Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

নির্দয় সমাজ সাদি মহম্মদকে হত্যা করেছে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্দয় সমাজ সাদি মহম্মদকে হত্যা করেছে

এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করে। এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এটা সত্যিই অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। অনুন্নত ও দরিদ্র দেশ হওয়ায় এখানে অপঘাতে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু অপঘাতে মৃত্যুর অন্যতম। মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। কিন্তু যে মৃত্যু ট্র্যাজিক, যে মৃত্যু পরিহারযোগ্য, তেমন মৃত্যু কাম্য নয়। এমন মৃত্যুতে মানুষ অনেক বেশি শোকাহত হয়। এ ধরনের মৃত্যু পরিহার করা সম্ভব হলে তার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। সড়ক-মহাসড়কে যে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, তার অনেকটাই সুশাসনের মাধ্যমে পরিহার করা সম্ভব।

বাংলাদেশে আত্মহননের মাধ্যমে যেসব মৃত্যু ঘটে, তার বেশিরভাগেরই কারণ হলো সমাজের অসঙ্গতি। অনেক সময় সংবাদপত্রে আমরা দেখতে পাই, সন্তানের মুখে আহার জোগাতে না পেরে মা প্রথমে সন্তানদের বিষ খাইয়ে মেরেছে এবং তারপর মা নিজেই বিষপানে আত্মঘাতী হয়েছে। বড় মর্মান্তিক এমন ঘটনা। আমাদের দেশে আত্মহত্যার তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। আত্মহত্যার একটি ডাটাবেজ থাকলে জানা যেত কোন শ্রেণির মানুষ এবং কোন লিঙ্গের মানুষ বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। যে সমাজে আমরা বাস করি, সেই সমাজে আত্মহত্যার ঘটনাবলি সমাজের অসঙ্গতিকে নগ্নভাবে তুলে ধরে। মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অনেকেই স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্যে সমাধান খোঁজে। সামাজিকভাবে নিগৃহীত হলে, আত্মসম্মানবোধে আহত হলে, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে না পারলে, তীব্র মানসিক অবসাদগ্রস্ত হলে কোনো কোনো মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। উল্লেখিত কারণগুলো মনোবৈকল্য থেকে উৎসারিত। মনোবৈকল্যের ফলে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। চরম অসুস্থদের ঠাঁই হয় পাগলা গারদে। মহম্মদ হোসেন নামে একজন চিকিৎসক পাগলা গারদে দু’বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে একটি বই লিখেছিলেন, যে বইটির নাম ‘পাগলা গারদে দুবছর’। পাগলা গারদের মানসিক রোগীদের নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প আছে। কথা আছে, ভারতের এক সময়কার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পাগলা গারদ ভিজিটে যান। সেখানে পাগলদের সামনে নিজেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিলে এক পাগল বলে উঠেছিল, এখানে এলে প্রথম প্রথম অনেকেই এমন কথা বলে। আসলে মানসিকভাবে যারা অসুস্থ, তারা অন্যদের স্বগোত্রীয় মনে করে। পাগলরা মানসিকভাবে অসুস্থ হলেও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় না। ফলে তারা বেঁচে থাকে, তবে সমাজের ওপর বোঝা হয়ে তাদের নিজেদের জীবনও হয় চরম অশান্তির। তবে তারা বুঝতে পারে না, তারা অশান্তিতে নিমজ্জিত। ভারতে প্রতিবছর ৩-৪ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করে। ভারতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া মানুষদের মধ্যে কৃষকই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ কৃষক ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে মহাজনের চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

গত ১৩ মার্চ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে পরপারে চলে গেছেন। তার পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, সেদিন তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রোজার ইফতার করে নিজ কক্ষে চলে যান। সেদিন তিনি গানেরও রেয়াজ করেছিলেন। তার কক্ষের দরজা অনেকক্ষণ বন্ধ দেখে পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয়। দরজায় আঘাত করা সত্ত্বেও সাদি মহম্মদ দরজা খুলে দিতে এগিয়ে না আসায় তার আপনজনরা চরমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত দরজা ভেঙে দেখা যায়, সাদি মহম্মদ গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছেন। সেদিন রাত ৯টার পর ফেসবুকের পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, সাদি মহম্মদ আর বেঁচে নেই। তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাচ্ছিল না, তার মৃত্যু কীভাবে ঘটেছে। আরেকটি পোস্ট থেকে জানা গেল, পোস্টদাতা মন্তব্য করেছেন, এমন মৃত্যুর পথ তিনি কেন বেছে নিলেন। বোঝা গেল তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো, সাদি মহম্মদ আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছিলেন।

সাদি মহম্মদ খুব দরাজ গলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। শান্তিনিকেতন থেকে তিনি রবীন্দ্রসংগীতে উচ্চতর সনদ অর্জন করেছিলেন। শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, তিনি দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গানও গাইতেন। তিনি শ্রোতাদের কাছে কম পরিচিত পঞ্চকবির গানও গাইতেন। তার গাওয়া ‘মুক্তির মন্দিরও সোপানো তলে’ গানটি আমার হৃদয় তন্ত্রিতে প্রতি নিয়ত অনুরণিত হয়। এর চেয়ে অধিক মনপ্রাণ দিয়ে এ গানটি আর কারও পক্ষে গাওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।

সাদি মহম্মদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার অবকাশ আমার হয়নি। প্রায় ২০-২২ বছর আগে কোনো এক উপলক্ষ্যে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তাকে আমার মনে হয়েছে দারুণ সদালাপী, মিষ্টভাষী মানুষ। তিনি আমার সঙ্গে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই স্মৃতি আমি যতদিন বাঁচি, ততদিন আমার হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। এরপর আর কখনো আমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। তবে তাকে দেখেছি ছোট পর্দায় গান করতে। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসাবে তাকে আমি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসাবে গণ্য করব। অবশ্য এ বিচারের যোগ্যতা আমার নেই। কারণ আমি সংগীতবিশেষজ্ঞ নই। আমি যা বলেছি, তা একজন সাধারণ শ্রোতা হিসাবেই বলেছি।

সাদি মহম্মদের মৃত্যু খুবই মর্মান্তিক, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সুঠামদেহী মানুষ কেন এ রকম মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন, তাতে অনেকেই আশ্চার্যান্বিত হয়েছেন। তার ভাই শিবলী মহম্মদ জানিয়েছেন, তিনি অনেকদিন থেকে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। বিশেষ করে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, যদিও তার মা নবতিপর হিসাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। সাদি মহম্মদ ছিলেন অকৃতদার। কেন তিনি দার পরিগ্রহ করলেন না, সে প্রশ্নও আমার মতো অনেকের মধ্যে নিশ্চয়ই আছে। মানুষের জীবনে শূন্যতাবোধ অনেক সূত্র থেকেই আসতে পারে। সাদি মহম্মদের জীবনে শূন্যতাবোধ কোথায় ছিল তা হলফ করে বলা যায় না। কেউ কেউ মনে করেন, সাদি মহম্মদ তার কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় দারুণ মনোকষ্টে ভুগছিলেন। আমাদের দেশে সবসময় জাতীয় পুরস্কারগুলো, বিশেষ করে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার কোনো কোনো সময় অপাত্রে দান করা হয়েছে। সাদি মহম্মদ তা নিশ্চয়ই বুঝতেন। অনেক মহৎপ্রাণ রাষ্ট্রীয় সম্মান পরিত্যাগ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত অনেক দেশেই আছে। বাদশা সুলতান মাহমুদ মহাকবি ফেরদৌসীকে শাহনামা মহাকাব্যটি রচনার জন্য ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে পুরস্কৃত করার ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু এ মহাকাব্যের রচনা শেষে ফেরদৌসীকে ৬০ হাজার রৌপ্য মুদ্রা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হলে ফেরদৌসী তা প্রত্যাখ্যান করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ফেরদৌসী তো যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হওয়ায় আত্মহননের পথ বেছে নেননি। সাদি মহম্মদ নিজের মনকে বোঝানোর জন্য আরও অনেক কারণ খুঁজে পেতে পারতেন। সংগীতশিল্পী হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নন্দিত। অনেকেই তার গানের ভক্ত ছিল। তিনি রবীরাগ নামে একটি সংগীত বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক গায়ক-গায়িকার সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের কথা মনে রাখলে সাদি মহম্মদের পক্ষে আত্মঘাতী হওয়া সম্ভব ছিল না বলেই আমার মনে হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জ্ঞানতাপস হিসাবে দেশবাসীর শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। এমন একজন মানুষ, যিনি ছিলেন বহু ভাষাবিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিক, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ পাননি। তাকে রিডার (এখনকার সহযোগী অধ্যাপক) হিসাবে অবসরে যেতে হয়। এরপর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রফেসর পদে বরিত না হওয়ায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন। এসব কথা তিনি তার অতি আপনজনদের সঙ্গে শেয়ারও করেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তার ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করায় তিনি প্রফেসরের পদবঞ্চিত হন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজ আর বেঁচে নেই। তাকে শ্রদ্ধা ভরে মানুষ জ্ঞানতাপস নামে অভিহিত করে। তিনি প্রফেসর হয়েছিলেন কী হননি তা এখন আর কোনো মানুষের কাছে বড় প্রশ্ন হিসাবে উঠে আসে না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জীবনকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে দীর্ঘায়ু হয়ে ইহজীবন ত্যাগ করেছেন। তিনি আত্মহত্যা করেননি।

সাদি মহম্মদের শেষ বিদায়ের সময় ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দোয়া খায়েরের পরিবর্তে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ক্ষোভ নিয়ে বাদানুবাদ হতেই পারে। এ নিয়ে সুচিন্তিত ভাবনার প্রয়োজন আছে। সাদি মহম্মদের পিতা ছিলেন মুহম্মদ সলিমুল্লাহ। তিনি ছিলেন পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রথম প্রহরের শহিদ। তিনি সাহসিকতার সঙ্গেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। তার সন্তান কেন তার মতো সাহসী হলো না, তা ভেবে অবাক হই। সবকিছু ভেবে মনে হয়, নির্দয় সমাজ সাদি মহম্মদকে হত্যা করেছে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম