Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

একটি স্থায়ী বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি স্থায়ী বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি

পবিত্র রমজানের আজ পঞ্চম দিবস। ঠান্ডা-গরমের মধ্যে দিন যাচ্ছে। আর মাসখানেক পর পবিত্র ঈদ উৎসব। এরপর পালিত হবে নববর্ষ-পহেলা বৈশাখ। এ সময়টা ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে কেমন? অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এ মাসটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের জন্য এক বছরের ব্যবসা এক মাসে করার সময়। আর সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগের মাস-মূল্যস্ফীতির মাস। অথচ এ মাসটি সংযমের মাস। নিয়মানুবর্তিতার মাস। রোজাদাররা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সংযম আশা করেন। পণ্য কিনতে চান ন্যায্যমূল্যে। আর চান একটু স্বস্তি। কিন্তু না, তা হয় না। অথচ প্রতিবছরই সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে, মূল্যস্তর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে। সরকার ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করে। পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করে। ব্যবসায়ীদের, আমদানিকারকদের বিশেষ বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে পণ্যমূল্য স্থিতাবস্থায় থাকে। রাজস্ব বিভাগ রোজায় দরকারি পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দেয়। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর সরকার নানা প্রশাসনিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করে।

এবার নেওয়া হয়েছে আরও বেশি ব্যবস্থা। কারণ, মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি অনেকদিন থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে দুই বছর আগে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। ওইসব দেশে সেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখন আর নেই। চাল, গম, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, সয়াবিনসহ বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা বেশ কিছুটা কম। অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হারও হ্রাস পেয়েছে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকায় হ্রাস পেয়েছে আরও বেশি হারে। অথচ এর কোনো প্রভাব আমাদের দেশে নেই। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নরমে-গরমে অনেক কথা বলে যাচ্ছেন। বোঝা যায়, সরকার মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বদ্ধপরিকর। সরকারি দলের নির্বাচনি ঘোষণাপত্রেও বড় অঙ্গীকার হচ্ছে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা। যুগান্তরের এক রিপোর্টে দেখলাম, সরকারের অনেক বিভাগ, প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, দুই সিটি করপোরেশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বোঝাই যায়, সরকার একটি যুদ্ধে নেমেছে। তার ওপর আছে টিসিবি মারফত খোলাবাজারে ভোগ্যপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা। অধিকন্তু ৫০ লাখ পরিবারকে স্বল্পমূল্যে চাল দেওয়ার ব্যবস্থা। এতসব আয়োজন। এছাড়া রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি। তিনি এ-ও বলেছেন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ের মতো একটি মহল পণ্যমূল্য অস্থির করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে।

এত দীর্ঘ বর্ণনা কেমন দিলাম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতার কথা বোঝাতে, সরকারের গুরুত্বের কথা বোঝাতে। কিন্তু এতসবের ফল কী? ফল তো মাঠ পর্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে না। যুগান্তরের খবরের শিরোনাম ‘নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী : রোজাদারদের জন্য নেই কোনো সুখবর’। আরেকটি কাগজের শিরোনাম হচ্ছে ‘রমজানের পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী গতি’। অন্য একটি দৈনিকের খবরের শিরোনাম হচ্ছে-‘রোজার বাজারে আরও অস্বস্তি’। এসব শিরোনাম থেকে বোঝা যায়-সরকারের সব চেষ্টা সত্ত্বেও বাজারে আগুন জ্বলছেই। চাল, ছোলা, চিনি, খেজুর, মসুরের ডাল, ব্রয়লার মুরগি, ইসবগুলের ভুসি, ট্যাং, মুড়ি, বেগুন, লাল আপেল ও কমলার দাম তিন মাস আগের চেয়ে বেশি। দেশি পেঁয়াজের দাম তো দুই বছরের আগের তুলনায় প্রায় আড়াই-তিনগুণ। গরুর মাংস, ডিমের দামের অবস্থাও তাই। শাক-সবজির বাজারের কী অবস্থা? এক কেজি পটোলের দামই এখন ১৪০-১৬০ টাকা। লাউয়ের দাম একটু নিম্নমুখী। অবশ্য নিম্নমুখীর আবার ভিন্ন অর্থ আছে। বাড়ে ৫০ টাকা কেজিতে, পরে কমে ১০ টাকা। একেই বলা হয় কিছুটা কমেছে। কিন্তু সার্বিক গতি ঊর্ধ্বমুখী, অবিরত ঊর্ধ্বমুখী।

এই যে কাণ্ড, তা শুধু পবিত্র রমজানের সময় নয়, নয় শুধু কুরবানির ঈদের সময়, নববর্ষের সময়। বলা যায়, সব উপলক্ষ্যেই আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, গুদামমালিক, পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীরা অতিলাভের জন্য মুখিয়ে থাকেন। কোনো মহৎ বাণীই তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না। তাদের চাই মুনাফা, অতি মুনাফা, টাকা আর টাকা। বিনা ট্যাক্সে মুনাফা। আইন, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন তাদের কাছে কিছুই না।

এই যে অবস্থার কথা উপরে উল্লেখ করলাম, তা কি নতুন? নতুন নয়। এ ঘটনার জন্য বিভিন্নজন বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন। কারও কারও মতে, ‘সিন্ডিকেট’ বাজারে সংকট তৈরি করে টাকা লুট করছে। কেউ কেউ বলেন, চাঁদাবাজি বা তোলাবাজিই এ মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। কেউ কেউ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, তেলের মূল্যবৃদ্ধিই এর কারণ। আমরা আমদানি, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভর দেশ। অতএব ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশীয় বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। অনেকেই আবার বলেন, সরকারের ভুল রাজস্বনীতির কারণেই মূল্যস্ফীতি ঘটছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আবার কেউ কেউ জোর দিয়ে বলেন, আমাদের অনুসৃত ‘টাকা বানাতে সাহায্য’ করার নীতিই এর জন্য দায়ী। ‘ক্যাপিটেল ফরমেশন’ আর কী! আবার বোদ্ধারা বলেন, খোলাবাজার অর্থনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে। দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলে ব্যবসায়ীরা তার সুযোগ নেবেই। শত হোক, ব্যবসা কোনো ‘দেশপ্রেমের’ বিষয় নয়। ব্যবসা অবশ্যই ব্যবসা। ব্যবসায় ভালো করলে, প্রতিযোগিতায় সফল হলে, ব্যবসা বড় হবে। একসময় ছোট ছোট ব্যবসা মারা যাবে। বড়রা টিকে থাকবে। বাজারে তৈরি হবে ‘মনোপলি’, ‘কার্টেল’ সিন্ডিকেট। আমাদের দেশেও গত ৫০-৫২ বছরে তা-ই হয়েছে। পাইকারি ব্যবসা, আমদানি ব্যবসা, বণ্টন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ বহু আগেই বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ নিয়ে নিয়েছে। তারা আগে রাজনীতিকদের চাঁদা দিয়ে কাজ করত। এখন আর তা নেই। এখন ব্যবসা, রাজনীতি, সংসদ, নীতিনির্ধারণ-সব একাকার হয়ে গেছে। বড় বড় ‘হাউজ’, ব্যবসায়ী গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ব্যাংক আছে, বিমা আছে, আমদানির জন্য বড় বড় জাহাজ আছে, দেশের ভেতরে পরিবহণ ব্যবস্থা আছে। তৈরি পোশাক কারখানা থেকে শুরু করে সব রকমের বড় ব্যবসা তাদের হাতে। তারা সুগন্ধি চালের ব্যবসা যেমন করে, ডিমের বাজারের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।

সারা দেশে কাজ করছে পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট। এ সম্পর্কে আমরা লিখে যাচ্ছি অনেকদিন ধরে। সরকারও তা জানে। কারা কারা আমদানিকারক, কারা কারা ব্যাংক মালিক, কারা কারা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক-এসব সরকারের সব এজেন্সিই জানে। মাঝেমধ্যে তাদের রিপোর্ট, সাবধানবাণী কাগজে ছাপা হয়। আমরা গুরুত্বসহকারে তা পড়ি। এ পর্যন্তই। কোনো ফলোদয় হয় না। মন্ত্রী যায়, মন্ত্রী আসে। মুশকিল হচ্ছে, তারা আবার ব্যবসায়ীও। নীতিনির্ধারণ ও বাজার উভয়ই তাদের হাতে। ব্যাংক ব্যবসা, বিমা ব্যবসাও কিছু লোকের নিয়ন্ত্রণে। কাদের নিয়ন্ত্রণে সবাই তা জানে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ব্যবসা কার হাতে, তা-ও সবাই জানে। বাজার অর্থনীতিতে, উগ্র বাজার অর্থনীতিতে যা ঘটার তা-ই ঘটছে।

বাজার অর্থনীতি-এ কথা এখন প্রমাণিত-একটি বড় শোষণের হাতিয়ার। সাধারণ মানুষকে তা কষ্ট দেয়। ধনীকে ধনী করে, গরিবকে গরিব। এটা একটা ‘মান্দার গাছ’, যাতে কাঁটা আছে। এর কাছ থেকে আমরা আশা করি সুস্বাদু আম। এটা হওয়ার নয়। এ অর্থনীতিতে ধনীরা তাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে দেবে হাজার কোটি টাকা খরচ করে (ভারতের উদাহরণ আছে) আর গরিব লোকেরা কোনো চিকিৎসা পাবে না, পাবে না ভাত।

তাহলে উপায়? একসময় আমরা মনে করেছিলাম ‘সমাজতন্ত্রই’ একমাত্র ওষুধ। আবার মনে করলাম ‘উদার’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এর ওষুধ। সেটাও গেছে। নানা বদনামে এসব উচ্ছন্নে গেছে। এখন বাজার অর্থনীতিই আমাদের অনুসরণীয় পথ। সরকার ব্যবসা করলে সরকারি কর্মকর্তারা ঘুস-দুর্নীতি করে সর্বনাশ করে। তবে ‘বেনিফিট’ পায় অনেক লোক। বেসরকারি খাতে ব্যবসায় চুরি-দুর্নীতি নেই। কিন্তু আছে কিছু লোকের মুনাফা, অতি মুনাফা। দুইয়ের মধ্যে কী তফাত, এখন আর বুঝতে পারি না। তবে বুঝি বর্তমান অবস্থায় বাজার অর্থনীতির মধ্যে একমাত্র পথ সরকারি হস্তক্ষেপ। এবং তা প্রশাসনিক নয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পদক্ষেপ থাকবে; তবে মূল বিষয় হবে উৎপাদন ও বণ্টন। দেশে গড়ে তুলতে হবে স্থায়ী ও শক্তিশালী বণ্টন ব্যবস্থা। এটা সমান্তরাল বণ্টন ব্যবস্থা হবে। মাঝেমধ্যে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি নয়। সাময়িকভাবে ২-৩ মাসের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ নয়। দরকার স্থায়ী বণ্টন ব্যবস্থা, যাতে যে কোনো সংকটে, অস্বাভাবিক অবস্থায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে। পেঁয়াজের দাম বেশি; অতএব সরকারকে তার নিজস্ব বণ্টন ব্যবস্থা, স্থায়ী ব্যবস্থার মধ্যে বাজার সয়লাব করে দিতে হবে পেঁয়াজ দিয়ে। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’ নীতি দরকার। ভদ্রভাবে ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীদের সামলানো যাবে না। দরকার ‘প্যারালাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম’। পাশাপাশি দরকার অতিরিক্ত মুনাফা, উইন্ডফল গেইনসের ওপর বড় ধরনের ট্যাক্সের ব্যবস্থা। প্রশাসনিক ব্যবস্থা চলছে, চলুক। কিন্তু শুধু এ প্রশাসনিক পদক্ষেপে বর্তমান অবস্থা সামলানো সম্ভব নয়। আগ্রাসী বাজার অর্থনীতির পথ ত্যাগ করতে হবে। কিছু লোককে টাকা বানানোর সুযোগ দেওয়ায় নীতি পরিহার করতে হবে। স্থায়ী ও কার্যকর বণ্টন ব্যবস্থা দরকার। কনজিউমার সাপ্লাইজ করপোরেশন (কসকর) ধরনের প্রতিষ্ঠান দরকার। টিসিবি আমদানি করবে, আর কসকর তা বণ্টন করবে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম