সময়ের কাঠগড়ায় উচ্চশিক্ষার মান
বিমল সরকার
প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এমএ পাশ-কথাটা শুনতে বেশ ভালোই লাগে। একই ভাবে এমএসসি, এমকম (হালের এমবিএস), অনার্সসহ মাস্টার্স অর্জন খুব আনন্দ আর গর্বেরই কথা। সরকারি-বেসরকারি, এমপিওভুক্ত অথবা এমপিওবিহীন, খণ্ডকালীন আর চুক্তিভিত্তিক-যে স্তরেরই হোক, আজকাল কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরিরত শিক্ষকদের মধ্যে দু-দশজন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী শিক্ষক নেই, এমনটা বোধ করি ভাবনার অতীত। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস, সংস্থা বা সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের কথা এখানে আর না-ই বা উল্লেখ করলাম।
থাকবে না-ই বা কেন। উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণের সুযোগ-সুবিধা তো এখন আর কম নয়। দেশে ৫৮টি পাবলিক ও ১১৩টি বেসরকারি মিলে মোট ১৭১টি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অন্তত ১৭০টি কলেজে মাস্টার্স পড়ার বন্দোবস্ত রয়েছে (এছাড়া মোটামুটি সবার জানা ও বহুল আলোচিত একটি বিষয় হলো, অনার্স পড়ানো হয় প্রায় ৯০০; অন্তত ৮৮২টি কলেজে)। কিন্তু খানিকটা পেছনে ফিরে তাকালে, এমনকি স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরের কয়েকটি বছরের কথা মনে করলেও বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে যেতে হয়। তাহলে এই ছিল উচ্চশিক্ষা দান গ্রহণের পরিবেশ পরিস্থিতি, তথা বাস্তবতা আমাদের দেশে! লেখাটির গৌড়চন্দ্রিকা বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় আমি দুঃখিত। প্রিয় পাঠকদের ধৈর্যের বাঁধটি থাকতে থাকতে মূল বক্তব্যে প্রবেশ করি।
১৯৬৩ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে আনন্দমোহন কলেজে (স্থাপিত ১৯০৮) বাংলা ও ইতিহাস বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। পরের বছর (১৯৬৪) কলেজটি সরকারিকরণ হয়। অনার্স চালুর দশ বছর পর ১৯৭৩ সালে উল্লিখিত বিষয় দুটিতে মাস্টার্স কোর্সও খোলা হলে বৃহত্তর ময়মনসিংহবাসীর ভাগ্যের দরজা খুলে যায়। প্রথমবারের মতো ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এমএ (বাংলা ও ইতিহাস) পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া; সামান্য কথা নয়। সামান্য কথা হবে কীভাবে, কেবল কি বৃহত্তর ময়মনসিংহ? টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ঢাকা (বর্তমানের ৭ জেলা) ও বৃহত্তর ফরিদপুর (বর্তমানের ৫ জেলা) অর্থাৎ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর অঞ্চলের সতেরোটি (১৭) জেলার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একমাত্র আনন্দমোহন কলেজেই (১৯৭৩ সাল পর্যন্ত) মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর পড়া ও পড়ানোর বন্দোবস্ত ছিল। এ ১৭ জেলার (দেশের বলতে গেলে এক-চতুর্থাংশ এলাকা) মানুষের প্রথম ৬৩ বছর (১৮৫৭-১৯২১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরের ৫২ বছর (১৯২১-১৯৭৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আর কোথাও মাস্টার্স পড়ার সুযোগ ছিল না। এমন কঠিন বাস্তবতা এখনকার প্রজন্মকে কি বলে বিশ্বাস করানো যাবে, নাকি তা সহজে বিশ্বাস করার মতো কথা?
নদনদী বহমান। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইতোমধ্যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। মাস্টার্স তথা উচ্চশিক্ষার উদ্যোগ-আয়োজনের কথা সংক্ষেপে আগে খানিকটা ব্যক্ত করা হয়েছে। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবলিক ও প্রাইভেট) বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো আছেই, শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থী প্রতিবছর মাস্টার্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে। আগের তুলনায় অভাবনীয় তো বটেই, অনেকের কাছে তা অবিশ্বাস্য বলেও মনে হবে। বড় শহর, ছোট শহর (জেলা বা উপজেলা), এমনকি ইউনিয়ন স্তরের কলেজেও এখন মাস্টার্স পড়ার বন্দোবস্ত আছে। ফলে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, এমনকি বলতে গেলে বাড়িতে বাড়িতে আজকাল মাস্টার্স পাশ বা উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী মিলবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯২১ সালে। রাজশাহী ১৯৫৩ আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৯৬৬ সালে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগ পর্যন্ত দেশের ডিগ্রি স্তরের সবকটি কলেজ ছিল উল্লিখিত তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২২০টিসহ সারা দেশের আনুমানিক ৪৫৫টি ডিগ্রি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়) অধীনতা থেকে মুক্ত করে নতুন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। আর তখন থেকেই আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি যাবতীয় দুর্ভাবনা এবং দুর্বিষহ বিপত্তির সূচনা। সবার জন্য উচ্চশিক্ষার এক অবারিত বন্দোবস্ত (!) করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে উচ্চশিক্ষার দেখভালের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে না করতেই নতুন নতুন কলেজের অনুমোদন দেওয়া ও কলেজে কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খুলে দিয়ে উচ্চশিক্ষাটাকে একেবারে ছেলের হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু মান বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যে উচ্চশিক্ষা মানুষের কাছে ছিল এক আরাধ্য বস্তু; সেটিকে দিনে দিনে দেখতে দেখতে সবার সামনে কীভাবে সস্তা পণ্য বানিয়ে ফেলা হলো! স্বাধীনতার অব্যবহিত পর অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর আগে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ১৭টি জেলার মধ্যে একমাত্র আনন্দমোহন কলেজ ছাড়া আর কোথাও মাস্টার্স পড়ার সুযোগ ছিল না-সেখানে এখন জেলায় জেলায়, বলতে গেলে উপজেলায় উপজেলায় সে সুযোগ। সুযোগ তৈরি হওয়া ভালো; কিন্তু মানের অবনতি হলে তা আর উচ্চশিক্ষা থাকে না। বর্তমানে তা-ই হয়েছে। আমার নিজ জেলায় পাবলিক ও বেসরকারি মিলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত জেলায় ডিগ্রি স্তরে মোট ২৫টি কলেজের মধ্যে ৫টিতে মাস্টার্স ও ১৫টিতে রয়েছে অনার্স পড়ার বন্দোবস্ত। শিক্ষার প্রসারে সারা দেশেরই বলতে গেলে একই চিত্র। যেখানে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, এমনকি ঘরে ঘরে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী। তবে এতকিছু সত্ত্বেও অস্বীকার করা যাবে না যে শিক্ষার মান আজ সময়ের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক