Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতির সময়ে ঈদবাজারের চালচিত্র

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতির সময়ে ঈদবাজারের চালচিত্র

আগামীকাল মার্চ মাসের শেষদিন। পবিত্র রমজান মাসও শেষের পথে। সামনে পবিত্র ঈদ উৎসব এবং এরপরই বাঙালির নববর্ষ। কেমন যাচ্ছে রোজার মাস, কেমন হবে ঈদের বাজার, কেমন হবে নববর্ষের বাজার? সাধারণত ঈদের বাজার জমে রোজার শেষের দিকে। সেই অর্থে বাজারের হাবভাব পুরোপুরি এখনো বোঝা বেশ একটু কঠিন। তবে কিছু কিছু বিষয় দৃশ্যমান ও অনুমানযোগ্য। যেমন যুগান্তরের খবরে দেখা যাচ্ছে, যমুনা ফিউচার পার্কে ঈদের কেনাকাটা তুঙ্গে। এক ছাদের নিচে সবকিছু পাওয়া যায় বলে ক্রেতাদের পছন্দ ‘যমুনা ফিউচার পার্ক’। এখানে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের সব জিনিসই পাওয়া যায়। এছাড়া রয়েছে কেনাকাটায় আকর্ষণীয় পুরস্কার। আবার যুগান্তরেরই আরও দুটি খবরে দেখা যাচ্ছে, রূপগঞ্জের তাঁতিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। জামদানি পল্লি জমজমাট। সেখানকার বিসিক নগরীতে ৫ হাজার তাঁতি হরেকরকমের জামদানি তৈরিতে ব্যস্ত। এর মধ্যে আছে পান্না হাজার, তেরছা, পালকি, ময়ূরপঙ্খী, বটপাতা, করোলা, জাল, বুটিদার ইত্যাদি ঝকঝকে শাড়ি। সেখানকার তাঁতিরা বলছেন, এবার তারা অনলাইনেও অনেক ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন। তাদের আশা, এবার ঈদ উপলক্ষ্যে তারা ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন। এদিকে রয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা। টাঙ্গাইলের তাঁতিদেরও আশা, এবার গেল বছরের তুলনায় বেশি বেচাকেনা হবে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এ ঈদ উপলক্ষ্যে তারা ৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন।

এ তো গেল জামাকাপড়, শাড়ির কথা। এছাড়াও এ ঈদে ব্যবসা হয় সব ধরনের পণ্যের। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির, যেমন-এসি, ফ্রিজ, ফ্যান, ওয়াশিং মেশিনের ব্যবসা এ মৌসুমে ভালো হয়। ব্যবসা হয় জুতা-মোজার। ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা তো ভালোভাবেই হয়। সয়াবিন তেল, ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, গুড়, দুধ, কিশমিশ, খেজুর, আঙুর-বেদানার ভোগ বাড়ে এবং বাড়ে এসবের ব্যবসা। ২৭ তারিখের কাগজে দেখলাম, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে ১৯৬ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন সমান দশ লাখ) ডলারের ফল আমদানি হয়েছিল, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির মধ্যেই আমদানি হয়েছে ২৪৭ মিলিয়ন ডলারের ফল। এতে মিটবে ৬০ শতাংশ চাহিদা। বাকি চাহিদা দেশীয় ফল মেটাবে। বড়ই, তরমুজে এখন বাজার সয়লাব। বরিশালের তরমুজ চাষিরা দাম পান বা না পান, ঢাকার বাজারে খুচরা বিক্রেতারা চুটিয়ে তরমুজের ব্যবসা করছেন। রয়েছে মসলাপাতির ব্যবসা। ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা। রোজার মাসে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, চিনি, গুড়, মুড়ি, দুধ ইত্যাদির চাহিদা বেড়ে হয় দ্বিগুণ। দামও বাড়ে প্রতিটি পণ্যের। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ সরকারি হিসাবে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি পণ্য বিক্রি হচ্ছে খুবই উঁচু দরে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম কেউ মানেনি। এক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ। তবে সরকারের প্রতিষ্ঠান ‘টিসিবি’, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ন্যায্যমূল্যে খোলাবাজারে ডাল, চিনি, সয়াবিন তেল, মাংস, মাছ বিক্রি করছে। এসব হচ্ছে চাহিদা বাড়ার লক্ষণ। চাহিদা বৃদ্ধির পুরো সুযোগ ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন যথারীতি এবারও।

এদিকে জামাকাপড়ের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, দেশের অন্যতম পোশাকের বাজার কেরানীগঞ্জে ১৫ রোজা পর্যন্ত ক্রেতার সাক্ষাৎ কম। সেখানে প্রায় ১০ হাজার ছোট-বড় শোরুম রয়েছে। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এবার বেচাকেনা গেল বছরের মতো নাও হতে পারে।

পবিত্র রমজান মাসে বেইলি রোডে ইফতারির বাজার খুব জমে। দোকানে দোকানে ভিড় থাকে। বেগুনি, পেঁয়াজু, দইবড়া, চিড়া-দই, আলুর চপ ইত্যাদি বাহারি খাবারের ব্যবসা হয় বেইলি রোড এবং আশপাশ এলাকায়। ব্যবসা হয় ছোলা, মুড়ি, জিলাপির। রয়েছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। কিন্তু এবার রেস্তোরাঁ ব্যবসায় এখানে ধস নেমেছে। অবশ্যই এর কারণ অগ্নিদুর্ঘটনা। পুরান ঢাকার ইফতারির বাজার প্রসিদ্ধ। কিন্তু খবরে জানা যাচ্ছে, এবার ইফতারির বাজার ১৫ রোজা পর্যন্ত সেভাবে জমেনি। পণ্যের উচ্চমূল্য, মানুষের অর্থাভাব এর কারণ। শাকসবজি, ফলমূল, মাছ-মাংসের দামও রোজার মাসে বেশ বেড়েছে। সামান্য পুঁটি মাছের দামও ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি। গুলশা মাছের কেজি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। ২০০, ২৫০, ৩০০ টাকার নিচে বিদেশি কোনো ফল বাজারে নেই। এটি চৈত্র মাস। এ সময়ে লাউয়ের দাম থাকে খুবই নিচুতে। ঢাকার খুচরা দোকানিরা এখনো একটা লাউ বিক্রি করছে ৪০-৫০-৬০ টাকা দরে, যদিও গ্রামে কৃষকদের লাউ কেনার কোনো লোক নেই। মাধবদী হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গির বৃহত্তম বাজার পূর্বাঞ্চলে। সেখানকার বাজারও এখনো জমে ওঠেনি বলে খবর। রোজার মাসে চালের দাম পর্যন্ত বেড়েছে, যা সাধারণত হয় না।

শেষ পর্যন্ত এ বছর ঈদের বাজারে বেচাকেনার পরিমাণ কত দাঁড়াবে তা জানা যাবে অনেক পরে, যদিও সরকারিভাবে এর ওপর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এই মন্দা বাজারে একটা ভরসা আছে, সেটা হচ্ছে ‘রেমিট্যান্সের’ প্রবাহ। আর রয়েছে নিয়মিত বেতন-বোনাস। প্রতিবছরের মতো এখন পর্যন্ত পোশাক কর্মীদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তার খবর রয়েছে। আশঙ্কা, ঈদের আগে অনেক শ্রমিক পুরোপুরি বেতন-ভাতা, বোনাস নাও পেতে পারেন। এরই মধ্যে দায়-দাবি পেশ করা হচ্ছে। এবার রেমিট্যান্স কত আসবে, তার হিসাব ২৭ তারিখ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ২০০ কোটি ডলারের মতো রেমিট্যান্স প্রতি মাসে মোটামুটি আসছে ইদানীং। আশা করা যায়, বরাবরের মতো এই ঈদের মাসে প্রবাসী আয় একটু বেশি হবে। যদি তা হয় তাহলে গ্রামীণ বাজার একটু চাঙা হবে। এমনিতে সাধারণভাবে গ্রামে এখন বেশ অভাব চলছে। এক হিসাবে দেখা যায়, গ্রামে ব্যাংক আমানত বেশ উদ্বেগজনক হারে কমছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে গ্রামে আমানত কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ, যা উদ্বেগের বিষয়। অবশ্য সার্বিকভাবে এ সময়ে আমানত বেড়েছে ১০ শতাংশ। গ্রামে আমানতের একটি বড় অংশ আসে প্রবাসী আয় থেকে। এবার এ খাতে আমানত হ্রাস পাওয়ার কারণ কী? কারণ যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে গ্রামের মানুষের হাতে ক্যাশ টাকা কম। অথচ মানুষ শহর থেকে গ্রামেই ফিরে যাচ্ছে। শহরে টিকতে না পেরে তারা গ্রামে যাচ্ছে। গ্রামে কি সারা বছর কাজ থাকে? তারা কি সঠিক মজুরি/বেতন সেখানে পায়? গ্রামের মানুষের যদি আয় না থাকে, তাহলে ঈদের বাজারের টাকা কোত্থেকে আসবে-এটা এক বড় প্রশ্ন।

বরিশাল অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে জেলেরা বেকার। ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। অতএব, তাদের কোনো কাজ নেই। এমন সময় এসেছে পবিত্র ঈদ। অথচ বরিশাল অঞ্চলে জেলের সংখ্যা লাখ লাখ। তাদের ঈদের বাজার অনিশ্চিত। উত্তরাঞ্চলের খবর কী? ঢাকায় দেখা যাবে এখন প্রচুর রিকশাওয়ালা এসেছে উত্তরবঙ্গ থেকে, বিশেষ করে রংপুর-গাইবান্ধা অঞ্চল থেকে। এমনকি এখন রিকশাওয়ালা আসে দিনাজপুর অঞ্চল থেকেও। তাদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত। জিজ্ঞেস করলেই তারা বলবে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধের কথা। এটা একটা নিয়মিত বাজার। এসব হাজার হাজার রিকশাওয়ালা ঋণের টাকা পরিশোধ করবে, নাকি উচ্চমূল্যের রোজার বাজার করবে-এ এক বিরাট প্রশ্ন।

গ্রামের সমস্যা আরও আছে। গ্রামের মানুষের একটা বিরাট অংশের আয় আসে সবজি বিক্রি থেকে। এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে টমেটোর দাম, তরমুজের দাম, বেগুনের দাম, লাউয়ের দাম নেই। কৃষকরা ভুগছে। তারা ক্ষতির সম্মুখীন। এ সময়েই পবিত্র ঈদ। কী করবে তারা? স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, বাজারের অবস্থা দুই রকমের। বিত্তবান, অতি ধনী, উচ্চবিত্তের বাজার এবং নিম্নবিত্ত ও গরিবদের বাজার। বিত্তবানদের বাজার সওদাতে খুব বেশি অসুবিধার খবর নেই। ঢাকায় বড় বড় শপিংমলের অবস্থা দেখলে তা-ই মনে হয়। তবে কথা আছে। অনেক মধ্যবিত্ত ‘আউস’ করে বড় বড় শপিংমলে ঈদ উপলক্ষ্যে বাজার করতে যায়। এবার এতে ভাটা পড়েছে বলে খবর। মধ্যবিত্তের এমনিতেই নাভিশ্বাস উঠেছে। পণ্যমূল্যে তারা কোনো স্বস্তি পাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি হ্রাসের কোনো লক্ষণ নেই। ডলার সংকটে আমদানি বিঘ্নিত। দেশের ভেতরে মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে। আমাদের দেশে এমনিতেই ভোক্তার কদর নেই, নেই কদর উৎপাদকের। কদর হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের। তারাই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের নিষ্পেষণে মধ্যবিত্ত এবার বিধ্বস্ত। অতএব, মধ্যবিত্তের ঈদের বাজার যে সীমিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কাগজে দেখলাম, একজন অফিসকর্মী এবার পাঞ্জাবি কিনবেন একটা-এ দিয়েই তিনি ঈদ করবেন এবং পহেলা বৈশাখও। আগে তিনি দুই উপলক্ষ্যে দুই ধরনের পাঞ্জাবি ব্যবহার করতেন। এ উদাহরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, মধ্যবিত্তের ঈদের বাজার হবে সংকুচিত। বিত্তবানদের বাজার ভিন্ন। তাদের অনেকে ইতোমধ্যেই কলকাতা, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাই গিয়েছেন বাজার করতে। কলকাতার টিভির খবরে তা প্রচার করা হচ্ছে। অতিধনীরা দেশের বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন। বিমানের টিকিট শেষ। এদিকে টিকিটের সংকট রেলের, বাসের। সাধারণ যাত্রীদের এবারও রেল ও বাসে অতিরিক্ত ভাড়ার বোঝা বহন করতে হবে। যে লঞ্চের যাত্রী নেই, দেখা যাচ্ছে ঈদ উপলক্ষ্যে সেই লঞ্চের মালিকরা এখন ভাড়া দাবি করছেন দেড়গুণ-দ্বিগুণ। জানা যাচ্ছে, ‘রিসোর্টগুলো’ ভালো ‘ডিসকাউন্ট’ দিয়ে ট্যুরিস্ট সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে।

এবার ধনীদের দান কার্যক্রমেও পরিবর্তন আসবে বলে খবর। মোবাইলে, বিকাশের মাধ্যমে ধনীদের কেউ কেউ দান কার্যক্রম চালাচ্ছে। আগে তারা জমাকাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি দিত। এবার একটা পরিবর্তন এসেছে মনে হয়। গরিবদের বাজার জমে ঈদের শেষদিকে। তাদের ভরসা কী? তাদের আয় নেই, আয় কম। অনেকে বেকার। আছে এর ব্যবস্থাও! ঋণ করবে তারা। বলাই বাহুল্য, বছরের একটা দিন পবিত্র ঈদ, এ উপলক্ষ্যে ছেলেমেয়েদের আবদার মেটাতেই হবে যে কোনো মূল্যে। কোত্থেকে আসবে টাকা? এর উত্তর সহজ। তারা ঋণ করবে নতুন করে। তারা এমনিতেই ঋণ জর্জরিত। সরকারি তথ্যই বলছে, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক ঋণে জর্জরিত। মৌলিক চাহিদা মেটাতে ২৬ শতাংশ পরিবার ঋণ করে। তার মানে ১৭-১৮ কোটি লোকের দেশে ৪-৫ কোটিই ঋণী। এবারও তারা ঈদ করতে ঋণ করবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। তারা নতুন ঋণ করে পুরোনো ঋণ পরিশোধ করবেন। এবারও তা-ই হবে। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকট, সরবরাহ সংকট, নিম্ন আয়ের মধ্যেই এবারের ঈদ উৎসব।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম