প্রবাসীদের অবদান অবমূল্যায়ন করা যাবে না
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতার মাধ্যমে কোনো দেশের স্বাধীনতা কখনো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে না। একটি দেশের স্বাধীনতার স্বাদ প্রকৃত অর্থে ভোগ করতে হলে সবার আগে জরুরি অর্থনৈতিক মুক্তি বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। এ কথা বলতেই হয়, আমাদের দেশটির বয়স তিপ্পান্ন বছর পূর্ণ হলেও এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মুখ দেখেনি। তবে এ পর্যন্ত যতটুকু অর্জিত হয়েছে, তার পেছনে যে কয়টি বিশেষ শ্রেণি রয়েছে, তন্মধ্যে প্রবাসীদের অবদানের কথাটি সবার আগে চলে আসে। প্রবাসীরা কেবল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে না, বরং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তহবিল সংগ্রহ ও স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন এবং যুদ্ধ শেষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশটি যখন স্বাধীন হলো, কেবল বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি ভূখণ্ড ছাড়া আমরা কিছুই পাইনি। পাকিস্তানি হানাদাররা দেশটিকে আর দেশ রাখেনি। একটি ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছিল। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট কিছুই ছিল না। সরকারি অর্থনৈতিক ভান্ডার, খাদ্যশস্যের ভান্ডার ছিল একেবারেই শূন্য। মোট কথা যুদ্ধের কারণে কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, বাণিজ্যসহ এমন কোনো খাত নেই, যেখানে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি। পাকিরা শুধু আমাদের অর্থনৈতিকভাবেই শূন্য করে দেয়নি, বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের মেরে মেধাশূন্যও করে দিয়েছিল। এমন একটি চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তে সিংহভাগ নিরক্ষর মানুষের একটি দেশকে পুনর্গঠন ও ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না। এমন একটি কঠিন কাজকেই ভালোবেসেছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু তার বুদ্ধিমত্তা, নেতৃত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের নজর কেড়ে যখন সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই তিনি নির্মম হত্যার শিকার হন। তার হত্যা মানে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রার হত্যা। থেমে যায় বাংলাদেশ।
এরপরের ইতিহাস সবার জানা। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরে এসে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন। দেশটাকে সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তুলে বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা চালান। কিন্তু তার সে চেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটে যখন ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যায়। দেশ আবারও পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু শেখ হাসিনা দমে যাওয়ার নন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে দেশকে আবার ইউটার্নে নিয়ে গেলেন। দেশ এগিয়ে যেতে লাগল। গরিব দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হলো। গ্রামে-গঞ্জে উন্নয়নের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। যে অজপাড়াগাঁ থেকে ঢাকা যেতে দুদিন লাগত, এখন একদিনেই আসা-যাওয়া করা যায়। যে বাজারে কেবল বাঁশ-কাঠ বিক্রি হতো, এখন সেখানে বিক্রি হয় টিভি, ফ্রিজ, এসি, মোবাইলসহ আধুনিক জিনিসপত্র। মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে। যে মানুষ এককালে তিন টাকা কেজি চাল কিনে খেতে হিমশিম খেত, এখন সেই মানুষ ষাট থেকে সত্তর টাকা কেজি দরে চাল কিনে খেতে পারছে নির্দ্বিধায়। যে রিকশাওয়ালা এককালে বিড়ি টানত, এখন তার ঠোঁটে শোভা পায় ফিল্টার সিগারেট। বস্তুত বিশ্বের অনেক দেশই এখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে দেখে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা চাট্টিখানি কাজ নয়। মেট্রোরেলের মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা যেখানে ছিল কেবল স্বপ্ন, তা আজ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব।
এই যে দেশ এগিয়ে চলছে, উন্নয়নের পথে হাঁটছে, এর পেছনে যেমন সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অবদান রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রবাসীদের অনন্য অবদান। মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে দেশকে ভৌগোলিক স্বাধীনতা দিয়েছে বটে, কিন্তু প্রবাসীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য এখনো যুদ্ধ করে চলছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রক্ত পানি করে, স্বজনদের ছেড়ে গিয়ে বিদেশি মালিকদের অত্যাচার ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে তারা অর্থ রোজগার করেন। দেশ থেকে অনেকে মনে করেন প্রবাসীরা বেহেশতে আছে। তা মোটেও সত্য নয়। প্রবাসীদের অনেক কষ্ট করতে হয়। এ কষ্টের পয়সাই তারা দেশে পাঠায়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, বিগত বছরগুলোতে প্রতি বছর গড়ে প্রবাসীরা প্রায় ১৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে, যা কিনা বৈদেশিক রিজার্ভকে মজবুত এবং অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয়, প্রবাসীরা বিভিন্ন জনহিতৈষী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ব্যবসায়িক উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এজন্য প্রবাসীদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলা হয়ে থাকে।
রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, এ যোদ্ধারা বহুলাংশেই অবহেলিত। দেশে পা রেখেই তারা হেনস্তার শিকার হন। এয়ারপোর্ট থেকেই তা শুরু হয়। বাড়িতে পৌঁছার পরও অনেককে শঙ্কিত থাকতে হয়। টাকা-পয়সা দাবি করে উড়ো চিঠি আসে। যে প্রবাসী দেশের উন্নয়নের জন্য, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বলি দিয়ে বিদেশি মালিকদের অধীনে পরাধীন জীবনযাপন করতেও কুণ্ঠিত হন না, সেই প্রবাসীকে যথাযথ মূল্যায়ন বা সম্মান না দিয়ে উলটো যখন বিভিন্ন কায়দায় নাজেহাল ও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তখন তা হৃদয়ে পীড়ন ঘটায় বৈকি।
স্বাধীনতার চুয়ান্নতম দিবস পালিত হবে এবার। দেশটি প্রৌঢ়ত্বের শেষ পর্যায়ে পৌঁছালেও একথা আজ বলতেই হয়, এখন পর্যন্ত প্রবাসীরা যথাযথভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। যদিও বর্তমান সরকার প্রবাসীদের সম্মানার্থে গত বছর থেকে প্রতি বছর ৩০ ডিসেম্বরকে জাতীয় প্রবাসী দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এ উদারতাকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু এর মধ্য দিয়েই কেবল প্রবাসী অবদানের স্বীকৃতি ফুটে ওঠে না। প্রবাসী অবদানকে স্বীকার করতে হলে, স্বীকৃতি দিতে হলে, সম্মান জানাতে হলে, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো একটি প্রবাসী তালিকা তৈরি করতে হবে; যা বছর বছর হালনাগাদের আওতাধীন থাকবে। যেসব প্রবাসী অবসর ও কষ্টকর জীবনযাপন করছে, তাদের ন্যূনতম ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। প্রবাসী পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে অন্যান্য শ্রেণি-গোষ্ঠীর মতো কোটার ব্যবস্থা নির্ধারণ করা আবশ্যক। প্রবাসের কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে সম্মাননাসূচক বিভিন্ন পুরস্কার বা অ্যাওয়ার্ড প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। আশা করি, এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে প্রবাসীবান্ধব এ সরকার প্রবাসী সন্তুষ্টির কথা ভেবে উপরোক্ত বিষয়গুলো আমলে নেবে।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল : কবি ও প্রাবন্ধিক, লিমরিক, আয়ারল্যান্ড