Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

বিজনেস হাউজে কর্মশক্তির সমীকরণ

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিজনেস হাউজে কর্মশক্তির সমীকরণ

আমি অতীতে অনেকবার লিখেছি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মনমানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বাঙালির পরিচয় ছিল ঘরকুণো ও ভেতো বাঙালি হিসাবে। বর্তমানে এ বাঙালিদের কোনোক্রমেই ঘরকুণো বলা যায় না। জীবনের প্রয়োজন মেটাতে বাঙালিরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। দক্ষিণ আমেরিকার চিলি থেকে জাপান পর্যন্ত সর্বত্র রয়েছে এদের আনাগোনা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আগে এই বাঙালিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব একটা মন দেয়নি। পাকিস্তানের আলোচিত ‘বাইশ পরিবারের’ মধ্যে মাত্র একটি বাঙালি পরিবার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে অনেক বিজনেস হাউজ গড়ে উঠেছে। এ বিজনেস হাউজগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ ভালো করেছে। এদের বিনিয়োগের পরিমাণ গড়পড়তা শত-সহস্র কোটি টাকা। এদের ব্যবসায়িক টার্নওভারও বিশাল। পোশাকশিল্প, বস্ত্রশিল্প, নির্মাণ ও অবকাঠামো শিল্প, খাদ্যসামগ্রী শিল্প, ওষুধশিল্প ও চামড়াশিল্পসহ উৎপাদনের বহুবিধ শাখায় এরা সাফল্যের সঙ্গে অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে সমস্যা বা সংকট দেখা দিচ্ছে। সেটি হলো প্রথম প্রজন্মের বিনিয়োগকারীদের মৃত্যুর পর তাদের উত্তরাধিকারীরা সমঝোতা ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারছে না। নানা রকম স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালে পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী অন্তত দুটি বিজনেস হাউজে মারাত্মক সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে উত্তরাধিকারের উত্তরণ কীভাবে ঘটবে। এজন্য মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনেক ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগেই যদি শোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেবে।

এদেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিরা তাদের সন্তানসন্ততিদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণত পাঠিয়ে থাকেন। এসব শিক্ষার্থী বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উন্নত জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিজনেস হাউজের মালিকরা যখন তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করার জন্য বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পাঠাতে শুরু করেন, তখন এদেশের অনেকেই আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এমন আশাবাদী হওয়া অবাস্তব কিছু ছিল না। কারণ তারা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে প্রাগ্রসর জ্ঞানের অধিকারী হবে, বিজনেসের সর্বোত্তম অনুশীলন সম্পর্কে জানতে পারবে এবং উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নের রূপান্তরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজ দেশের শিল্পায়নের বিবর্তনের ধারাটি কী হওয়া উচিত, তা নির্ণয় করতে সক্ষম হবে। তারা হবে ফরোয়ার্ড লুকিং। শতাব্দীর সংকীর্ণ গোষ্ঠীচেতনা থেকে মুক্ত হয়ে যৌক্তিকভাবে বিজনেসের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

অতি সম্প্রতি আমি Greg Baker-এর লেখা ‘Unlocking The Hidden Power of Energy in Business, The Energy Equation’ গ্রন্থটি পড়েছি। Greg Baker তার ২০২০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটির মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘A Friend asked me, why do you want to Just give away your secrets? To which I said to him, ‌‌'I want to start a begges, conversation. I really think the business world needs this sight now. So I offer this book to you. May it help you and your business, now and into the future. As you experience the energy equation and manage the (Previously) hidden energy of you and your business. I hope your find it immensely useful, take it to heart, and become part of the bigger conversation'.

আমরা জানি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। এটি হলো বিজনেস সিক্রেট বা ব্যবসায়িক গোপনীয়তার ধারণা। কোনো ‘বুদ্ধিমান’ ব্যবসায়ী তার ব্যবসার স্পর্শকাতর তথ্যগুলো জনসমক্ষে ব্যবহার করেন না। ধারণা করা হয়, এর ফলে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীরা লাভবান হয়। কিন্তু গ্রেগ ব্যাকার, যিনি একজন নামকরা সিইও এবং বিজনেস কনসালটেন্ট, তিনি কি বুঝে তার গোপনীয় বিষয়গুলো প্রকাশ করে দিতে চান? এর জবাবে তিনি বলছেন, তিনি চান একটি বৃহত্তর কথোপকথন। তিনি বস্তুতই মনে করেন ব্যবসার জগতে এ মুহূর্তে এটি খুবই প্রয়োজন। তিনি আশা করেন, তার গ্রন্থটি অন্যদের ব্যবসায় এখন এবং ভবিষ্যতে সহায়তা করবে। যখন একজন ব্যবসয়ী বুঝতে পারবে তার ব্যবসায় কী ধরনের কর্মশক্তির সমীকরণ লুকিয়ে আছে এবং এ লুকিয়ে থাকা শক্তি ব্যবহার করে ব্যবসাটি পরিচালনা করা যায়, তাহলে তা হবে ব্যবসার বিকাশের জন্য খুবই কাজে আসার মতো ব্যাপার। এভাবে যদি একটি বড় ধরনের আলোচনার সূত্রপাত করা যায়, তার চেয়ে ব্যবসার বিকাশের জন্য আর ভালো কিছু হতে পারে না।

অধিকাংশ ব্যবসায়ী নেতা জানেন না তাদের সংস্থার মধ্যে দৈনন্দিন কার্যক্রমে কীভাবে একটি শক্তিশালী গতিসূত্র কাজ করে। বেশির ভাগ সময়ে সাধারণত সব ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ী নেতারা বুঝতে পারেন না কেন তাদের কিছু উদ্যোগ সফল হয় এবং অন্যগুলো ব্যর্থ হয়। কেন কিছু আলোচনা বা কথাবার্তা থেকে বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং কেন কিছু কথাবার্তার ফলে উৎপাদন কাজে মিলমিশের সৃষ্টি হয় এবং কর্মীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের বুঝতে হবে কেন কিছু কোম্পানি পরিবর্তনহীন অবস্থা থেকে ধসের পথে যায়, আবার কিছু কোম্পানি তাদের নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করে, অর্থাৎ নতুন নতুন উদ্ভাবনার সূত্রপাত ঘটায়।

কর্মশক্তির সমীকরণ একটি মাঠ উদ্ঘাটনকারী নতুন চিন্তা। বাজারে ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য কীভাবে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরকার শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ কর্মযোগকে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়টি তুলে ধরেছে কর্মশক্তির সমীকরণ। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শক্তি তার ভৌত ব্যবস্থারই একটি অংশ। এটি শক্তির অন্যান্য রূপের মতোই একটি শক্তি (যেমন বিদ্যুৎ শক্তিসহ বিভিন্ন জ্বালানি শক্তি)। ব্যবসার অভ্যন্তরীণ এ শক্তি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে এবং অপচয়ের শিকার হতে পারে অথবা এ শক্তি সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ কলহের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ভিসিপন্থি ও ভিসিবিরোধী বলয়ে বিভক্ত। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়ছে। আমরা বাংলাদেশের বিজনেস হাউজগুলোর মধ্যে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে উত্তরণে যে সংকট দেখছি, সেগুলোসহ দেশের শিল্প-কলকারখানা, সেবাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে নৈরাজ্য এবং দুঃখজনক অপচয় লক্ষ করছি, তার মূলে রয়েছে কর্মশক্তির সমীকরণের যথার্থ সমাধান আনতে না পারা। শক্তির যেমন ভৌত আকার রয়েছে, তেমনি তার যে একটি অভৌত আকারও থাকতে পারে, তা আমরা কখনই ভেবে দেখি না। এটি একটি বড় ভুল।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম