Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ব্যাংক খাত নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংক খাত নিয়ে মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে

ব্যাংক নিয়ে মানুষের আশঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার দিন কিছুতেই যেন শেষ হচ্ছে না। একটা না একটা দুঃসংবাদ লেগেই আছে। জালিয়াতির সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে নিয়মিত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা আছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা অনিয়মের অভিযোগে পদত্যাগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের দায়দায়িত্ব ঠিক করে দিচ্ছে। ঋণ রি-শিডিউলিংয়ের নিয়ম পরিবর্তন হচ্ছে। ব্যাংকে ব্যাংকে ঘটছে তারল্য সংকট। ডলার সংকটে ভুগছে ব্যাংক। ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ব্যাংকের ঋণপত্র বিদেশি ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে চেয়ারম্যান পদত্যাগ করছেন। ‘প্রভিশনের’ টাকা নেই অনেক ব্যাংকের। ব্যাংকের মালিকানা চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক লোকের হাতে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে পদচ্যুতি ঘটছে।

এমন সব ঘটনা একটা না একটা ঘটেই চলেছে। কাগজগুলো, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এসব খবর ফলাও করে প্রকাশ করছে। প্রতিটি খবর পাঠেই আমানতকারীদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তাদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কোনো শেষ নেই। চারদিকে কানাঘুষা, গল্প-গুজব ব্যাংক সম্পর্কে, ব্যাংকের মালিকদের সম্পর্কে, প্রভাবশালী মালিকদের সম্পর্কে। আলোচনায় আছেন গভর্নর মহোদয়ও। কী হচ্ছে এসব? কী করছে সরকার? কী চাইছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল? নানা পরিবর্তন। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। যেমন, অতি সাম্প্রতিক সময়ের একটা ঘটনা। ব্যাংকের নামের সঙ্গে ‘পিএলসি’ কথাটি ব্যবহার। স্বাধীনতার পর সরকারি ব্যাংকের নামের ক্ষেত্রে কোনো ‘লেজ’ ছিল না। ছিল শুধু নাম-যেমন সোনালী ব্যাংক। হয়ে গেল ‘সোনালী ব্যাংক লিমিটেড’। সব ব্যাংকই হয়ে গেল ‘লিমিটেড’, মানে ‘পাবলিক লিমিটেড’ কোম্পানি। এর অর্থ কী, মানুষ বুঝতে চায়। আমানতের কী হবে? আমানতকারীদের স্বার্থের হানি ঘটবে না তো? ‘লিমিটেড’ কথার অর্থ বুঝতে না বুঝতেই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ‘পিএলসি’। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কী হচ্ছে? নাম পরিবর্তন কেন? ‘পদ্মা ব্যাংক’ আগে ছিল ‘ফারমার্স ব্যাংক’। ‘আল-বারাকা ব্যাংকের’ নাম হয়ে গেল ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’-আরও পরে অন্য নাম। ছিল ‘ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড ক্রেডিট ইন্টারন্যাশনাল’ (বিসিসিআই), রূপান্তরিত হলো ‘ইস্টার্ন ব্যাংকে’। পরিবর্তিত হয়ে নতুন ব্যাংক হলো, নাম তার ‘বিডিবিএল’। আগে ছিল ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ (বিএসবি) এবং ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ (বিএসআরএস)। এ দুটো ‘খতম’ করে তৈরি হয়েছে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড’ (বিডিবিএল)।

প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গেই জড়িত আমানতকারীদের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, দুশ্চিন্তা। ভুগেছেন আমানতকারীরা, এখনো ভুগছেন। আমানতের টাকা পাওয়া যায় না। পেলেও দেরিতে। সুদের টাকা মেলে না। এমন সব ঘটনায় ‘পিএলসি’ ব্যবহারেও মানুষ আতঙ্কিত। ‘লিমিটেড’ থেকে ‘পিএলসি’ কেন? এটা কী বিশাল সংস্কারের সস্তা নমুনা? কী প্রয়োজন ছিল আতঙ্ক তৈরির? ‘লিমিটেড’ ব্যবহার যা, ‘পিএলসি’ ব্যবহারও তা-ই। আবার রয়েছে ‘এলএলসি’। এর অর্থও একই। সবই মালিকদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে-অবশ্যই কোম্পানির মৃত্যু ঘটলে।

‘লিমিটেডের’ পর ‘পিএলসি’-এখন খবর হচ্ছে দুর্দশাগ্রস্ত ‘পদ্মা ব্যাংক’ (পূর্বতন ফারমার্স ব্যাংক), মালিক-ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জালিয়াতিতে ‘অবসায়ন’ হতে যাচ্ছে। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংক ‘মার্জ’ (একীভূত) হবে। পদ্মা ব্যাংকের সব সম্পদ, দায়-দেনা একীভূত হবে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে। দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। অন্তরালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলা হচ্ছে পদ্মা ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক আর ইসলামি ধরনের ব্যাংক এক্সিম ব্যাংক সবল ব্যাংক। ‘সবলের’ সঙ্গে ‘দুর্বলের’ একত্রীকরণ। নাম পরিবর্তন হবে না। এক্সিম ব্যাংক নামেই ব্যাংক চলবে। পদ্মা ব্যাংকের সব দায়দায়িত্ব বর্তাবে এক্সিম ব্যাংকের ওপর। আশ্বস্ত করা হয়েছে, আমানতকারীরা তাদের আমানতের টাকা ফেরত পাবেন। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাকরি যাবে না। আমানতকারীরা টাকা পাবেন, যা হতেই হবে-কিন্তু প্রদত্ত ঋণের টাকার কী হবে? কাগজে দেখলাম ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৬১ দশমিক ৮ শতাংশই খেলাপি। এর কী হবে এ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ খারাপ ঋণের বোঝা নেবে ‘সরকারি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’। ভালো ঋণ ‘ট্রান্সফার’ হবে এক্সিম ব্যাংকে। প্রশ্ন, সরকারি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটা কোথায়? না থাকলে কবে গঠিত হবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যদি খারাপ ‘লোন’সহ এক্সিম ব্যাংকে পদ্মা ব্যাংক মার্জ হয়, তাহলে ঋণের বোঝা এক্সিম ব্যাংকের ওপরই বর্তাবে। আরও প্রশ্ন, এই বোঝা বহনের ক্ষমতা কি এক্সিম ব্যাংকের আছে? এক্সিম ব্যাংক কি এমনই শক্তিশালী ব্যাংক যে এত বড় বোঝা বহন করবে? এছাড়া খারাপ ঋণের বোঝা তার এখনই আছে। এসব নিরূপণ করতে হবে।

বস্তুত দুই ব্যাংকেরই নতুন হিসাব হবে। নিরীক্ষা হবে। তাদের ‘মার্জার স্কিম’ বাংলাদেশ ব্যাংকে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করলে পরে লাগবে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) অনুমোদন। সর্বোপরি লাগবে হাইকোর্টের অনুমোদন-কারণ একটি ব্যাংক এখানে বিলুপ্ত হচ্ছে। বিলুপ্তির জন্য হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। যেহেতু ‘মার্জার’, তাই ‘লিক্যুইডেটর’ নিয়োগ দেবে না মহামান্য হাইকোর্ট। এতসব আইনি ঝামেলা পোহায়ে দুই ব্যাংকের নতুন যাত্রা এক ব্যাংক হিসাবে-হতে সময় লাগবে। এ সময়ের মধ্যে ‘পদ্মার’ আমানতকারীদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? ভালো ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ কর্মকাণ্ড চলবে কিনা-এ প্রশ্নও রয়েছে।

আলোচ্য বিষয়ের কয়েকটি দিক আছে : প্রথম দিক হচ্ছে আমানতকারীদের স্বার্থ, দ্বিতীয় দিক হচ্ছে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাকরির নিশ্চয়তা, তৃতীয় দিক হচ্ছে খেলাপি ঋণের ভবিষ্যৎ, চতুর্থ দিক হচ্ছে দায়ী মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিচার এবং পঞ্চম দিক হচ্ছে এ ধরনে মার্জার স্কিমের সফলতা কতটুকু হয়। প্রতিটি বিষয় বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। আমানতকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এর সঙ্গে জড়িত অনেক ইস্যু। আগে ‘ব্যাংক পুনর্গঠনের’ সময়, অবসায়নের সময় আমানতকারীদের টাকা দেওয়া হয়েছে বেশ বিলম্বে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় বড় আমানতকরীদের নতুন ব্যাংকের ‘শেয়ার’ গছিয়ে দিয়ে ‘বুঝ’ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান ক্ষেত্রে এসব হবে কিনা? রয়েছে সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক আমানত, যা প্রভাবশালী মালিকরা নানাভাবে সংগ্রহ করে ‘লুটের’ কাজ সম্পন্ন করেন। তাও প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এসব টাকার ভবিষ্যৎ কী? ‘নতুন ব্যাংকের’ (এক্সিম ব্যাংক) মালিকানায় পদ্মা ব্যাংকের মালিকদের ভবিষ্যৎ কী?

এবার আসা যাক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে। স্পষ্টতই এটা একটা ভীষণ স্পর্শকাতর বিষয়। বলা হচ্ছে, কারও চাকরি যাবে না। কিন্তু বাস্তবে কি তা সত্যে পরিণত হবে? আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যে কোনো ‘মার্জার’ এক্যুইজিশনে লোকের চাকরি যায়। এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, পদ্মা ব্যাংকের নয় শুধু, এক্সিম ব্যাংকের কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কে থাকবে, কে থাকবে না, তা ঝুলবে নানা কারণের ওপর। কথা আরও আছে। শোনা যাচ্ছে, ১০-১২টি ‘দুর্বল’ ব্যাংক ‘মার্জ’ হবে বড়দের সঙ্গে। অতএব, সব ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাবধান হওয়া দরকার। এটা ‘বাজার অর্থনীতি’। এর মতো নির্দয় আর কেউ নয়। মালিকরা তাদের অতিমুনাফার জন্য কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বলি দিতে প্রস্তুত। কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাদের কাছে ‘বন্ডেড লেবারের’ মতো। ছুড়ে ফেলে দিতে পারে যে কোনো সময়। যারা থেকে যাবেন, তাদের এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ‘বেতন সমন্বয়ে’ বড় সমস্যা হবে। কেউ হবেন ক্ষতিগ্রস্ত, কেউ লাভবান। প্রভাবশালীদের পোষ্যরাই সুবিধা পাবেন। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক যাই বলুক না কেন, বাস্তবে ঘটতে পারে ভিন্ন কিছু। তাই সাবধান!

রয়েছে খেলাপি ঋণের বিষয়। কী হবে এ সবের? খেলাপি ঋণসহ পদ্মা ব্যাংক মার্জার হলে সবিশেষ ফলোদয় হবে না। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার মার্জার এর একটি উদাহরণ। ব্যাংকটি পুরোনো খেলাপি এবং নতুন খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে আবার মরণাপন্ন অবস্থায়। এর কি পুনরাবৃত্তি হবে? জানি না।

এবার আসা যাক ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ প্রসঙ্গে। কোম্পানিটি কবে হবে জানি না। আর হলেই বা কী? খেলাপি ঋণের টাকার ৫০ শতাংশও এসবের কার্যক্রমে উদ্ধার হয় না-হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আরও খেলাপি ঋণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বড় বড় কোম্পানি, গ্রুপের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। ইস্পাত শিল্পসহ বড় বড় শিল্পে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব এখন ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ধারণা, খেলাপি সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। পুরোনো খেলাপি ঋণের সমস্যা মেটাতে না মেটাতেই নতুন খেলাপি ঋণ আসবে। এর প্রতিকার কী? কে ভালো খেলাপি, কে খারাপ খেলাপি-এ এক বিড়ম্বনাময় সমস্যা, যার কোনো সমাধান নেই।

সবশেষে বিচার-আচার। হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিচার হচ্ছে/হয়েছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, জরিমানা হয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের কত টাকা উদ্ধার হয়েছে, তা জনা যাচ্ছে না। অথচ বিচার হতে লেগেছে ১২ বছর। পদ্মা ব্যাংকের কেলেঙ্কারির বিচার হবে কি আদৌ? হলে লাগবে হয়তো ১০-১২ বছর। কিন্তু খেলাপি ঋণের টাকার কী হবে?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম