অবারিত গণহত্যায় ফিলিস্তিনে শান্তি অধরা
সুধীর সাহা
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পশ্চিম এশিয়ায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যে যুদ্ধটা বর্তমানে চলছে, তার মতো এত নৃশংস ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ওই অঞ্চলে আগে কখনো হয়নি। হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে। আর মৃত ও আহতদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিক। অনিবার্যভাবেই অনেকগুলো প্রশ্ন উঠছে-ইসরাইলকে আক্রমণ করার আগে হামাস কি আন্দাজ করেনি যে, উলটো দিক থেকে কতখানি প্রতিক্রিয়া আসবে? হামাস কি জানত না, ইসরাইলি বাহিনীর ধ্বংসশক্তি হামাসের তূলনায় অনেক বেশি? সবকিছু জেনে-বুঝে, ঝুঁকি এবং লাভ-ক্ষতির হিসাব বিচার করেই কি তারা যুদ্ধে নেমেছে? নিরীহ ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুগুলোও কি তাদের হিসাবের মধ্যেই ছিল?
পাওয়ার প্লের নিয়মানুযায়ী, ইসরাইল হামাসকে ধ্বংসের নামে গাজাসহ সর্বত্র যাকেই শত্রু মনে করছে, তাদেরই ওপর গোলাবর্ষণ করছে। গাজার মানুষ বিদ্যুৎহীন, চিকিৎসাহীন, খাদ্যহীন থেকে শুধু রক্ত দিয়ে যাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে রেফারির ভূমিকায় থাকা জাতিসংঘ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে কেবল হুইসেল বাজিয়েই যাচ্ছে। ইসরাইলের পাশে আছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাই ইসরাইলের থামার কোনো লক্ষণ নেই-মানুষ মরছে, তো মরছেই!
ফিলিস্তিন সমস্যা আজকের নয়। এ সমস্যা বহু পুরোনো। সেই কবে হিটলার গোটা বিশ্বে ইহুদিদের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে খুন করেছিল। এ প্রেক্ষাপটে হাজার বছর ধরে যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত ইহুদিরা খুঁজে পেয়েছিল ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র। শিক্ষা-দীক্ষা, চেতনা, সমৃদ্ধি, বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা ইসরাইলিরা সামরিক শক্তিতে যখন সবল হয়ে দাঁড়াল, তখন তারা চাইল তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আরও বিস্তৃতি। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা চাইল তাদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র। ফলে সংঘাত একসময় অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ইসরাইল নাছোড়বান্দা। তাদের যা চাই, পুরোপুরি চাই। তাদের গাজা চাই, পশ্চিম তীর চাই। ছোট্ট অংশে গাদাগাদি করে নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের গোটা ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করাই যেন ইসরাইলের সমর নায়কদের লক্ষ্য।
১৯৯৩ সালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন আর পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের সদিচ্ছায় ফিলিস্তিনে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। ইসরাইল মেনে নিয়েছিল আরাফাতের সরকারকে, আর আরাফাত মেনে নিয়েছিলেন ইসরাইলকে। স্বাক্ষরিত হয়েছিল অসলো চুক্তি। এ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইয়াসির আরাফাত ও আইজাক রবিনকে যৌথভাবে দেওয়া হয়েছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার। কিন্তু এরপরই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়ে শান্তিবিরোধী উগ্রবাদী ইহুদিদের হাতে মরতে হলো ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনকে এবং উগ্রবাদী ফিলিস্তিনিরা শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার জন্য কাঠগড়ায় তুলল ইয়াসির আরাফাতকে। অসলো চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর করে যেতে পারলেন না তারা দুজনেই। এমন আবহে ফিলিস্তিনে ধর্মকে হাতিয়ার করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ২০০৭ সালে তারা গাজায় ক্ষমতাসীন হতে সমর্থ হয়। কিন্তু ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল শুধু টিকেই থাকল না, উত্তরোত্তর শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিলেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।
ইসরাইল প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানচর্চায় অত্যাধুনিক হলেও মানসিকতায় আজও মধ্যযুগীয় ও অতীতমুখী। অন্যদিকে, মার্কিন ও ব্রিটিশ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে সবসময়ই ইহুদি বণিকদের ভূমিকা প্রশ্নহীন। আজ পর্যন্ত আমেরিকায় এমন একটি সরকারও আসতে পারেনি, যারা ইহুদিদের আধিপত্যকে অস্বীকার করে স্বাধীন নীতি গ্রহণ করতে পেরেছে। শুধু ব্যতিক্রম ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে তিনি আপসহীন ছিলেন। কিন্তু আরাফাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনের দায়িত্ব পড়ে মাহমুদ আব্বাসের হাতে। আব্বাস আরাফাতের মতো ব্যক্তিত্ববান নন। তিনি শুধু বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। তার দুর্বলতার জন্য সশস্ত্র হামাস বলবান হয়ে ওঠে। তারপরই ভেস্তে যায় শান্তি প্রতিষ্ঠার রাস্তা। এর পরিবর্তে মাথাচাড়া দেয় হিংসা। থেমে যায় শান্তির পথ।
গাজা ও ইসরাইলের সংঘর্ষ এবার যেন দেখিয়ে দিল গণহত্যা কাকে বলে! এ সংঘর্ষ দেখিয়ে দিল প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, রাষ্ট্র বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের নৃশংসতার সামনে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিন্দা প্রস্তাব আনা তো দূরের কথা, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও অনেক রাষ্ট্রই সম্মতির ভোট দিতে চাইল না। বিবেকবান কোটি নাগরিকের মাথা নিচু হলেও সেই নাগরিকদের রাষ্ট্রগুলো পাচ্ছে না বিন্দুমাত্র লজ্জা, আত্মধিক্কার। হামাসকে শিক্ষা দেওয়ার নামে ফিলিস্তিনিদের জীবনে নেমে এসেছে মৃত্যুবোমা। কেন গাজায় পানি, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলো? কেন হাসপাতালে হাজার হাজার যুদ্ধাহত শিশু-যুবা-বৃদ্ধ? সারা পৃথিবী আজ যেন অন্ধ হয়ে গেছে এ যুদ্ধের কারণে। প্রত্যেকে অবশ্য সন্ত্রাসের পক্ষ নিয়েই কথা বলছে। কেউ এদিকের, কেউ ওদিকের। কেউ বলছে, হামাসের হানা যখন হয়েছে, ইসরাইলের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? কেউ বলছে, এ সংকট ধর্মের। ধর্মের দোহাই দিয়েই হামাসের সঙ্গে থাকতে হবে। এ দুপক্ষের টানাটানিতে প্রাণ দিচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। হারিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের ন্যায্য দাবির সমর্থন।
‘যে অর্থে ইংল্যান্ড ইংরেজদের দেশ, ফ্রান্স ফরাসিদের দেশ, ঠিক সে অর্থেই ফিলিস্তিন হওয়ার কথা আরবদের দেশ।’ কথাগুলো বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সেই ১৯৩৮ সালে। ইতিহাস বলে, খ্রিষ্টপূর্ব ৭২০ অব্দ থেকেই ইহুদিদের মধ্যে জেরুজালেমকেন্দ্রিক নিজেদের আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার বাসনা ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হওয়ার পর ফিলিস্তিনকে খ্রিষ্টান, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। লীগ অব নেশনসের ম্যান্ডেট অনুযায়ী ব্রিটেন এ অঞ্চলের দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু সেই ব্রিটেনই ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হোমল্যান্ড হিসাবে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতবাদকে সমর্থন করে বসে। মিসরের ফারাওদের অত্যাচারে নির্যাতিত এক ভাসমান গোষ্ঠী হিসাবে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্যত্র শরণার্থীর মতো অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় একে একে যেতে থাকে জেরুজালেমে। এশিয়া ও আফ্রিকা থেকেও ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসে। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রিত বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ইহুদি ফিলিস্তিনে আসায় সেখানকার প্রকৃত বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাস হয় জাতিসংঘে। ১৯৪৮ সালে সৃষ্টি হয় ইহুদিদের জন্য নতুন রাষ্ট্র ইসরাইল। ইহুদিরা তাদের রাষ্ট্র পেলেও আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
কোনটা কার হোমল্যান্ড বা নিজ বাসভূমি, কে কোথায় কেন শরণার্থী, সে বিতর্ক নিয়েই এ পৃথিবী চলছে কয়েক শতাব্দী ধরে। কিন্তু অসংবেদনশীল মানসিকতা এবং অনড় রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তৈরি সংকটের পরিণাম হিসাবে যুদ্ধ আর গণহত্যার এমন ভয়াবহতা এ পৃথিবী এর আগে কখনো দেখেনি, যা আজ দেখছে ফিলিস্তিনে। গাজায় এ মুহূর্তে আর কোনো হাসপাতালেই স্থান খালি নেই। মরছে শিশু, মরছে নারী, মরছে অসহায় নিরীহ মানুষ। ভয়াবহতা দেখে মনে হয়, যে গুণে মানুষ নিজেকে মানুষ বলতে পারে, তা আজ বিপন্ন। গত ৭৫ বছর ধরে বিদ্বেষ আর হিংসার বলি হয়ে দিন পার করছে ফিলিস্তিনিরা। পরিত্রাণহীন সংকটের মুখোমুখি তারা পুরোটা সময় ধরেই। হামাস আর ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে গাজার মানুষের জীবনের মূল্যে।
আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়া হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে দেখতে চায়, ইসরাইলের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষার অধিকার আছে তা বোঝাতে চায়। শুধু দেখতে পায় না, বুঝতে চায় না ফিলিস্তিনিদের জীবনের মূল্য, বাঁচার অধিকার, স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার। তাই জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে রাশিয়া ও চীনের সমর্থিত প্রস্তাবের পক্ষে ১২০টি রাষ্ট্র ভোট দিলেও, মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের ১৮ জন সদস্য যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে প্রস্তাব আনলেও ইসরাইলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের অন্ধ সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিনি নিধনের কাজটি বন্ধ হচ্ছে না। মানুষের জন্য মানুষ, জীবনের জন্য জীবন-এটা অন্য সবার জন্য প্রযোজ্য হলেও ফিলিস্তিনিদের জন্য অন্য ভাবনা, অন্য চিন্তা। যুদ্ধ, বোমা আর ড্রোনের পরিবর্তে অহিংসার পথে কি ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হতে পারে না?
সুধীর সাহা : কলাম লেখক
ceo@ilcb.net