Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

রমজানে কেমন থাকবে পণ্যবাজার

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রমজানে কেমন থাকবে পণ্যবাজার

মতিঝিলের একটি নামকরা রেস্তোরাঁয় শনিবার সন্ধ্যায় হালিমের বাটিতে লেবুর পিস দেওয়া হয়নি। সেটা পাওয়া যায়নি চেয়েও। তিনজন খেতে বসেছিলাম। তাদের একজন বলল, লেবুর দাম বেড়ে গেছে অনেক। অন্যজন বলল, বর্ষায় এর উৎপাদন বাড়বে। ততদিনে রোজাও চলে যাবে। লেবুর চাহিদাও যাবে কমে। দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তখন রিকশাভ্যানে স্তূপ করে লেবু বিক্রি হবে কম দামে। এর ভেতর দিয়ে আমরা ভুলে যাব রোজার আগ দিয়ে লেবুর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা।

আমরা অবশ্য বলতে ভুলিনি-এত বড় আর চালু রেস্তোরাঁয় হালিমের সঙ্গে লেবু দিতে না পারাটা দুর্ভাগ্যজনক। কোনো কারণে বাড়তি খরচ হলে তারা তো খাবারের দাম বাড়িয়েই সেটি উশুল করে নেয়। অনেক সময় খাদ্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি তাদের সুযোগ করে দেয় বাড়তি মুনাফা শিকারের। দেখা যায়, ওই উপকরণের দাম কমে এলেও তারা খাবারের দাম আর কমাচ্ছে না।

যা হোক, লেবুর দাম বাড়লেও কাঁচা মরিচের দাম কমই আছে। বৃদ্ধির প্রবণতাও নেই। মাঝে একদিন রিকশাভ্যান থেকে গাজর কিনেছিলাম ৩০ টাকা কেজিতে। একই লোক আলু বিক্রি করছিল ৩৫ টাকায়। সঙ্গে মিষ্টি আলু। আজকাল রাজধানীতেও এটা বিক্রি হতে দেখা যায়। দামও বাড়ে-কমে। মিষ্টি আলুর উৎপাদন, দাম, গুণাবলি নিয়ে আলোচনা অবশ্য কম। যা হোক, লম্বাটে মিষ্টি আলু কিনেছিলাম ৩০ টাকা কেজিতে। পাশেই আরেক ভ্যানে স্তূপীকৃত টমেটো বিক্রি হচ্ছিল ৪০ টাকা দরে। সেদিন এক ডজন ডিম কিনি ১৩৫ টাকায়।

ডিম নিয়ে তেলেসমাতি হওয়ার পর এর দাম কমে একটা স্থিতিশীল জায়গায় এসেছে। রোজায় ডিমের দাম খুব বাড়বে বলেও মনে হচ্ছে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীতে কম দামে যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তার মধ্যে আছে ডিম। বাজারদরের চেয়ে বেশ কমে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে তারা। তাতেও বোধহয় এ সংকেত দেওয়া হচ্ছে-ডিমের দাম বাড়লেও বেশি বাড়বে না। তবে গোমাংস আর ব্রয়লারের দাম নতুন করে বেড়ে যাওয়ায় মানুষ প্রোটিনের চাহিদা পূরণে বেশি করে ডিম খেতে শুরু করলে এর দাম আবার বেড়ে যাওয়াটা বিচিত্র হবে না। এদিকে দেশে হাঁস পালন বাড়লেও এর ডিমের দাম কেন কমছে না, বোধগম্য নয়। ‘দেশি মুরগি’র ডিমের দামও অনেক।

মাঝে সরকার কিছু ডিম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছিল। দেশ থেকে এর যথেষ্ট সরবরাহ থাকলে আর নতুন করে আমদানি করতে হবে না। তবে লেবুর দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে এটা আমদানি করতে হতে পারে! হালে আমাদের তো নারিকেলও আমদানি করতে হচ্ছে। দেশে ডাবের উৎপাদন নাকি ব্যাহত। আর সব ডাব তো নারিকেল হয় না; এর আগেই চলে যায় ভোগে। মাঝে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নেওয়ার সময়টায় ডাবের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। রমজানে এর দাম নতুন করে বাড়বে। তবে ভালো হতো লেবুর দাম ‘স্বাভাবিক’ থাকলে। লেবুর শরবত তৈরিতে অবশ্য চিনি লাগে। এদিকে চিনির দাম বাড়ছে আবার। সামান্য হলেও নতুন করে শুল্ক কমানো হয়েছিল এর। তাতেও দাম না কমে আরও কিছুটা বেড়েছে।

রোজায় চিনির দাম আরেক দফা বাড়লে অবাক হব না। একাধিক ঘটনায় তেমন সংকেতও মিলছে। মাঝে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলে উৎপাদিত চিনির দাম কেজিতে ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। একে তো তাদের চিনি বাজারে তেমন পাওয়া যায় না, তার ওপর দাম বেড়ে থাকার সময়টায় খোদ সরকারি দপ্তর কেন চিনির দাম বাড়াল, সেটা বোধগম্য হয়নি। এতে বেশ প্রতিক্রিয়াও হয়। তাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিলের চিনির দাম ফিরিয়ে নেওয়া হয় আগের জায়গায়। আশ্চর্যজনক হলেও সম্প্রতি আবার টিসিবির চিনির দাম কেজিতে ৩০ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তাতেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে দ্রুত জানানো হয়, আগের দামেই ওটা জোগানো হবে ফ্যামিলি কার্ডধারীদের মধ্যে। এসব ঘটনায় বোঝা যায়, পণ্যবাজার শান্ত করে আনতে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাদের মধ্যে অস্থিরতা চলছে। ‘সমন্বিত পদক্ষেপ’ নেওয়ার কথা মুখে বলা হলেও কাজের বেলায় উলটোটাই ঘটছে বেশি।

এতে বাজারে এমন সংকেতই গেল যে, চিনির দাম কমে আসার বদলে আরও বাড়তে পারে। সরকার নিজেই এমন সংকেত দিলে বেসরকারি খাত চাইবে এর ফায়দা নিতে। এরই মধ্যে একটি বিজনেস গ্রুপের গুদামে আগুন লেগে বিপুল পরিমাণ চিনি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায়ও বাজারে খারাপ সংকেত গেল। সেই দগ্ধ, গলিত চিনি গিয়ে মিশেছে পার্শ্ববর্তী নদীতে। সেখানে মাছসহ মূল্যবান জলজ প্রাণীর বড় ক্ষতির শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা অবশ্য এ মুহূর্তে বেশি আশ্বস্ত হতে চাইব চিনির সরবরাহের ব্যাপারে। রমজানে এর চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে দেখা যায়। গেল রমজানের চেয়েও দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বলে এবার চিনির চাহিদা হয়তো কিছুটা কম থাকবে। এতে চিনির দাম আরও বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ হলেই মঙ্গল।

চিনির মতো ভোজ্যতেলের চাহিদাও একইভাবে বেড়ে যায় রমজানে। এরও প্রায় ৯৫ শতাংশ করতে হয় আমদানি। কিছুদিন আগে অবশ্য খবর মিলেছে, লিটারপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম কমবে ১০ টাকা। নতুন দাম কার্যকর হতে সময় লাগছে। দাম বাড়ার ব্যাপার থাকলে অবশ্য রাতারাতিই কার্যকর হয়ে যেত। ভোক্তার দিক থেকে এটা দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে সরকার (নতুন নিয়মে) জ্বালানি তেলের দামও কিছুটা কমিয়েছে। তবে ডিজেলের দাম কমেছে নামমাত্র। যেটা বিপুলভাবে লাগে পরিবহণসহ বিভিন্ন খাতে। যা হোক, সয়াবিনের দাম কমালেও পাম অয়েলের ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলা হয়নি। এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে রেস্তোরাঁসহ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে। দামের উল্লেখযোগ্য তফাত থাকায় ব্যয় কমিয়ে চলতে চাওয়া ভোক্তারাও পাম অয়েল কিনে থাকে। খোলা সয়াবিনের দামও সব সময়ই কিছুটা কম। এর মানের প্রশ্নটি অবশ্য উপেক্ষিত।

টিসিবি যেসব পণ্য ভর্তুকি দামে জোগায়, তার মধ্যে ভোজ্যতেলও আছে। তারা কি পারে না আরও কম দামে পাম অয়েলও জোগাতে? এটা প্যাকেটজাত অবস্থায়ও বিক্রি হতে দেখা যায়। খাদ্যপণ্য খাতে জোরালোভাবে উপস্থিত একটি বিজনেস গ্রুপ সুদৃশ্য পলিপ্যাকে পাম অয়েল এনেছে বাজারে। ভাজাপোড়া খাবার তৈরিতে এটা বেশ কার্যকর বলেই শুনি। স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে কোন ভোজ্যতেল কোনটির চেয়ে ভালো, সে আলোচনায় যাওয়া অবশ্য আমার কর্ম নয়। কেবল প্রাপ্যতা আর দামের বিবেচনাতেই এখানে মন্তব্য করা হচ্ছে। রমজানে সরিষার তেলের চাহিদাও কম বাড়ে না। অন্যান্য ভোজ্যতেলের সঙ্গে এর দামও ইতোমধ্যে বেড়েছে। সরিষার চাষ বাড়ছে দেশে। সঙ্গে সরিষার ফুল থেকে মধু উৎপাদন। মধুতে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতাও কম নয়। অনেকে তাই বেশি দামে কেনা মধুর তুলনায় চিনিতেই ভরসা রাখে। তারা চায়, চিনির দামটা অন্তত সহনীয় হয়ে আসুক।

শীত শেষ হয়ে এলেও বাজারে সবজির সরবরাহ ভালো। এখন তো অনেক সবজি সারা বছর পাওয়া যায়। কিন্তু দাম সহনীয় থাকছে না। গেল শীতে পরিস্থিতিটা ছিল অসহনীয়। মূল্যস্ফীতি যে বেড়ে-কমে ৯ শতাংশের উপরেই (সরকারি হিসাবে) থাকছে, এর একটা কারণ কিন্তু সবজির দাম। এর মধ্যে আলুর দাম অনেক বেড়ে এবং যথেষ্ট ভুগিয়ে শেষে একটা পর্যায়ে এসেছে। নতুন আলু ওঠার পরও দাম দ্রুত কমেনি। রমজানে মূল মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে এসে গেলে কি এর দাম সহনীয় হবে? ভারত থেকে ‘কোটা’য় কিছু পেঁয়াজ আসার কথা। সেটা দ্রুত হলে এরও কিছু প্রভাব পড়বে বাজারে। মিয়ানমার থেকেও কিছু পণ্য, যেমন: মাছ, মসলা আসে। তবে দেশটির অভ্যন্তরীণ সংঘাত সীমান্ত পর্যন্ত চলে আসায় আমদানি এখন বন্ধ বলা যায়। এরও কিছু প্রভাব কি থাকবে না রমজানের বাজারে?

নতুন করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কিছু নেই আসলে। শবেবরাত কিংবা এর আগে থেকেই প্রধান অনেক পণ্যের দাম বেড়ে আছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমরা এর সুফল পাচ্ছি না নানা কারণে। এর মধ্যে ডলারের বর্ধিত দামে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ঘটনাটি বেশি আলোচিত। কম আলোচিত পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি আর সব পর্যায়ে অতিমুনাফার প্রবণতা। ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুতের দাম নতুন করে বাড়ানোটাও এতে ঘৃতাহুতি দেবে। ডিজেলের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হলে হয়তো কিছু কাটাকাটি হয়ে যেত। মূল্যস্ফীতি কমানোর ঘোষণা থাকলেও সরকার এর সুযোগ নিচ্ছে না কেন, বোধগম্য নয়। বেশি শুল্কারোপ করে রাজস্ব বাড়াতে গিয়েও পণ্যবাজারকে অস্থির করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। খেজুরের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। সম্প্রতি কিছুটা কমানো হলেও এতে এখনো বেশি শুল্ক আরোপিত। জ্বালানির মতো কৌশলগত পণ্যেও কেন উচ্চহারে শুল্ক থাকবে, সে প্রশ্ন রয়েছে। মূল্যস্ফীতিতে এর বহুমুখী প্রভাবের কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে?

এ সময়টায় মাঠে বোরোর আবাদ যেন কোনোভাবে ব্যাহত না হয়। সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ যথানিয়মে জোগাতে হবে। ভর্তুকি কমাতে এসবের দাম বাড়ালাম; ঠিকমতো সরবরাহও করতে পারলাম না, এমনটা যেন না ঘটে। চালেও আমাদের ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ কিন্তু সংকটে। প্রায় সব জরুরি পণ্যেই বাড়ছে আমদানিনির্ভরতা। চালও আমদানি করতে হচ্ছে। এদিকে আবার কমে এসেছে আমদানি সক্ষমতা। অনেক ক্ষেত্রে শিল্পের জন্য জরুরি পণ্যসামগ্রীর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেও খাদ্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখতে চাইছে সরকার। আসছে রমজানের প্রতিফলনও আমরা দেখতে চাইব পণ্যবাজারে।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম