Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আর্থিক অসহযোগিতা লিঙ্গবৈষম্যের বড় কারণ

Icon

রোকেয়া কবীর

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আর্থিক অসহযোগিতা লিঙ্গবৈষম্যের বড় কারণ

আর্থিক অসহযোগিতা লিঙ্গবৈষম্যের বড় কারণ

লিঙ্গবৈষম্য ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারীর সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো প্রতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের একটি মূল উদ্দেশ্য। এজন্য প্রতি বছরই নির্দিষ্ট একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়, যে প্রতিপাদ্যকে ঘিরে পৃথিবীর দেশে দেশে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করার মূল লক্ষ্য সামনে রেখে সমতা অর্জনের জন্য কার্যকর পরিবর্তন আনতে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইনভেস্ট ইন উইমেন : অ্যাকসেলারেট প্রোগ্রেস’, যেখানে নারীদের জন্য বিনিয়োগ করে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রতিপাদ্য খুবই সময়ানুগ ও গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারি, ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জলবায়ু বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা ২০২০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে গুরুতর দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩৪ কোটিরও বেশি নারী ও মেয়েকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে হতে পারে। বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইউএন উইমেন-এর ২০২২ সালে করা স্ন্যাপশট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতা অর্জনের জন্য বর্তমান বিশ্ব সঠিক পথে এগোচ্ছে না, যার প্রধান কারণ জেন্ডার সমতা অর্জনের লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দে বছরে ৩৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি। যুদ্ধ-সংঘাত এবং জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা এমন ধারণা করেছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ দেশই নাগরিকদের জন্য ব্যয় কমিয়ে দেবে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। দেশে দেশে কমে গেছে সামাজিক সুরক্ষা ও প্রয়োজনীয় পরিষেবা খাতের ব্যয়। তাতে নারী সমাজের ওপর ভয়াবহ কুপ্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের নারীরাও এর বাইরে নয়।

আমরা জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই নারী। কাজেই নারীর জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমান হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অন্যতম মূলনীতি ছিল সমতা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও এ নীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার ও সুযোগ স্বীকৃত হয়েছে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায়ও। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিসত্তা নির্বিশেষে সবাই যাতে সমান অধিকার ও সমান সুযোগ ভোগ করতে পারে, সেজন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) প্রণীত হয়েছে। সিডও সনদে স্বাক্ষরের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছে নারী উন্নয়ন নীতি। দুঃখজনক, এতসব জাতীয়-আন্তর্জাতিক আইনি ও নীতিগত ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখনো নারীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি এবং সমান অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। সামাজিক ক্ষেত্রে নারী এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে পরিগণ্য। নারীর স্বাধীন চলাফেরা এ সমাজে এখনো নির্বিঘ্ন নয়। কারণ, তার সব জায়গায় সবসময় যাওয়া ও সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের অধিকার এখনো সমাজ স্বীকার করে না। তদুপরি, এখনো ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী অবাধে নারীর কর্মোপযোগী পড়াশোনা ও স্বাধীন চলাফেরার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা চালাতে পারে। নারী ও মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে এখনো প্রতিদিন যে পরিমাণ সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তাতে মনে হয়, আমাদের সমাজ এখনো বর্বর দশাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নারীবিরোধী এ সমাজ-সংস্কৃতির কারণে আইনি বাধা সত্ত্বেও বাল্যবিয়ের যূপকাষ্ঠে প্রতিদিন বলি হচ্ছে অজস্র মেয়েশিশু ও কিশোরী। এরকম প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশই নারীকে সমান হয়ে গড়ে উঠতে দেয় না। ফলে তারা সমনাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের সমদুয় নাগরিক সুবিধাদি সমানভাবে ভোগ করতে পারে না। এ প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে নারীর সমান হয়ে ওঠার অনুকূল সামাজিক পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে নারীমুক্তি সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।

অর্থনৈতিকভাবে আমাদের নারীদের বেশির ভাগই পরনির্ভরশীল হয়ে জীবনধারণ করতে বাধ্য হয়; যদিও তাদের শ্রমের ফসল বিনা পারিশ্রমিকে পরিবারের সবাই ভোগ করে। যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক বিধিবিধানের কারণে নারীদের বৃহদাংশই সামাজিক বাধামুক্ত হতে পারে না, ফলে তাদের পক্ষে সাধারণত নির্বিঘ্নে উপার্জনমূলক কাজে অংশ নেওয়াও সম্ভব হয় না। বিয়ে হলে স্বামী-শ্বশুরের সংসারে আর না হলে বাপ-ভাইয়ের সংসারে এদের স্রেফ দাসীর ভূমিকা পালন করে জীবন পার করে দিতে হয়।

অনেক পরিবারের নারীদেরই ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হওয়ার অনুমতি নেই। তবু, দিনে দিনে এ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে এ ক্ষেত্রে নারীদের প্রধান সমস্যা এখনো মূলধন বা পুঁজির সংকট। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে গেলে যে জামানত দিতে হয়, সে পরিমাণ অর্থ তাদের নিজেদের হাতে থাকে না। যে কারণে অনেক আগ্রহী নারী তাদের স্বপ্নের ব্যবসা শুরু করতে পারেন না। এসব বাধা অনেকটাই দূর হতে পারে উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু সমাজ গ্রহণ করবে না অজুহাতে সরকার এখনো উত্তরাধিকারে সমঅধিকারসংক্রান্ত সিডও সনদের বিশেষ ধারা (ধারা ২ এবং ধারা ১৬.১-গ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করছে না। আবার সমাজকে তৈরি করার জন্য কোনো ভূমিকাও নিচ্ছে না। তাতে দিনের পর দিন বিষয়টি অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। অথচ নারীদের অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম করে তুলতে হলে অবশ্যই উত্তরাধিকারে সমান অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দেশের নারীরা সব ধরনের কৃষিকাজ করলেও জমির মালিকানা না থাকায় সরকারি সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এমনকি ভূমিহীন নারীরা স্বামী বা সক্ষম পুত্র না থাকলে খাসজমির মালিকানাও পান না। তা ছাড়া, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার না থাকায় শিশু বয়স থেকেই পরিবারে মেয়েশিশুকে লালন-পালন করা হয় মূলত একটা উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। পরিবারের এ মানসিকতা যেমন বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি করে, তেমনি জীবনভর নারীদের পরজীবী হিসাবে গণ্য হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়।

আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার ও দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অধিষ্ঠান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের নারীদের অংশগ্রহণের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আট কোটিরও বেশি নারীঅধ্যুষিত এদেশে সংখ্যাগতভাবে এ অংশগ্রহণ খুবই তুচ্ছ। সরকারে ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শে দল পরিচালিত হওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে নারীদের দুর্বলতা। সরাসরি ভোটে সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়ে আসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দরকার হয়, তা অধিকাংশ আগ্রহী ও যোগ্য নারীর থাকে না। যে কারণে তারা মনোনয়ন ফরম ক্রয় করলেও দল থেকে মনোনয়ন পান না।

এটা জানা কথা, নারী ও মেয়েদের অগ্রগতি হলে অগ্রগতি হয় সমাজের সব মানুষের, তথা গোটা দেশের। যেমন, গার্মেন্টসে কাজ করে যে মেয়েরা, তারা স্থানীয় শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্য, টিভি, ফ্রিজ ক্রয় করে স্থানীয় বাজারে ও শিল্পকারখানায় অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনে। দেশ ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিতে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জনগোষ্ঠীর অর্ধেক অংশ নারীর প্রতি বৈষম্য টিকিয়ে রেখে আমরা সবার জন্য মানবাধিকারও নিশ্চিত করতে পারব না। এজন্য আমাদের বিদ্যমান আইন, নীতি ও বিধিবিধানের সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতির যে ফারাক, তা ঘোচানোর জন্য আশু তৎপরতা আবশ্যক। সর্বোপরি, এসব কিছুর জন্যই দরকার পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। নইলে প্রতি বছর নারী দিবস আসবে-যাবে, তাকে ঘিরে আমরা নানা কর্মসূচি পালন করব ও কথা বলব ঠিকই, কিন্তু সমতা নিকটবর্তী তো হবেই না, বরং দমন-পীড়ন-নির্যাতন অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও কেবল মুখের বুলি হয়েই থেকে যাবে।

রোকেয়া কবীর : মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী; নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম