দেশপ্রেমের চশমা
রাজনীতি ঠিক না হলে সংকট কাটবে না
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নামে একটি প্রশ্নবিদ্ধ ‘নির্বাচন’ হয়ে গেল। এ নির্বাচন বর্জন করেছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপিসহ বড় দলগুলো ভোটারদের এ নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানায়। এ আহ্বানের পক্ষে নির্যাতন, গ্রেফতার ও বিভিন্নমুখী বাধার মধ্যেও দলগুলো এদের দাবির পক্ষে সভা-সমাবেশ করে। জনগণের মাঝে আন্দোলনরত দলগুলোর নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন বর্জনের দাবিসংবলিত লিফলেট বিতরণ করেন। বিরোধীদলীয় দাবির পক্ষে অনুষ্ঠিত আন্দোলন কর্মসূচিগুলো অহিংস ছিল। সরকার যদি বিরোধীদলীয় দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারাধীনে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে পারত, তাহলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হতো। সে ক্ষেত্রে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেত। কিন্তু সরকার তা চায়নি। পরিবর্তে, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো ফন্দিফিকির করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে। সে জন্য আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর দাবি আমলে না নিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের অগঠনতান্ত্রিক উপায়ে প্রার্থী বানিয়ে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রথম সারির অধিকাংশ নেতাকে ‘নাশকতার’ গায়েবি সন্ত্রাসী মামলায় গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে আন্দোলনরত দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচনি প্রহসন করেছে। টিআইবি এ নির্বাচনকে ‘একপক্ষীয় ও পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ উল্লেখ করে এহেন নির্বাচনকে দেশের গণতন্ত্র ও ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত’ বলা হয়। এ নির্বাচন যুগপৎ দেশের বিবেকবান নাগরিকদের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোও এ নির্বাচনকে স্বচ্ছতার সনদ দেয়নি। নির্বাচনের পর তড়িঘড়ি সরকার গঠিত হয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দেশগুলো পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক অবস্থান থেকে নড়েনি।
সরকার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। অসংখ্য মামলা করে অসংখ্য বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে আসামি করে তাদের ঘরছাড়া করে। এসব নেতা বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। এভাবে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সরকার একতরফা নির্বাচনি বিজয় অর্জন করে। নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনে শতকরা ৪১ ভাগেরও বেশি ভোট পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়। ভোট পড়ার এ হার স্বদেশে ও বিদেশে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। নির্বাচন বর্জনকারীদের কেউ কেউ এ নির্বাচনে ৪ থেকে ৫ শতাংশ ভোট পড়তে পারে বলে দাবি করেছেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, আগের দুবারের মতো এবারও কি এ নড়বড়েভাবে ‘নির্বাচিত’ সরকার এমন ‘গণবিচ্ছিন্ন’ নির্বাচনের ওপর ভর করে ৫ বছর দেশ পরিচালনায় থাকতে পারবে? বিএনপি ও আন্দোলনরত দলগুলোকে তাদের চলমান আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে ‘সবক’ দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দলটির আন্দোলন করা হবে না। পরোক্ষভাবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে ভুল করেছে, সে বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে দলটির জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্ত নিলে পরবর্তী সময়ে দলটি ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং তারপর সংসদ নির্বাচন এলে আবার সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপি ও আন্দোলনরত দলগুলোর আজীবন বিরোধী দল হয়ে থাকা ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
কৃত্রিম নির্বাচনের ধাক্কা খেয়ে স্তম্ভিত নাগরিক সমাজ চিন্তা করতে শুরু করেছে, এ সরকার আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারবে কি? নাকি এর বিকল্প কিছু হবে। তারা আরও ভাবতে শুরু করে, সরকারি ব্যাখ্যায় যেভাবে বলা হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছে-তা কতটা সঠিক? এমনই সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আক্তার, পররাষ্ট্র দপ্তর এবং এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মাইকেল শিফার এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এনএসসি) দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর এইলিন লাউবেখার সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম ঢাকা সফর করেন। এরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসসহ ঢাকায় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে দেড় ঘণ্টার বৈঠক করেন। এ বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে সদ্য কারামুক্ত দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা হয় তা কোনো পক্ষই স্পষ্ট করেননি। কিছু না বললেও বাংলাদেশের বিপন্ন গণতন্ত্র, প্রহসনমূলক ডামি-স্বতন্ত্রের নির্বাচন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা, প্রফেসর ইউনূস প্রসঙ্গ, গ্রেফতার-নির্যাতন, অহিংস বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পোশাকধারী বাহিনীর বাধা প্রদান ইত্যাদিবিষয়ক আলোচনা হয়ে থাকতে পারে।
মার্কিন এ দলটি বিএনপির সঙ্গে এবং সুশীলসমাজ ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো বৈঠক করেননি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে একাধিকবার বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে দেশটির নেতিবাচক মনোভাব যে অটুট ও অপরিবর্তিত থাকার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন দলটি ফিরে যাওয়ার পর কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা দাবি করছেন, দলটি সরকারকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলে গেছে। এর পর থেকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের উচ্চারণ রাজনৈতিক মহলে শোনা যাচ্ছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্ব সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে, এমন কথার দৃশ্যমান প্রমাণ নেই। আর যদি মার্কিনিরা এমন কথা বলেও থাকেন, তাতে বাংলাদেশের চলমান সংকটের সমাধান হবে না। কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর যদি একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়, আর সে নির্বাচনে আন্দোলনরত দলগুলো অংশগ্রহণ করে, তাহলে সরকার প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে সে নির্বাচনে জিততে পারবে। অযথা আরেকটি নির্বাচন করে অর্থ অপচয় করা হবে। মূল বিষয়টি এখনো কোনো রাজনৈতিক মহল বা নেতা নিশ্চিত করতে পারেননি। তা হলো, একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে কিনা এবং সে নির্বাচনটি নির্দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত হবে কিনা, এ কথা উহ্য রেখে বলা যায়-সরকার নির্দলীয় সরকারাধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দিলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবাতাস প্রবাহিত হতে পারে। তা না হলে আবার আন্দোলন মোকাবিলা করে সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করবে। আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রপ্রেমী দলগুলো প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনীর নির্যাতন মোকাবিলা করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে কিনা সেটি দেখার বিষয়।
ডামি-স্বতন্ত্রের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দেশপ্রেমিক বিবেকবান নাগরিকদের মাঝে সরকারদলীয় গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি এবং নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বয়কটকারী দলগুলোর জনগণের মাঝে গ্রহণযেপাগ্যতা বেড়েছে। একটি দল তার ন্যায়সংগত দাবি থেকে জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে সরে দাঁড়ালে সে দলের জনপ্রিয়তা বাড়ে না। সকালে এক কথা আর বিকালে সে কথা থেকে সরে দাঁড়ানোর নীতি চর্চা করে বাংলাদেশে দু-একটি বড় দলের জনপ্রিয়তা আজ প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপি যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পেরেছে। কারণ, এ কথা সবাই বিশ্বাস করেন, ভালো নির্বাচন করতে হলে বিরাজিত বাস্তবতায় দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্বাচন নির্দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে। আর বিএনপি সে দাবিতে অটল থাকতে পেরেছে। শত প্রলোভন এবং নির্যাতনও দলটিকে তাদের ন্যায্য দাবি থেকে টলাতে পারেনি। বিভিন্ন রকম টোপ দিয়ে শত চেষ্টা করেও দলীয় ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। নির্বাচনের আগেই আড়াই মাসে ২৫ সহস্রাধিক বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার এবং লাখ লাখ বিএনপি নেতাকে মামলার আসামি করেও দলটির নেতাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবির আন্দোলন থেকে সরানো যায়নি। এ ক্ষেত্রে একদিকে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, অন্যদিকে বিএনপির প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন বেড়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশের মতো একটি সম্ভাবনাময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটকাল অতিক্রম করছে। এ সংকট মোকাবিলায় সরকারকে অধিকমাত্রায় ঋণনির্ভর হতে হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে দুর্নীতি কমাতে না পারায় বিদেশে টাকা পাচার হয়ে গেছে। মানি লন্ডারিং এবং অর্থ লুটপাটকারীদের দৃশ্যমানভাবে শাস্তি দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেটবাজি রোধে ব্যর্থ সরকার সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেনি। এ সবকিছু থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দেশকে গণতান্ত্রিক পথে আনার চেষ্টা করতে হবে। এর বিকল্প নেই। এ জন্য মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আসতে হবে। আর এমন সরকার ক্ষমতায় বসাতে নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। স্মর্তব্য, রাজনীতি হলো একটি দেশের মস্তিষ্ক বা স্নায়ুকেন্দ্র। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের চিকিৎসা অবহেলা করে পায়ের আঙুলের চুলকানির চিকিৎসা করে মুক্তিযুদ্ধের গণতাস্ত্রিক চেতনা পুনরুজ্জীবিত করা যাবে না। রাজনৈতিক আন্দোলন বা সরকারবিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বিবেচনার মধ্যে যথার্থতা বা বাহাদুরি নেই। কৃতিত্ব নেই বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে মৃতপ্রায় করে একদলীয় কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার মধ্যে। বিএনপির নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবির মধ্যে কোনো অযৌক্তিকতা নেই। অথচ সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে বিএনপিকে ‘দেশ ধ্বংসের মাস্টার প্ল্যানে তৎপর’ বলে উল্লেখ করেছেন (যুগান্তর, ১ মার্চ, ২০২৪)। রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত হবে, চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানের পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্য উপায়ে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : সাবেক সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com