পাকিস্তানের এই নির্বাচনি ফলাফল সমাধান দেবে কি?
জাহিদ হুসেইন
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল নির্ধারক নির্বাচন ছিল। সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে রেকর্ডসংখ্যক ভোটার এবারের নির্বাচনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা জোরালো কণ্ঠে ও স্পষ্টভাবে কথা বলেছেন এবং তাদের রায় দিয়েছেন। এটা ছিল প্রত্যাশা ও গণতন্ত্রের জন্য ভোট। কিন্তু মনে হচ্ছে, জনগণের ম্যান্ডেট আবারও চুরি হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে সবার ভোটের সুষ্ঠুতার বিষয়ে সামান্য হলেও আস্থা ছিল। মানুষ আতঙ্কের দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে এবং ব্যালটের মাধ্যমে তার শক্তি প্রয়োগ করেছে, এ আশায় যে, এতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তরুণ ও নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এবারের নির্বাচন ছিল রাজনৈতিক দমনপীড়ন এবং স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভোট। অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট সেন্টিমেন্টও বেশ স্পষ্ট ছিল। পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ার ভোটের প্রাথমিক ফলাফল এ ইঙ্গিতও দেয় যে, কোনো দলের, বিশেষ করে পিএমএল-এনের পক্ষে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল। যদিও নির্বাচনি এলাকাগুলোয় পিটিআইদলীয় প্রার্থীরাই প্রধানত এগিয়ে ছিলেন। অবিশ্বাস্যভাবে এরপরও চূড়ান্ত ফলাফলে ভিন্নতা দেখা গেছে। অনেক পিএমএল-এন হেভিওয়েট প্রার্থী, যারা গভীর রাত পর্যন্ত পিটিআই দলীয় প্রার্থীদের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিলেন, পরদিন সকালে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। কীভাবে এমন আশ্চর্যজনক পরিবর্তন ঘটেছে, তা যে কেউ অনুমান করতে পারবেন। তবে খাইবার পাখতুনখোয়ার ঘটনাটি ছিল ভিন্ন, যেখানে ফলাফল খুব বেশি পরিবর্তন করা যায়নি। পিটিআই তাদের মূল ঘাঁটিতে নিজেদের অবস্থান ঠিকই ধরে রেখেছে।
এটিই অবশ্য প্রথম নয়, পাকিস্তানের মানুষ ভোটের ফলাফলে রাতারাতি রহস্যময় পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আমরা তা দেখেছি। এর পুরোটাই নির্ভর করেছে, সেই সময়ে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের পছন্দের কে ছিল, তার ওপর। আগের নির্বাচনে পিটিআই যে ‘হ্যান্ড অফ গড’র প্রধান সুবিধাভোগী ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এবার যা ঘটেছে তেমন নজির কমই আছে। বড় ধরনের ভোটের ক্ষেত্রে এ ধরনের অনিয়ম আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলাদাভাবে পাকিস্তানের নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি অনিয়মের যেসব দাবি উঠেছে, তার তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। তবে নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে জোরালো বিবৃতি এসেছে জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে, যিনি পাকিস্তানে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাচনসংক্রান্ত সমস্যাগুলো ‘সাংবিধানিক আইনি কাঠামোর মাধ্যমে’ সমাধানের জন্য দেশটির সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সাধারণত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো কর্মকর্তার এ ধরনের মন্তব্য বিরল ঘটনা। আন্তর্জাতিক মহলের এ বিবৃতিগুলোকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা এর মাধ্যমে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উপলব্ধিই স্পষ্ট হচ্ছে। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় কারচুপির সঙ্গে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জড়িত থাকার বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে, যার ছাপ সর্বত্রই স্পষ্ট। অনিয়মের দাবি ওঠার পরও পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পরবর্তী জাতীয় পরিষদে একক বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু পিটিআই যেহেতু সংসদীয় দল হিসাবে স্বীকৃত নয়, তাই এ দলটি নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত প্রায় ৭০টি আসন পাবে না। তাই কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য দলটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করতে পারবে না। তদুপরি, নিরাপত্তা সংস্থার ভয়ভীতি এবং অশ্ব-বাণিজ্যের (যেখানে রাজনীতিকরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি করে, যা দুপক্ষকেই সুবিধা প্রদান করে) মুখে দলটির ঐক্য ধরে রাখা কঠিনই হবে।
ইতোমধ্যে সব গণতান্ত্রিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে দেশটিতে নতুন ধরনের পাওয়ার প্লে (রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীকে বশ করতে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব কৌশল অবলম্বন করা হয়) শুরু হয়েছে। যে খেলার নাম বলা হচ্ছে ‘হুইলিং অ্যান্ড ডিলিং’। এটি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা স্বার্থান্বেষীদের একত্রিত করেছে। পাঞ্জাবে পিএমএল-এনের শক্ত ঘাঁটিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়া সত্ত্বেও তিনি চাইছিলেন নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করতে। লাহোরের নিজ নির্বাচনি এলাকায় শরিফের সাফল্য বিতর্কিত হলেও খাইবার পাফতুনখোয়ার মানসেহরা জেলার একটি নির্বাচনি এলাকায় তিনি অপমানজনকভাবে পরাজয় বরণ করেছেন। তিনি চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন; কিন্তু পিএমএল-এন (পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হওয়ায় বিষয়টি এখন তার জন্য আরও কঠিন করে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে। এখন জাতীয় পরিষদের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হওয়া পিপিপির (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) সঙ্গে একটি চুক্তি করতে পারলেই দলটি ক্ষমতায় আসতে পারে।
নির্বাচন-পরবর্তী বক্তৃতায় নওয়াজ শরিফ স্বতন্ত্রসহ সব প্রধান দলকে নিয়ে ঐক্যের সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি নিয়ামক পদ্ধতির কথাও বলেছেন। এটা শুনতে ভালোই লাগছে; কিন্তু তা বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য ছাড়া কিছুই নয়। সেনাপ্রধান পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তার জন্য ‘যৌথ সরকার’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। একজন সেনাপ্রধানের পক্ষে এমন রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়াও বিরল ঘটনা। কোনো দেশে কোন ধরনের সরকার থাকতে হবে তা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বলা সামরিক বাহিনীর কাজ নয়। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার সমীকরণে সেনাবাহিনীর মতো নিরাপত্তা সংস্থার গভীর সম্পৃক্ততায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটি উদীয়মান বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের বিষয়ে ইঙ্গিতই দেয়। এটা পরিষ্কার যে, রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দেশটিতে প্রত্যাশিত নিরাপত্তা বাহিনীর আধিপত্য জোরদার হওয়ার আশঙ্কা রয়েই গেছে। নওয়াজ শরিফ ও সেনাপ্রধান যে ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন, তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করা যাবে না। নির্বাচনি অনিয়মের এ ধরনের অভিযোগ দেশকে আরও অস্থিতিশীল করেছে।
এরই মধ্যে পিএমএল-এন এবং পিপিপির মধ্যে আলোচনা শুরু হলেও একটি স্থিতিশীল প্রশাসনিক জোট গঠনের কাজটি সহজ হবে না। পিএমএল-এন নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি সমর্থন দেখানোর সময় পিপিপি ভবিষ্যৎ প্রশাসনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। পিপিপি নিজেকে বাইরে রাখলে সম্ভবত পিএমএল-এনের নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হতে পারে।
যে বিষয়টি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে তা হলো, বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পাওয়া নানা ধরনের ফলাফল। পিএমএল-এন পাঞ্জাব প্রাদেশিক বিধানসভায় বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। পিটিআই-স্বতন্ত্র প্রার্থীরা খাইবার পাখতুনখোয়ার আসনগুলোতে জয়লাভ করেছে। এর ফলে প্রদেশটিতে তাদের সরকার গঠনের দাবি আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে সরকার গঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে দলটিকে বাধা দেওয়ার যে কোনো পদক্ষেপ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহজে সমাধানযোগ্য নয়। এজন্য অবশ্যই দেশটিতে একটি নিরাময়যোগ্য উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে তা শুধু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই ঘটতে পারে।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকা থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস
জাহিদ হুসেইন : পাকিস্তানি লেখক ও সাংবাদিক