সমাধান দিতে পারে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা
মোশাররফ হোসেন মুসা
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অগ্নিকাণ্ডে, বিল্ডিং ধসে এবং মারাত্মক সড়ক দুর্র্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারালে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন সংস্থাকে দায়ী করে রিপোর্ট পেশ করেন। ফলে কোনো ঘটনায় কারও সাজা হয়েছে কি না জানা যায় না। নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া বহু মর্মান্তিক ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। সর্বশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ঘটনায় রাজউক সাত সদস্যের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসও পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। অন্যদিকে এ ঘটনায় দায়েরকৃত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সাত সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রশাসন ইতোমধ্যে চতুর্মুখী অভিযান চালিয়ে বহু রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে এবং নয় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারসহ প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ এ অবস্থায় কমিটিগুলোর তদন্ত রিপোর্ট এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা যে পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর মতো নিষ্ফল হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’ নামের কফিশপ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখান থেকে আগুন দ্বিতীয় তলার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টসহ ওপরের ফ্লোরগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং ৭৫ জন আহত হন। এ ঘটনার পর রাজউক বলেছে, ভবনটি একতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তবে তা শুধু অফিসকক্ষ হিসাবে ব্যবহারের জন্য। রেস্তোরাঁ, শোরুম বা অন্যকিছু করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেছেন, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে-একটি রেস্তোরাঁ স্থাপনে ১০টি সংস্থার প্রত্যয়নপত্র লাগে। এগুলো হলো-সিটি করপোরেশনের অনাপত্তিপত্র, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের রেস্তোরাঁ লাইসেন্স, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের লাইসেন্স নিবন্ধন, কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের দোকান লাইসেন্স, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ফায়ার লাইসেন্স, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশগত ছাড়পত্র ও অবস্থানগত ছাড়পত্র, খাদ্য নিরাপত্তার প্রত্যয়ন, বিএসটিআই-এর লাইসেন্স ইত্যাদি।
এ ঘটনার পর রেস্তোরাঁর মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেছেন, ‘সারা দেশে ৪ লাখ ৮২ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। এসব রেস্তোরাঁয় ৩০ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এতদিন ঘুমিয়েছিলেন কেন? সরকারের উচ্চমহলে ভুল বোঝানো হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সংস্থায় এক হাজার চিঠি দিয়েছি বিভিন্ন সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনার জন্য। এখানে যা ঘটেছে, তাতে রেস্তোরাঁ মালিকদের দায় আছে। একটি ঘটনা ঘটলে সবার টনক নড়ে। ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে হলে একাধিক সংস্থা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কারও কাছে কয়েকটি সনদ থাকলে সেই রেস্তোরাঁ অবৈধভাবে চলছে তা বলার সুযোগ থাকে না।’ এর আগে তিনি একের পর এক রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘হায়েনার মতো আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এটা কি হাইকোর্ট দেখেন না?’
উপরিউক্ত ঘটনায় জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় এমপি সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আক্ষেপ করে বলেছেন, ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে পুড়ে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। তদন্ত করে ৬২ জনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছিলাম। দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরও সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তারপরও চার্জশিট দেওয়ার সময় অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, আজ পর্যন্ত সে মামলায় অভিযোগ গঠন পর্যন্ত হয়নি (আজকের পত্রিকা, ৫ মার্চ ২০২৪)। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি, তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয়। আপনি একটি বহুতল ভবনে আগুন দেখেছেন যার কোনো অগ্নি নির্গমন নেই’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ মার্চ ২০২৪)।
সরকারের সর্বোচ্চ মহলসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন একে অপরের ওপর দোষারোপই করেছেন, কিন্তু একক কর্তৃপক্ষের অধীনে যাবতীয় কাজ নিয়ে আসার কথা কেউই বলেননি। আমরা জানি, একাধিক কর্তৃপক্ষ কোনো কর্তৃপক্ষ নয়, তেমনি দূরবর্তী কর্তৃপক্ষও কোনো কর্তৃপক্ষ নয়। ঢাকা শহরের উন্নয়নের জন্য বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ঢাকামুখী হয়। ১৯৯০-৯১ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ৬০ লাখ। এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই কোটি হয়েছে। ভাবটা যেন ‘ঢাকা বাঁচলে বাংলাদেশ বাচবে!’ এরকম অধিক জনসংখ্যার বসবাস চলতে থাকলে ঢাকার নদনদী, খালবিল কিছুই রক্ষা পাবে না। মানুষ সারা দিন যত কাজ করে, তার ৯০ শতাংশই স্থানীয় কাজ। স্থানীয় কাজ দেখার জন্য স্থানীয় সরকার রয়েছে। স্থানীয় সরকার নিকটবর্তী কর্তৃপক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে সব কাজ নিচ থেকে উপরমুখী হওয়ায় সরকারের সব স্থানীয় কাজে জনগণের অংশগ্রহণ রয়েছে। ফলে সেখানকার জনগণ বহু আগেই নাগরিক শ্রেণিতে তথা সচেতন জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজ পৃথক্করণ ও ভূমিকা নির্দিষ্টকরণ থাকায় সরকারের সব তথ্য জনগণের কাছে সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে এবং জবাবদিহির নিশ্চয়তা থাকে। ফলে কেউই আশাহত হয়ে ভাগ্যকে দায়ী করে না। এদেশে কর্তৃপক্ষগুলো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে অদৃষ্টবাদকে দায়ী করে থাকে। যেমন-আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন। একই কারণে বাস-ট্রাকের ড্রাইভাররা নিকটবর্তী কর্তৃপক্ষ না পেয়ে উইন্ডশিল্ড গ্লাসে লিখে থাকেন-আল্লাহর নামে চলিলাম।
ঢাকা শহরে শতাধিক রকমের মানুষের বসবাস। যেমন-ভাড়াটিয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক, হকার, হোটেল বয়, ওষুধের দোকানের কর্মচারী, যানবাহনের চালকসহ বিভিন্ন সেবা খাতের কর্মচারী। এসব পেশার লোকদের সেবা দেওয়ার কোনো একক কর্তৃপক্ষ নেই। এ অবস্থায় নগরায়ণমুখী বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে একরূপ ‘নগর সরকার’ ব্যবস্থা এর সমাধান দিতে পারে। শুধু তাই নয়, এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থার অধীনেও স্থানীয় সরকার ইউনিটগুলোকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করা সম্ভব।
মোশাররফ হোসেন মুসা : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক