Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চ্যালেঞ্জের মুখে উচ্চশিক্ষা সংস্কার

Icon

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এদেশে যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, তখন কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ চলত। ১৯২১ সালের আগে সমগ্র বাংলায় এ অঞ্চলের বিখ্যাত রাজশাহী কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থেকে অনার্স শ্রেণিতে পাঠদান শুরু করে। এরপর সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণে এবং বড়কুঠিতে প্রশাসনিক দপ্তর ও ক্লাস নেওয়া শুরু হয়। এরপর মতিহারে একাডেমিক ভবন নির্মিত হলে ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের অবয়ব বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশের জন্ম হলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৭টি বড় কলেজ নিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে। যদিও সেসময় ঢাকায় কয়েকটি মহিলা কলেজ বেশ সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছিল। বিভাগভিত্তিক হিসাব ধরে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামের কলেজগুলো এ তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থেকে পরিচালিত হলেও খুলনা বিভাগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় সেখানকার কলেজগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে আসে। এরপর নতুন নতুন ডিগ্রি ও অনার্স কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে সেগুলো একই নিয়মানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে থেকে পরিচালিত হতে থাকে।

এক সময় নামি কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। তখন বড় কলেজগুলো থেকে দুই বছরের নরমাল গ্রাজুয়েশন ও তিন বছরের অনার্স ডিগ্রি দেওয়া হতো। তখন কলেজে মাস্টার্স পড়ানোর প্রচলন ছিল না। কলেজ থেকে দুই বছরের ডিগ্রি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর প্রিলিমিনারি কোর্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সেশনের অনার্স ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সুযোগ পেত। আবার কলেজ থেকে তিন বছরের অনার্স ডিগ্রি পাশ করে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সেশনের অনার্স ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সুযোগ পেত। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ‘পিলু’ ও ‘কলু’ নামে আলাদা পরিচিতি ছিল। কিন্তু সেটাতে তারা কিছু মনে করত না। বরং দুই বছরের ডিগ্রিধারীরা ভালো ফলাফল করে এলে দ্রুত বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার সার্ভিসে ঢুকে যেত। তখনকার দিনে অনেকে একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো, আবার সময় বাঁচানোর জন্য ডিগ্রি পাশকোর্স সমাপ্ত করে চাকরি করত। পরবর্তীকালে একজন শিক্ষার্থীর একসঙ্গে বহু জায়গায় ভর্তি হওয়ার এ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়।

এরপর দেশে নানা ধরনের শিক্ষাসংস্কার সূচিত হয় ও নতুন নতুন কলেজের সংখ্যা বেড়ে যায়। দেশে বেসরকারি কলেজের সংখ্যাও অনেক বেড়ে যায়। সরকারীকরণের ফলে অনেক নামি বেসরকারি কলেজ সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আশির দশকে দেশে অনার্স কলেজের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় এবং মাস্টার্স শ্রেণিতে পাঠদান শুরু হয়। ফলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এতগুলো বড় কলেজের তত্ত্বাবধানের ভার বহন করার সক্ষমতা হারিয়ে যায়।

সে কারণে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে কলেজগুলোকে তার অধীনে স্থানান্তর করা হয়। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এতগুলো কলেজের তত্ত্বাবধানের ভার বহন করার সক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার নানাবিধ করণের মধ্যে একটি হলো কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় হাবুডুবু খাওয়া। দক্ষ জনবল না থাকার ফলে নতুন নতুন নিয়মকানুন অনুযায়ী সময়মতো পাঠদান, পরীক্ষা নেওয়া ও ফল তৈরির কাজ সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর থেকে একটি মার্কশিট বা সনদ উঠাতে মাসাধিক কাল আগে ফি জমা দিয়েও সেটা না পেয়ে হেনস্তা হওয়া শুরু হয়। এক সময় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষার বোর্ডগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতি, ঘুস ও সময়ক্ষেপণ শুরু হয়। পাশাপাশি সনদ জালিয়াতি, প্রশ্নপত্রফাঁস ইত্যাদি হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিভিন্ন কমিটিতে থেকে কলেজে প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা ও ভাইভা নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। নিজের দরকারি কাজ ও গবেষণা করতে সময় বের করতে পারেন না। মৌলিক গবেষণাধর্মী পাবলিকেশন্স কমে যায়। ফলে শিক্ষা ও উন্নত গবেষণার বিষয়টি হারিয়ে যেতে থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল চরিত্র হারিয়ে শিক্ষামানের অবনমন ঘটতে থাকে।

এসব অবস্থা নিরসনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স ও ডিগ্রি কলেজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী, ১৯৯২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩২ বছর ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ও ডিগ্রি কলেজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা হচ্ছে। যে কারণে কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে রেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, সেই কারণগুলো কি বিলুপ্ত হয়েছে? তা না হলে আবারও নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলে কলেজকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে কেন?

দ্রুত ভাঙা-গড়ার নিয়ম তৈরি করা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে দুর্বল দিক। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। উচ্চশিক্ষায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগ যদি ঘন ঘন সিলেবাসের টাইটেল পরিবর্তন করে, তাহলে সেই বিভাগে বেশি সেশনজট দেখা দিতে পারে। কারণ, যেসব শিক্ষার্থী আগের বছর ফেল করবে বা ড্রপআউট হবে, তারা পরের বছর শুধু পরিবর্তিত টাইটেলের কারণে নতুন বা চলতি বছরের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ওই কোর্সের পরীক্ষায় একসঙ্গে অবতীর্ণ হতে পারে না। এমনকি কেউ পুরোনো পরীক্ষার্থী হলেও তার জন্য আলাদা কমিটি গঠন করতে হয়, আলাদা প্রশ্ন ও পরীক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। এভাবে যদি ৫-৬টি কোর্সে ড্রপআউট থাকে, তাহলে বিষয়টি খুব জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবেই দেরি হতে হতে সেশনজট তৈরি হয়। বিশেষ করে শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষ সংকট, নানা ধরনের ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদির জন্য নতুন সেমিস্টার ও কারিকুলামে এটা আরাও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আধুনিক পঠন-পাঠন পদ্ধতিতে এসব বিষয়ে ছাড় দেওয়ার ফুরসত নেই। তাই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা অনেক সময় তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষকরা বছরব্যাপী পরীক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এজন্য সময়ের অভাবে মানসম্মত পাঠদানের বিষয়টি উহ্য থেকে যাচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হলো-জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি। এটা ভালো উদ্দেশ্য, কিন্তু এর লক্ষ্য ততটা বাস্তবসম্মত নয়। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলে সেই এলাকায় উচ্চতর কলেজ থাকার দরকার কী? অনেকে অক্সফোর্ডের অধীনে ট্রিনিটি কলেজ বা অন্যকিছুর উদাহরণ দিতে পারেন। কিন্তু ওদের দেশের যোগাযোগ, পরিবেশ, আবাসন, ল্যাবরেটরি গবেষণা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আর আমাদের বাস্তবতার মধ্যে কতটুকু ফারাক বিদ্যমান রয়েছে, তা কি আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি? ওদের দেশে গ্রাম ও শহরের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা একই সমান। কিন্তু আমাদের তা নেই। আমাদের মেডিকেল ও সাধারণ শিক্ষকরা গ্রামে নিযুক্তি পেলে শহরে বদলি হয়ে আসার জন্য চারদিকে তদবির শুরু করেন।

আমরা কেউই ঢাকা থেকে বাইরে বের হতে চাই না। তাই নওগাঁয় সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েও নওগাঁ না গিয়ে সন্তানকে ২২ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকার বেসরকারি অখ্যাত, শিক্ষক ও ল্যাববিহীন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিই। আমাদের মধ্যে এখনো ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং ও টিচিং-লার্নিং’ মানসিকতা বিরাজমান। এটা আমাদের কৃষ্টির অংশ হওয়ায় একজন নতুন এমপি-মন্ত্রী হয়ে খুঁজতে থাকি ঢাকার কোন কিচেন মার্কেটের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অনুমোদন বাগিয়ে নিয়ে ব্যবসা করব-সেটা।

দেশে বর্তমানে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, চারটি স্বায়ত্তশাসিত, ১১৪টি বেসরকারি, তিনটি আন্তর্জাতিক, দুটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমাদের ২,২৫৭টি কলেজ আছে, যার ৫৮৩টি সরকারি। কলেজগুলোতে মানসম্মত শিক্ষাদান হয় না; কিন্তু অনেক কলেজ আছে, যেগুলো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে উন্নত। কোনো কোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনও পূর্ণ প্রফেসর বা ল্যাব নেই, কিন্তু নামি কলেজে ১০-১২ জন পূর্ণ অধ্যাপক ও আধুনিক ল্যাব রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনটি থেকে কারা কোথায় অন্তর্ভুক্তি চাইবেন, তা নিয়ে শুরুতেই সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিছু জেলায় একাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানেও এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা উইং খোলা একটি বাড়তি কাজ। এ কাজ সৃষ্টিতে সঠিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। তাড়াহুড়ো করে এ কাজে হাত দিলে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। দক্ষ লোকবল সঠিক জায়গায় বসানো সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ। তা করা না গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার অভাব দেখা দিতে পারে। এছাড়া কোনো জেলায় বা অঞ্চলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এরূপ সমস্যার উদ্রেক হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়ে সেটা শিক্ষার্থী অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়কে তো আর দেউলিয়া ব্যাংকের মতো অন্যটির সঙ্গে সহজে মার্জ করানো যাবে না।

তাই সক্ষমতা যাচাই করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কলেজের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষাসংস্কার না হয়ে যদি কলেজকে ডাম্পিং করার কাজে নিয়োজিত হয়, তাহলে সেটা কারও জন্য সুখকর হবে না। এ অবস্থার সূচনা হলে রাজধানীর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও বেশি শক্তিশালী হবে এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধুঁকে ধুঁকে চলতে গিয়ে লক্ষ্য হারিয়ে ফেলতে পারে।

এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ২৮ থেকে ১৭ লাখ শিক্ষার্থী হারিয়ে শুধু বেসরকারি কলেজের ১১ লাখ শিক্ষার্থী নিয়ে কীভাবে কোন মর্যাদায় চলবে, সে বিষয়টির সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু গবেষণা করবে, নাকি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মর্যাদায় চলে যাবে তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এজন্য সার্বিক প্রস্তুতি কতটা সম্পন্ন করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। হঠাৎ কোনো পরিকল্পনা হাতে নেওয়া আমাদের জাতীয় রোগ। তাই উচ্চশিক্ষার মতো স্পর্শকাতর প্রাঙ্গণে এ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরুতেই যেন হযবরল হয়ে না পড়ে, সেজন্য আগেভাগে সময় নিয়ে বেশকিছু ওয়ার্কশপ ও ফিল্ড জরিপের মাধ্যমে সুগভীর চিন্তা করাটা বেশি জরুরি।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

fakrul@ru.ac.bd

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম