দ্বিতীয় ‘হলোকস্ট’ ও আমাদের কর্মযজ্ঞ
ডা. এম এ হাসান
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকি সেনারা যখন ঘুমন্ত ঢাকা শহরে হামলা চালিয়েছিল, আমি তখন ২২ বছরের এক মেডিকেল ছাত্র। নিজের শহর ও মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম ঢাকার শহরতলি তেজগাঁওয়ে একটি ব্যারিকেডের পেছনে। বিপদের মাঝে আমি ও আমার ভাই শহিদ লে. সেলিম একেবারে ঠান্ডা মাথায় সংকল্পবদ্ধ ও স্থির ছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল আমার বাবার সরকারি স্থাপনায় পাহারারত এক প্লাটুন পুলিশ। আমাদের হাতে নিজস্ব রাইফেল এবং পুলিশদের হাতে ‘থ্রি নট থ্রি’ রাইফেল। রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টায় হঠাৎ আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে গোলা ছোড়ার শব্দ। ট্রেসার বুলেট ও বেরি লাইটে আলোকিত আকাশ, গোলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্মুহু মেশিনগানের বিরামহীন গুলি। এরপর ট্যাংকের ঘড়ঘড় আওয়াজ। শহর কাঁপিয়ে একের পর এক সাঁজোয়া ট্যাংক আসছিল, তাদের সামনে যা কিছু পড়ছিল, সবকিছু গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। সেই রাতে আকাশ-বাতাস ভরে গিয়েছিল আহত ও মুমূর্ষুদের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদে। দেশের মানুষ পথেঘাটে নিহত অথবা আহত হয়ে পড়ে আছে, কেউ শেষ শক্তি দিয়ে আর্তনাদ করছে, কেউ গোঙাচ্ছে। ওই অবস্থায় সাতরাস্তার মোড় ও সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের সামনে সারি সারি সদ্য নির্মিত বাংকারে আমরা। পাকিস্তানি সেনাদের বর্ণনাতীত বর্বরতা ও পৈশাচিকতা অবলোকন করে আমি যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। বিমূঢ় হয়েছিলাম পাকিদের অঙুলি হেলনে অসহায় মানুষের অবর্ণনীয় মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে। যে মানুষগুলো মুর্হূতের মাঝে চরম অমানবিকভাবে শয়তানের শিকার হলেন, তাদের কথা, তাদের সংসার, স্বপ্ন, পরিচয়ের বলয় ভীষণভাবে আন্দোলিত করে আমার আত্মাকে। আমি অনুভব করছিলাম-ভালোবাসা, সৌন্দর্য, মানবতা, সভ্যতা, আমার প্রজন্মের সুন্দর স্বপ্নগুলো ধুলোয় মিশে গেছে। পরের কয়েকদিনে আমাকে চাক্ষুষ করতে হয়েছিল আরও কিছু ভয়াবহ ঘটনা। আমার বাঙালি ভাইদের ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছিল মুসলিম নামধারী নরপিশাচরা, তাদের সঙ্গে কোনো পশুর তুলনা করলে সেই পশুকেই অবমাননা করা হবে, কারণ ওই নরাধমদের তুলনা কেবল তারাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ
২৫ মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জঘন্য এক নারকীয় গণহত্যা। তাদের এ সামরিক অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। পূর্বপরিকল্পিত এ সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল রাত সাড়ে ১১টার পরপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিমান নিরাপদে করাচি ও কলম্বোর মাঝামাঝি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে। ঢাকায় সামরিক অভিযানের দায়িত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের বিশেষ টার্গেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নামানো হয় ১৮ ও ৩২ পাঞ্জাব এবং ২২ বালুচের একটি করে ৩ কোম্পানি (চার শতাধিক) সেনা, যাদের দায়িত্ব ছিল জহুরুল হক হল (তখনকার ইকবাল হল), জগন্নাথ হলসহ অন্যান্য টার্গেট সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। এখানকার অপারেশনের নেতৃত্বে ছিল ৩২ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তাজ। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে টানা ৩৬ ঘণ্টার অধিক সময় চলে পাকি বাহিনীর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসলীলা। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা আক্রান্ত হয়। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেকের বক্তব্য অনুযায়ী, সেনা গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল, ওই দুটি হল হলো আওয়ামী লীগ সমর্থক আর মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। এ ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এক সেনা কমান্ডার এ হল দুটিকে রকেট লঞ্চার, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র আর মর্টার মেরে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পরে তারা ধৃত হিন্দু আর মুসলিম ছাত্রদের হত্যা করে হলের সন্নিহিত খেলার মাঠে মাটিচাপা দেয় বুলডোজার চালিয়ে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নারকীয় গণহত্যার প্রধান শিকার জগন্নাথ হল ও জহুরুল হক হল হলেও ঘটনার ব্যাপকতা মারাত্মক ছিল জগন্নাথ হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ্ হল) ছিল হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় ১৯৫৭ সাল থেকে জগন্নাথ হল হয় হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের আবাসিক স্থল। ভারত বিভাগ ও অন্য কারণে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং তাদের অধিকাংশেরই পড়াশোনা নির্ভর করত গৃহশিক্ষকতার মাধ্যমে অর্জিত অর্থে। অন্যদিকে ঢাকা শহরের মুসলিম সম্প্রদায় তাদের মেয়েদের গৃহশিক্ষকতার কাজে অগ্রাধিকার দিত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের। ফলে গৃহশিক্ষকতার কাজে জগন্নাথ হলের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের ছিল প্রাধান্য। তাই ছুটিতেও তারা ছাত্রাবাসে থাকত।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্যাংক নিয়ে ইউওটিসির দিক থেকে জগন্নাথ হলের দেওয়াল ভেঙে ফেলে এবং সেখান থেকে উত্তর বাড়ির দিকে মর্টারের গুলি ছোড়ে। মর্টারের গুলি একটি আমগাছে প্রথম আঘাত করায় বাড়ির দেওয়ালে একটি গর্তের সৃষ্টি হয়। এর পরপরই শুরু হয় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। এরই মধ্যে পাকি বাহিনীর ট্যাংক জগন্নাথ হলের মাঠের মধ্যে চলে আসে। এভাবেই সূচনা হয় জগন্নাথ হল আক্রমণের প্রথম পর্বের। হানাদার বাহিনী লাউড স্পিকারের মাধ্যমে উর্দু ও ইংরেজি মিশ্রিত ভাষায় আত্মসমর্পণ করে সবাইকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। জগন্নাথ হলের প্রায় সব ছাত্রই তখন নিদ্রায়। আকস্মিকভাবে নির্বিচার গুলিবর্ষণে তারা জেগে উঠে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যে যেভাবে পারে পালানোর চেষ্টা করে। ছাত্রদের একাংশ উত্তর বাড়ির ছাদে জলের ট্যাংকের নিচে, কেউবা শৌচাগারে, কেউ নিজের চৌকির নিচে, কেউ জলের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে ম্যানহোল অথবা কর্মচারীদের গৃহ ইত্যাদি স্থানে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। হানাদাররা ইতোমধ্যে উত্তর বাড়ির কাছে টিনশেডের ওয়েস্ট হাউস ও বর্তমান পূর্ব বাড়ির জায়গায় ক্যান্টিন ও সংলগ্ন টিনশেডের ছাত্রাবাসে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা শূন্যে ইল্যুমিনেটিং ট্রেসার বুলেট ও বেরি লাইট ছুড়ে সব স্থান আলোকিত করে পলায়নপর ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। ক্যান্টিন ও সংলগ্ন টিনশেডের ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার ফলে সেখানে বসবাসরত ছাত্রদের একজন নিকটস্থ একটি পরিত্যক্ত শৌচাগারে আশ্রয় নেয়। এভাবে সে বেঁচে যায়। ভোর হওয়ার আগপর্যন্ত পাকি বাহিনী জগন্নাথ হলের কোনো ভবনেই প্রবেশ করেনি। জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে অবস্থান করে বিভিন্ন ভবনের দিকে ব্রাশফায়ার করতে থাকে। এর মধ্যে সকাল হয়ে যায়, ভেসে আসে পবিত্র আজানের ধ্বনি।
সকালবেলা হলের তালা ভেঙে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই হত্যা করে দারোয়ানদের। চতুর্দিকে ভারী বুটের শব্দ, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ এবং অবিশ্রান্ত গুলির আওয়াজ। এরপর হানাদাররা জগন্নাথ হলের উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষে ছাত্রদের খোঁজ করে, কক্ষের অভ্যন্তরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে, শৌচাগার ও স্নানাগার ইত্যাদি স্থানে তল্লাশি চালায় এবং যাকে যেখানে পায় তাকেই সেখানে গুলি ও বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করে। একইসঙ্গে চলে উর্দু ভাষায় ‘বাঙালি’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ সম্পর্কে অশ্লীল গালাগাল। হলের বিভিন্ন তলায় পড়ে থাকে ছাত্রদের মরদেহ। জল্লাদ পাকি বাহিনীর কয়েকজন ছাদে উঠে যায়। মার্চের প্রথম থেকেই জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির ছাদে উত্তোলন করা ছিল কালো পতাকা ও বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা। পাকি সেনারা ঘৃণাভরে পতাকা দুটি টুকরা টুকরা করে ফেলে দেয়। উপেন্দ্রচন্দ্র রায়, সত্য দাস, রবীন, সুরেশ দাসসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র হলের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে হায়েনার দল। এ পরিস্থিতিতে উপেন্দ্রচন্দ্র রায় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হয়। মৃত অবস্থায় তার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অশ্লীল ও অশ্রাব্য গালি দিয়ে ছাত্রদের ছাদের ওপর লাইন করে দাঁড় করানো হয়। তারপর জল্লাদের দল গুলি চালায়। পরে শহিদ ছাত্রদের মরদেহ ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়।
২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও বহিরাগত অতিথি মিলে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করা হয় এবং গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ওই ৭০ জনের মধ্যে ছিলেন তিনজন শিক্ষক, ৩৬ জন ছাত্র ও চারজন ছিল হলের কর্মচারী। শহিদ তিন শিক্ষক হলেন-ড. এএনএম মুনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (জিসি দেব, দর্শন) ও অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিজ্ঞান)। ড. এএনএম মুনীরুজ্জামানের পুত্র ও কয়েকজন আত্মীয়কেও হত্যা করা হয়। ২৭ মার্চ নিজ বাসভবনের বাইরে গুলিবিদ্ধ হন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি)। তাকে ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখতে পাই। ৩০ মার্চ ড. গুহঠাকুরতা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক মধুসূদনদের (মধুদা) বাড়ি আক্রমণ করে তার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূসহ তাকে হত্যা করে। শিববাড়ীর ৫ জন সাধুকেও বর্বর পাকি সেনারা অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে জগন্নাথ হলের মাঠে।
২.
৯ মাস ধরে চলা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রায় ৩০ লাখ সাধারণ নিরীহ নিরপরাধ নাগরিক, দেশের সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য ভয়াবহ এক বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর আগে নির্মম অত্যাচার সইতে হয়েছিল। এতে সারা দেশ পরিণত হয়েছিল শ্বাসরুদ্ধকর সুবিশাল কারাগারে। সেখানে লাখ লাখ বাঙালি দুঃসহ দুঃস্বপ্নের মধ্যে সময় কাটাচ্ছিলেন। পাকি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়েছিল, তা কোনো গৃহযুদ্ধ ছিল না। নিরস্ত্র সাধারণ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটি ছিল সুপরিকল্পিত গণহত্যা। এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মার্কিন কূটনীতিকরা ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তায় একে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। অন্য বিদেশিরা, যারা মাত্র প্রথম কয়েক দিন এ হত্যালীলার সাক্ষী হতে পেরেছিলেন, তারাও একে গণহত্যা বলতে দ্বিধা করেননি। ১৯৭১-এর গৃহযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। তাদের সিংহভাগই ছিলেন সাধারণ মানুষ। পাকি সেনা এবং তাদের সহযোগী আধাসামরিক বাহিনী যৌথভাবে এদেরকে খুন করেছিল। পাকি সেনাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল নির্বিচার হত্যার এবং তাদের অবাঙালি খুনি দোসরদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইচ্ছামতো হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নিজেদের ঘৃণা, রোষ ও ক্রোধ মেটানোর। পরিকল্পিত হত্যা ও সন্ত্রাসের আবহে ১ কোটির বেশি মানুষ দেশছাড়া হয়েছিলেন। ঘরবাড়ি ভিটেছাড়া আরও ২ কোটি মানুষ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এ সময়ে অসংখ্য হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ও মহিলাদের প্রতি অত্যাচারের ঘটনা ঘটে, নিখোঁজ হয়ে যান অজস্র মানুষ-যারা কেবল সংখ্যা, ছায়া ও স্মৃতি হয়েই রইলেন।
সরকারি নথিতে যথাযথ বিবরণ ও প্রমাণসহ উল্লেখ না থাকায় মুখ্য যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের কখনো শাস্তি দেওয়া যায়নি। নাৎসি নির্যাতনকেন্দ্রের মতো বাংলার মাটিতে কোনো গ্যাস চেম্বার ছিল না ঠিকই, কিন্তু ১৯৭১ সালে এ বাংলায় যা ঘটেছিল, তাকে দ্বিতীয় ‘হলোকস্ট’ বলা যেতে পারে।
স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশ সরকার বা জাতিসংঘের তরফ থেকে এসব ঘটনার যথাযথ মাঠ পর্যায় তদন্ত সম্পাদন করা হয়নি। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে যা প্রকাশ পেয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের অভিজ্ঞতার তুলনায় তা অতি তুচ্ছ। এ জন্যই আমি সহকর্মীদের নিয়ে War Crimes Facts Finding Committee (WCCFC) নামে একটি বেসরকারি সংগঠন গড়ে তুলি। এর লক্ষ্য ছিল প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে ১৯৭১-এর গণহত্যার একটি ঐতিহাসিক নথি প্রস্তুত করা এবং অত্যাচারের ঘটনাগুলোর বিশদ তদন্ত করে এর সঠিক মাত্রা তুলে ধরা। এ সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে বাংলায় ‘যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেস লাইব্রেরিতে এ বইটি নথিভুক্ত (US Congress library, LC Control Number-2001416755. 'War Crimes Genocide and Quest for Justice'). এর একটি ইংরেজি অনুবাদও ঢাকার ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কার্যালয় ও জেনোসাইড আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।
ডা. এম এ হাসান : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস কমিটি, বাংলাদেশ