Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রমজানে ভোক্তার করণীয়

Icon

এস এম নাজের হোসাইন

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রমজানে ভোক্তার করণীয়

প্রতিবছর পবিত্র রমজান, ঈদ, পূজা-পার্বণ আসার অনেক আগেই আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনে অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করেন। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুতদারের আবির্ভাব ঘটে, এসব ব্যবসায়ী রমজান উপলক্ষ্যে চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চাল, সয়াবিন, খেজুর, পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদি পণ্যের পসরা সাজিয়ে থাকেন। অনেকে আবার ডিও/স্লিপ ব্যবসার মতো পণ্যদ্রব্য আমদানি ও গুদামজাত করে থাকেন। পবিত্র রমজান মুসলিম বিশ্বের জন্য আল্লাহর নিয়ামত বা দান এবং এটি সংযম ও নাজাতের মাস, পাপমুক্তির মাস হলেও এসব মৌসুমি ব্যবসায়ী নামধারী মূল্য সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যরে কারণে জনজীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। ব্যবসায়ীরা রমজানকে মুনাফার মাস হিসাবে চিন্তা করেই প্রস্তুতি নিয়ে বলে থাকেন-‘রমজানে এক মাস ব্যবসা করব, আর সারা বছর আরামে কাটাব।’

পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রমজানের ব্যবহার্য সব পণ্যসামগ্রী এবং পবিত্র বড়দিন উপলক্ষ্যে ইউরোপে ও আমেরিকার দেশগুলোয় পণ্যসামগ্রীর বাজারে বিশাল মূল্যহ্রাস প্রথা চালু আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পূজার সময় মূল্যহ্রাসসহ নানা প্রথা চলমান আছে। এর বিপরীতে আমাদের দেশে পরিস্থিতি পুরোপুরি উলটো। রমজান, ঈদ বা পূজা এলেই আমাদের দেশের খুচরা থেকে মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভোক্তার পকেট কাটার উৎসবে মেতে ওঠেন। ফলে জনগণের জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠে। রমজান নাজাতের মাস হলেও অনেকের কাছে এটি আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়। কারণ তাদের জীবন ও জীবিকা এ মাসে কঠিন হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীদের প্রতি দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে আমরা প্রায়ই সরকারের ওপর দোষারোপ করে থাকি। এটি ঠিক, সরকারের যথাযথ মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগে আর পণ্যমূল্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের খামখেয়ালিপনার কারণে কিছু মুনাফাখোর, মজুতদার, সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্থিতিশীল হয়। একশ্রেণির নীতি-আদর্শহীন, অতিমুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনায় তাদের ইচ্ছামতো নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অস্থির করে দেয়। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ালেও ওই পণ্যের যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে, তখন তারা আর কমায় না। আবার যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখনই জনগণও সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, দাম বাড়ার গুজবে নিজেরাই ওই পণ্যের মজুতে তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়।

একজন সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে আমরা সব সময় আমাদের অধিকারের কথা বলি। অধিকার ভোগ করতে গিয়ে আমাদের ওপর যে দায়িত্বগুলো বর্তায়, তা কিন্তু একেবারেই ভুলে যাই। একজন ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলো হলো-অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, ক্রেতা-ভোক্তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। একই সঙ্গে আমাদের রয়েছে পাঁচটি দায়িত্ব, এগুলো হলো : পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হওয়া; দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করা; আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে ব্যাপারে সচেতন থাকা; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া; ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হওয়া। এ বিষয়গুলো জাতিসংঘ স্বীকৃত ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব হলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত এবং পদে পদে এসব অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি দায়িত্ব সম্পর্কে একেবারেই নির্লিপ্ত ও অনাগ্রহী। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক দাতাগোষ্ঠী দুর্নীতি হ্রাস, সুশাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরব থাকলেও জনগণের নিত্যনৈমিত্তিক এ অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। অথচ এ ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে তৃণমূল পর্যায় থেকেই মানবাধিকার সুরক্ষা বা সুশাসনের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমাদের অধিকার ও দায়িত্বগুলো সম্পর্কে সচেতন? যদি তাই হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যখন নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে, তখন ভোক্তা হিসাবে আমরা কেন তাদের সেই পাল্লায় পা দেব? রমজান উপলক্ষ্যে ক্যাবের পক্ষ থেকে সম্মানিত ক্রেতা-ভোক্তাদের কাছে আমাদের আবেদন-ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সচেতন হই, নিজেরা দায়িত্ববান হই। একসঙ্গে মাসের বাজার না কিনে সপ্তাহের জন্য কিনি। পণ্য ক্রয় করার সময় দাম ও পণ্যের মান যাচাই-বাছাই করে কিনি। কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা কেনা ও মজুতের জন্য হন্যে হয়ে না পড়ে আগে খোঁজখবর নিই, প্রয়োজনে বিকল্প হিসাবে অন্য পণ্য কিনি এবং ওই পণ্যটির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই।

মনে রাখতে হবে, ভোক্তা হিসাবে আমরাই সব পণ্যের নিয়ামক। কোনোভাবেই উৎপাদক ও বাজারজাতকারী খুচরা ব্যবসায়ীরা যেন পণ্যের মূল নেয়ামক না হয়, সেজন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে, সচেতন হতে হবে। ঈদ-রমজান ও পূজা-পার্বণ উপলক্ষ্যে দেশে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী, যারা সারা বছর বিভিন্ন নিত্যপণ্য সরবরাহ করে আমাদের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন, তারাও মৌসুমি ব্যবসায়ীর উৎপাতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে সতর্ক হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তেমনিভাবে ফুটপাতে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে মার্কেটের ভেতরে আসল ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আমরা সাশ্রয়ের জন্য ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করি; কিন্তু তাদের কারণে বড় বড় শহরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিরাপদে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব বিষয় ভাবার সময় এসেছে। আসুন, সবাই বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ব্যবহার বাদ দিয়ে দেশীয় পণ্য কিনি। আমদানি করা পণ্যের বাহারি বিজ্ঞাপনে সাড়া না দিয়ে স্থানীয় পণ্য ব্যবহার করি। দেশকে অন্যের পণ্যের বাজার হওয়া এবং তাদের ওপর নির্ভর করা থেকে বিরত থাকি।

এস এম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

cabbd.nayer@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম