মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা চিরস্থায়ী হতে পারে না
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মিয়ানমারজুড়ে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশটির অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো বাংলাদেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিজিপি) মধ্যকার আক্রমণ ও পালটা আক্রমণের পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কিছু কিছু চৌকি ‘এএ’ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেখান থেকে বিজিপির সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন অনুসারে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরার ব্যবস্থা করছে। ১১ মার্চ সীমান্তপথে বিজিপির ১৭৯ সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, এর আগে আশ্রয় নেওয়া ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। আপাতদৃষ্টিতে এসব এলাকা ‘এএ’র নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী সহজে সীমান্ত নিরাপত্তা হাতছাড়া করবে না, ফলে সামনের দিনগুলোতে এসব এলাকায় সেনাবাহিনী পালটা আক্রমণ চালাবে। এর ফলে সংকট দীর্ঘায়িত হবে এবং এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলির কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটছে এবং সীমান্ত এলাকার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের চলমান সংকট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। মিয়ানমারের এ সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে এবং এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সীমান্ত নিরাপত্তাসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বর্তমানে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সবই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও ফেডারেল কাঠামোর অধীনে ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমার রাষ্ট্রের পক্ষে। তারা নিজেদের মধ্যেকার মতভেদ মিটিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি যাতে গুরুত্ব পায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বহিঃশক্তির প্রভাবের কারণে মিয়ানমারের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশকেও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হবে। মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলোতে এই প্রথমবারের মতো জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো (ইএও) তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করতে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একত্র হয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে। সামরিক জান্তাবিরোধী সংগঠনগুলো একত্র হওয়ায় মিয়ানমারের ইতিহাসে বর্তমান সংঘাত অভূতপূর্ব তীব্রতা লাভ করেছে। এ সংঘর্ষের ধাক্কা আমাদের সীমান্তেও আসছে এবং সে কারণে বাংলাদেশকে নানাবিধ সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে। তাই রাখাইনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান করণীয় হলো, দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ মিয়ানমারে এমন পরিস্থিতি আশা করে, যেখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সফল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব।
এএ রাখাইনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। দীর্ঘ সময় ধরে এএ রাখাইনে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও তা সংহত করতে কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে তাদের নিজভূমে ফিরে যেতে হবে। তা নিশ্চিত করতে যে কোনো পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং এএ আর্মিকে বিবেচনায় রাখতে হবে। চীন ও ভারতের মতো আরাকান আর্মির সঙ্গে যে কোনো উপায়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ থাকা উচিত।
বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নেতাদের মিয়ানমারের বাইরে থাকা রাখাইনের বুদ্ধিজীবী ও রাখাইনের প্রধান রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সম্পর্ক উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে। গত সাত বছরে এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতির তথ্য জানা যায় নেই। রোহিঙ্গাদের রাখাইনেই ফিরে যেতে হবে এবং সেখানে রাখাইন জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই তাদেরকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সব পক্ষকে এএ’র সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তার বিষয়ে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ও রাখাইনদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে এ ধরনের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ।
চলমান পরিস্থিতিতে বিদ্রোহীদের ঐক্যজোট ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স সরকারের পতন ঘটাতে পারলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে আশা করা যায়। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা গেলে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব এবং অন্যান্য অধিকার ও সুবিধা দিয়ে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেবে বলে জানায়। রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী নেতারা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত সব পক্ষকে এএ এবং এনইউজির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও তা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। মিয়ানমারের, বিশেষত আরাকানের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে দুটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হবে। প্রথমত, মিয়ানমারের অস্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সীমান্তের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদে এ সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া।
এএ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল ও গুলি বাংলাদেশের ভেতরে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এসব চৌকি দখলের উদ্যোগ নিলে আবারও সংঘর্ষের সূচনা হতে পারে এবং সীমান্ত এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের ব্যবহার করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ এএ দখল করে নিচ্ছে। এসব অস্ত্রের সঠিক সংখ্যা ও সেগুলো কোথায় যাচ্ছে তা জানা সবসময় সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতেও অবৈধ পথে এ অস্ত্র আসতে পারে, ফলে ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে এলে পুরো পার্বত্য এলাকায় আবার অশান্তি ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর মানুষ সংকটে রয়েছে। এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এএ এবং রাখাইনের জনগণের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশকে মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকা সম্পর্কে ধারণা বাড়ানোর কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে। বার্মিজ ভাষায় দক্ষ জনবল তৈরি করে তাদেরকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এবং সীমান্তের কাছাকাছি এলাকার জনগণ ও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্ত নজরদারি কিছুটা শিথিল থাকায় এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এখন এএ অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মি বা এনইউজির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগ করতে পারে না, তবে বিভিন্নভাবে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। এজন্য একটা মজবুত প্লাটফর্ম গঠন করতে হবে, যাতে বিভিন্ন পর্যায়ের যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রশাসন, নিরাপত্তা, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, সুশীলসমাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তারা এ সংকট উত্তরণে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগপূর্বক সমস্যা সমাধানে অগ্রগতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণপূর্বক তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা তহবিল কমছে। রোহিঙ্গা সংকট চলমান থাকার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আড়ালে চলে গেছে, বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থে এ সংকট যেন গুরুত্ব না হারায় সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বের নানা প্রান্তে সমস্যা মোকাবিলায় তহবিল সংকট থাকায় বরাদ্দ কমে আসছে। ২০২৪ সালের জেআরপিতে ৮৫ কোটি ২৪ লাখ ডলার চাওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার চাহিদার বিপরীতে ৫০ শতাংশ বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল। সহায়তা তহবিল কমে আসায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর ফলে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। খাদ্য সহায়তা কমে গেলে রোহিঙ্গারা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে, যা ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতা ও অস্থিরতা বাড়াবে বলে মনে করে জাতিসংঘ। বাংলাদেশকে এর মোকাবিলায় এখন মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। একইসঙ্গে সংকট সমাধানের একটা রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
মিয়ানমারের সংঘাত নিরসনে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে একত্রে শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানে তৎপর হতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড মিয়ানমারের সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত; তাই এ দেশগুলোর সঙ্গে একত্রে করণীয় ঠিক করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট যেন বিশ্ব ভুলে না যায়, সেজন্য সংকট উত্তরণের অগ্রগতি নিয়মিতভাবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন, তাই এ সমস্যা সমাধানে সব পক্ষকে নিয়ে আমাদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.) : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক