কঠিন সেখানে ঈদের বাড়তি আয়োজন কীভাবে করবে। তবুও এদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে জানে। নদীভাঙন আর টর্নেডো-সিডরে সব হারিয়েও আবার বাঁচার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে। এ কারণে আমরা জানি ঈদের আনন্দও তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না। যার যার সামর্থ্য নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ঈদ প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। যুগ যুগ এদেশে ঈদুল ফিতর উদযাপন বিশেষ মাত্রা পায়। মুসলমানের ধর্মীয় উৎসব হলেও অমুসলিম প্রতিবেশী বন্ধুও এ আনন্দ-বিচ্ছিন্ন হয় না। এদেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘকালীন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ঈদ আবার নতুন করে ঝালিয়ে দেয়।
গত বছর দুজন হিন্দু বন্ধু পূজার সময় এসএমএস করে আমাকে ‘শুভ বিজয়া’ জানিয়েছিলেন। ঈদের দিন আমি আমার অনেক হিন্দু বন্ধুকেও ‘ঈদ মুবারক’ জানিয়েছি। ওরাও ‘ঈদ মুবারক’ জানিয়ে এসএমএস করেছে। এ ঘটনা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে একটু অন্যরকম লেগেছিল যখন আমার এক মুসলমান ছাত্রী পূজার সময় এসএমএস করে আমাকে ‘শুভ বিজয়া’ জানায়। এর মধ্য দিয়ে একটি শুভ ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ঈদ, পূজা, খ্রিষ্টানদের বড়দিন বা বৌদ্ধদের বৌদ্ধ পূর্ণিমা-যে কোনো পার্বণ উপলক্ষ্যে আমরা যদি ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে পরস্পরের জন্য শুভ কামনা করতে পারি, তাহলে তো জয় হবে মানবতারই।
সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের আনন্দ যার যার সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা থেকেই হয়ে থাকে। দুর্গাপূজায় হিন্দুরা যূথবদ্ধভাবে আনন্দ করে, মণ্ডপে মণ্ডপে দলবেঁধে সবাই যায়, একসঙ্গে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। মুসলমানদের ঈদ-আনন্দের ধরনটা আলাদা। মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে কোনো প্রতীকী স্থাপনা নেই। ফলে পার্থিব ও অপার্থিব আনন্দ ছড়িয়ে থাকে। তবুও অধুনা ঈদ আনন্দে অনেক রূপান্তর ঘটেছে। বিশেষ করে নাগরিক জীবনে। উনিশ শতকের ঢাকার ঈদ উৎসব এখনো টিকে থাকলে পূজার উৎসবের পাশাপাশি তুলনামূলক বিচার করা যেত। সে যুগে অনেক আনন্দঘন ঈদ উৎসব পালন করত ঢাকাবাসী। ঈদের দিন জমকালো আনন্দ মিছিল বের হতো। অবশ্য কয়েক বছর ধরে ঢাকায় ঈদ আনন্দ মিছিল হচ্ছে। উনিশ শতকে আর্মানিটোলা, ধূপখোলা বা রমনার মাঠে ঈদ উৎসবের অংশ হিসাবে কত্থক নাচের আয়োজন হতো। কোথাও হতো হিজড়া নাচ। ঘুড়ি ওড়ানো আর নৌকাবাইচের আয়োজন হতো। আর এসব অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্র্রদায়ের মানুষও আনন্দ ভাগ করে নিত।
আমাদের ছেলেবেলার কথা স্মরণে আনতে পারি। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অনেক হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত চলে গেছেন। এসব বাড়িতে আমার বোনদের বান্ধবী অনেক দিদি ছিলেন। আদর-স্নেহ পেয়ে তাদের দূর সম্পর্কের মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ছোটরা যেমন কর গুনে ঈদের অপেক্ষা করতাম, একইভাবে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা আর সরস্বতী পূজার জন্যও দিন গুনতাম। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখা, ঢাকির জাদুকরি হাতে মন মাতানো ঢাকের বাদ্যে মাতোয়ারা হওয়া আর প্রসাদ খাওয়ার লোভ তো ছিলই।
শুধু ঈদ নয়, মহররমের মিছিলেও ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ ছিল। ইরাক-ইরানসহ অনেক আরব দেশে শিয়া-সুন্নির মধ্যকার দ্বন্দ্ব হানাহানির পর্যায়ে চলে যায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আঠারো শতক থেকে ঢাকায় মহররম পালিত হচ্ছে। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে সুন্নি মুসলমানের অংশগ্রহণ এদেশে স্বাভাবিকই ছিল। আঠারো-উনিশ শতকের নথিতে দেখা যায় একটি সাংস্কৃতিক প্রণোদনা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে শরিক হতো মহররমের মিছিলে। বিশ্বাস ছিল, কারবালার স্মৃতিতে দুলদুলের প্রতীক ঘোড়ার পায়ে দুধ ঢেলে মনোবাঞ্ছা করলে তা পূরণ হয়। অনেক হিন্দুও ইচ্ছা পূরণের আশায় দুলদুলের পায়ে দুধ ঢালত।
মুসলমান পিরের সমাধিতে হিন্দুর যাওয়া, প্রার্থনা করা এদেশে একটি সাধারণ চিত্র। গ্রাম-গঞ্জের নানা জায়গায় এখনো ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার নদীতে কলার ভেলায় রঙিন কাগজের ঘর বানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো হয়। এই ‘ভেলা ভাসানো’ উৎসবে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সুন্দরবনের সঙ্গে জীবিকা জড়িয়ে আছে এমন মুসলমান বাওয়ালি, কাঠুরে বা জেলেরা বনের রক্ষাকর্ত্রী কল্পনায় বনবিবি আর ব্যাঘ্র পির গাজীর নাম জপ করে। অন্যদিকে হিন্দু বাওয়ালি, কাঠুরে ও জেলে একই অধিকর্ত্রী দেবী হিসাবে বনদুর্গা আর ব্যাঘ্র দেবতা হিসাবে নাম জপ করে দক্ষিণ রায়ের।
এসব বাস্তবতা এদেশের দীর্ঘকাল ধরে লালিত সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই প্রকাশ করছে। সমাজ ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে আমি আমার লেখায় বহুবার বলার চেষ্টা করেছি যে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে এদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অপচ্ছায়া খুব স্বচ্ছন্দে ডানা মেলতে পারবে না। এদেশের সাধারণ মানুষের মানসিক গড়ন সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধিকে সমর্থন করে না। তারপরও এ সত্য মানতে হবে যে, অন্ধকারের জীব, যারা ধর্মকে আধ্যাত্মিকতার গাম্ভীর্য আর সৌন্দর্যে না দেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়, তারা কিন্তু সাম্প্র্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করে। অন্য দল অতটা বুঝে নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও কূপমণ্ডূকতার কারণে ধার্মিক না হয়ে এক ধরনের ধর্মান্ধ হয়ে যায়। ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন না করে অনালোকিত এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ধর্মনেতার বয়ান শুনে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। প্রথম শ্রেণির ধর্ম-বণিকদের চেনা যায়, ফলে এদের প্রতিহত করাও সম্ভব। কিন্তু অতি ধীরে হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষদের পক্ষে সমাজ কলুষিত করার ক্ষমতা বেশি বলে আমি মনে করি। প্রথমে তারা নিজ পরিবারকে প্রভাবিত করে, পরে প্রতিবেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
তবে আমরা মনে করি, ঈদের মতো ধর্মীয় উৎসবে আমরা যদি আবহমানকালের বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রজ্বলিত রাখার সচেতন প্রয়াস অব্যাহত রাখতে পারি, তাহলে সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার ছড়ানো অপশক্তি অবদমিত হবে। প্রতিবেশী অমুসলিম সম্প্রদায়ের বন্ধুদের ঈদের আনন্দের ভাগ দিতে পারি অনায়াসেই। পারস্পরিক সংস্পর্শের শক্তিতে সাম্প্রদায়িক নৈকট্য অনেক বৃদ্ধি পায়। ঈদ সেই সুযোগ করে দিতে পারে সহজেই।
আমার এক বিত্তশালী বন্ধু বেশ কয়েক লাখ টাকার জাকাত দেন। তিনি তার গ্রামের বাড়ির দরিদ্রদের তালিকা করে নীরবে তার দানসামগ্রী পৌঁছে দেন তাদের হাতে। এতে ধর্ম সম্প্রদায়ের বাছ-বিচার করেন না। অনেক হিন্দু পরিবারও তার জাকাতের ভাগ পান। একবার তার সম্পর্কের এক মাদ্রাসা-শিক্ষক চাচা বললেন, জাকাতের এ টাকা দরিদ্র মুসলমানেরই পাওয়া উচিত। আমার বন্ধুর প্রত্যুত্তরটি ভালো লেগেছিল। তিনি বললেন, দেখুন চাচা, আমি বিবেক দিয়ে চলতে পছন্দ করি। ধর্ম পরিচয়ে নয়-আমি মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখে থাকি। ছোটবেলায় বইতে পড়া সেই গল্পটি এখনো মনে গেঁথে আছে। সেই যে বুড়ি মহানবির (সা.) পথে কাঁটা ছড়িয়ে কষ্ট দিত-অথচ তার অসুখে ছুটে গিয়েছিলেন নবি। অসুস্থ অমুসলিম বুড়িকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। আমি এভাবেই ইসলামের মাহাত্ম্যকে দেখতে চাই। ধর্মীয় সংকীর্ণতা নয়, ইসলাম মানবতার জয়গানই করেছে। সুতরাং আপনারা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন, আমি ধর্মের নামে আলাদা করব না। মানুষ হিসাবেই দেখতে চাইব সবাইকে।
ঈদ আসন্ন। আমরা মনে করি, ঈদ শুধু মুসলমানের ধর্মীয় উৎসবই নয়। ঈদ-আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের শক্তি। একে ধারণ করে ঈদ উৎসবকে অর্থবহ করে তুলতে পারলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তার আপন সৌন্দর্যকে সমুন্নত রাখতে পারবে। ঈদ কিন্তু বড় অর্থে মানবতাকেই সামনে নিয়ে আসে। ইসলামে দেবতা বিগ্রহের মতো প্রতীকী কোনো রূপ নেই। এ কারণে ঈদের আনন্দ ফল্গুধারার মতো উৎসারিত হয়। এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অনেকটা স্রোতঃস্বিনী নদীর মতো। অমন বেগবান বহতা নদী কোনো বাছ-বিচার করে না। নিজ বুকে নর্দমার পানি, না স্বচ্ছ পানি মিশ্রিত হচ্ছে তা ভাবে না। সব জলরাশিকেই গ্রহণ করে আরও স্ফীত হয়। আরও তীব্র বেগে প্রবাহিত হয়। এমন মানবিকতার উদার পরিবেশ ঈদ উৎসবকে উজ্জীবিত করতে পারে।
আমার বরাবরই মনে হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ ধরে রাখতে পারলে এদেশের ধর্ম-বণিক রাজনীতিকদের অপতৎপরতা আর জঙ্গিবাদ কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য অনালোকিত জনগোষ্ঠীকে আলোতে আনতে হবে আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। বিজ্ঞানমনস্কভাবে ধর্মচর্চা এবং বাঙালির হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাঠক্রমে যুক্ত করতে হবে। আর এ ঐতিহ্যের সৌন্দর্য সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে মিডিয়াকে। আলোর প্রক্ষেপণ ছাড়া কি অন্ধকার দূরীভূত হয়?
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com