অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশে বিরাজমান অর্থনৈতিক সমস্যার কথা নিত্যদিনই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো আমাদের চিন্তিত করে, আমাদের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে; কিন্তু নীতিনির্ধাকরা ততটা আমলে নেন বলে দৃশ্যমান নয়। এর পেছনে কেউ কেউ বলছেন ওপর মহলের উদাসীনতা, আবার কেউ কেউ বলছেন সংশ্লিষ্টতা। সত্য যাই হোক, তাতে করে সংকটের মাত্রা কমে যাবে না। সংকট থেকে উত্তরণের প্রথম শর্ত হলো সংকটকে স্বীকৃতির মধ্যে আনা, সংকটকে আমলে আনা। সে কাজটায় আমাদের অনেকখানি অনীহা প্রকাশ পায়। আর সে কারণেই সংকটের সমাধান না হয়ে বরং দিনকে দিন তা গভীরতর হয়।
গত ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শিরোনামে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক আলোচনা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য এ চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্বব্যাংক বলার আগে থেকেই আমাদের গণমাধ্যমগুলোয় আলোচিত হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, কম রাজস্ব আদায় এবং ব্যাপক খেলাপি ঋণসহ আর্থিক খাতের দুর্বলতা। এ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের বাইরে মোটা দাগে তিনটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ঝুঁকি তিনটি হলো-এক. মুদ্রা বিনিময় হারের ধীর সংস্কারের কারণে রিজার্ভে টান পড়ায় আমদানি সংকোচন করতে হতে পারে; দুই. বাজারে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকায় তা আরও বেড়ে যেতে পারে; তিন. সমন্বিত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা না হলে আর্থিক ঝুঁকি বাড়তে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সংস্থাটি মনে করছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি আরও কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের সরকার প্রবৃদ্ধির মাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে আগামী অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। সংস্থাটি প্রবৃদ্ধির এ নিম্নগতির পরও আশা ছেড়ে দেয়নি। তারা মনে করে, বিভিন্ন খাতগুলোতে সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলে প্রবৃদ্ধি তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করার পক্ষে মত দিয়েছে তারা। অন্যদিকে আর্থিক ও মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর করতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে ব্যাংক খাতের কার্যকর সংস্কার করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হযেছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও মন্থর। এত বোঝা যাচ্ছে, বিনিয়োগে মন্দাবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের উচ্চ হারসহ দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে এ খাত চাপের মুখে রয়েছে। এ খাতে ঝুঁকিপ্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। ২০২২ সালে মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এ খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধি পেয়ে ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে লক্ষণীয়, বিশ্বব্যাংকের বাইরে আমাদের দেশের গবেষকরা মনে করেন, যদি হিসাবের কারসাজি পরিহার করা হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশেরও বেশি হবে। খেলাপিদের বারংবার সুবিধা প্রদান এবং সংজ্ঞা শিথিল করার কারণে খেলাপির হার বাড়ছে এবং বাড়ছে আর্থিক ঝুঁকি, সংস্থাটি এমনটাই মনে করে।
বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত মোটেই সন্তোষজনক নয়। যদি সারা বিশ্বের কথা বিবেচনা করি, তাহলে সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত ফ্রান্সে। দেশটিতে কর-জিডিপি অনুপাত ৪৬ দশমিক ২। যদি এশিয়ার কথা ভাবেন, তাহলে দেখবেন জাপানে কর-জিডিপি অনুপাত ৩০। আরও ক্ষুদ্র পরিসরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কথা বিবেচনায় নিলে দেখবেন এ অঞ্চলের ভারতে কর-জিডিপি অনুপাত ২০ দশমিক ৫০, নেপালে ১৯ দশমিক ৬৭, পাস্তিানে ১৪ দশমিক ৮৮ এবং শ্রীলংকায় ১২ দশমিক ৭৪। সেই তুলনায় বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশেরও কম। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ভালো কর-জিডিপির অনুপাত হওয়া উচিত কমপক্ষে ১৫। বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের নজর এড়ায়নি। তারা মনে করে, সবচেয়ে কম কর-জিডিপি যে কয়টি দেশ আছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। রাজস্ব আদায়ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে কর আহরণের তিনটি সমস্যা বিরাজমান। এর একটি হলো, যথাযথভাবে কর আদায় না হওয়া। অর্থাৎ যে পরিমাণ কর ধার্য করা হয়েছিল তা পূরণে ব্যর্থতা। অপরটি হলো, করফাঁকি ও করছাড় এবং তৃতীয়টি হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের প্যারা-ট্যারিফ। বিশ্বব্যাংক কর আহরণের পরিমাণ বাড়াতে তিনটি সুপারিশ করেছে। তার মধ্যে আছে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি হিসাবে এ প্যারা-ট্যারিফ কমিয়ে আনতে হবে। আরও বলেছে, করছাড়কে যৌক্তিক করার এবং তৃতীয়টি কর প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধির কথা।
বিশ্বব্যাংক বলার আগেও গত তিন বছর ধরে এ দেশের বিশ্লেষকরা মূল্যস্ফীতির ভয়াবহতার কথা এবং জনদুর্ভোগের কথা বলে এসেছে। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপর রয়েছে। প্রান্তিক ও নিম্ন-আয়ের মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংক এ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতিকে কঠোর করার পরামর্শ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক উচ্চ মূল্যস্ফীতির মোটা দাগে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো, ডলার সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, টাকার অবমূল্যায়ন এবং জ্বালানি-সংকট ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। এ কারণগুলোর কথা আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকা-আলোচনায় বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু সরকারের ওপর মহল থেকে এ কথা তেমন আমলে নেওয়া হয়নি। বিশ্বমহাজনদের কথায় টনক নড়ে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় আছে কি? বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অবদৌলায়ে সিক মনে করেন আছে। তার ভাষ্য দিয়েই শেষ করব। তিনি বলেন, আর্থিক খাত এবং আর্থিক নীতি সংস্কার করা গেলে বাংলাদেশের অর্জিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি টেকসই হতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা দেশি ও বিদেশি চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো করছে। কিন্তু এ অবস্থা ধরে রাখতে সংস্কারের বিকল্প নেই। মুদ্রা সংকটের কারণে বর্তমানে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এতে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। ফলে বিনিয়োগ কমছে। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বেড়েছে, খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। এরই মধ্যে চলছে ব্যাংক একীভূতকরণ। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে জনমিতির সুবিধা কাজে লাগাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের আর্থিক খাত শক্তিশালী হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবে। এজন্য ব্যাংকিং খাতে সংস্কার দরকার।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়