Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আশেপাশে চারপাশে

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা ইস্যু

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা ইস্যু

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নিয়েছেন ১১ জানুয়ারি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টনও হয়ে গেছে এবং তারা কাজ শুরু করেছেন।

বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে এসেছে নতুন মুখ। তাদের অন্যতম হলেন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাছান মাহমুদ আগের মন্ত্রিসভায় পাঁচ বছর তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ড. একে আব্দুল মোমেন। সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হলেও তাকে নতুন মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি।

তথ্যমন্ত্রী হিসাবে হাছান মাহমুদের দায়িত্ব পালন কতটা সফল ছিল, সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তিনি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পাঁচ বছর পার করেছেন। কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন তার দায়িত্ব পালনে সফল ছিলেন বলা যাবে না। তিনি পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কিছু বক্তব্য ও মন্তব্যের কারণে বিতর্কিত হয়েছেন বারবার। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তিনি কিছুই করতে পারেননি। এটাই তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর অনেক বড় দায়িত্ব এসে পড়েছে। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও আরও কয়েকটি পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো যার রেশ আছে। এটা স্বাভাবিক রাখতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’।

বঙ্গবন্ধু এ নীতি ঘোষণা করেছিলেন ১৯৭২ সালেই এবং সেই নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু কেউ যদি আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে, বৈরী আচরণ করে, সেক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বজায় রেখে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি সর্বক্ষেত্রে কার্যকর না-ও হতে পারে।

রোহিঙ্গা সমস্যা

বাংলাদেশের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। তারা দক্ষিণ কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় সাত লাখে। এর আগে থেকেই আরও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিল। তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য কথাবার্তাও হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে; কিন্তু তাদের ফেরত না নিয়ে আরও সাত লাখকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় মিয়ানমার।

সে সময় এদেশে আগত রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ১০ লাখ। গত সাত বছরে তারা এখানে অন্তত দুই লাখ শিশুর জন্ম দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১২ লাখের বেশি। যে হারে রোহিঙ্গারা তাদের জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে, তাতে অচিরেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ লাখে। জনবহুল বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা আমাদের জনসংখ্যার ওপর একটা বিরাট চাপ সৃষ্টি করেছে।

মানবিক কারণে এবং বিশ্ব মোড়লদের অনুরোধে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল সাময়িক সময়ের জন্য। তাদের জন্য ৩৪টি আশ্রয় শিবির তৈরি করে দেওয়া হয়। খাবার-দাবার ও চিকিৎসাও তারা পাচ্ছে। আরামে থেকে তারা শুধু জনসংখ্যাই বাড়াচ্ছে না, দক্ষিণ কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করেছে ব্যাপকভাবে। ওই অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তারা ঘটিয়েই চলেছে অবিরাম।

আশ্রয় শিবিরগুলো হয়ে গেছে মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা মাদকের গুদাম। সেখান থেকে মাদকদ্রব্য সরবরাহ হচ্ছে দেশের সর্বত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব দেখে ও জানে, কিন্তু কিছু করে না বা করতে পারছে না। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

আশ্রয় শিবিরে হানাহানি

আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে হানাহানি চলছে শুরু থেকেই। প্রথম দিকে হানাহানি ব্যাপক ছিল না। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এটা বাড়ছে, প্রাণহানিও হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বই এসব হানাহানির কারণ। আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) ছয়টি সন্ত্রাসী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। আরসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে।

কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাইলে আরসার এজেন্টরা তাদের হত্যা করে। আরসার সঙ্গে আরএসও’র দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই আছে। গত সাত বছরে কয়েকশ’ লোক হানাহানিতে নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে মিয়ানমার মিলিটারি জান্তার এজেন্ট রয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। এজেন্টদের কাজ হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত ও ব্যাহত করা।

পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি

রোহিঙ্গাদের কারণেই দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার আজ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। রোহিঙ্গারা সরকারি আশ্রয় শিবিরের বাইরে জেলার দক্ষিণাঞ্চলে পাহাড়ি এলাকা ও বনাঞ্চলে ঘরবাড়ি তুলছে। এজন্য তারা বিনাবাধায় গাছ কাটছে, পাহাড় কাটছে। গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি তৈরি ও জ্বালানি সংগ্রহের জন্য যে পরিমাণ গাছ কেটেছে, তাতে প্রায় নয় হাজার একর জমির বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। তদুপরি পাহাড়-টিলা কেটে ভূমি সমতল করায় দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকায় ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

রোহিঙ্গাদের হাতে পাসপোর্ট

বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ‘আরসাপ্রধান’ আতাউল্লাহর ভাই শাহ আলিকে উখিয়ার একটি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের এনআইডিসহ গ্রেফতার করা হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। এরপর তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা অবৈধ উপায়ে এনআইডি সংগ্রহ করেছে এবং এসব ঘটনার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিছু অসাধু কর্মচারী জড়িত রয়েছে।

রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্টও সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সে সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছিলেন, বিষয়টি ‘খতিয়ে’ দেখা হচ্ছে। খতিয়ে দেখে তারা কী পেয়েছিলেন তা আজও জনগণ জানে না। তবে রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট যাওয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কত বড় হুমকি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কেউ কথা রাখেনি

মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদের লালন-পালন করেছে, এখনো করছে। শুরুতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা কথা দেয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সব ধরনের সহযোগিতা করবে; কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সাহায্য আসা কমে গেছে। প্রত্যাবাসনের কথাও তারা আর বলে না। প্রথমদিকে বলা হতো, বাংলাদেশও বলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। আন্তর্জাতিক উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বিদেশি মুরব্বিরা এখন আর এটিকে আন্তর্জাতিক সমস্যা বলেন না।

তারা বলেন, এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা। সেভাবেই সমাধান করতে হবে। মিয়ানমার এখন এটাকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ও বলতে রাজি নয়; তাদের দাবি-রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের লোক, বাংলাদেশেই থাকবে, এটি বাংলাদেশের সমস্যা। অথচ ২০১৭ সালের আগে বাংলাদেশে আশ্রিত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নিয়ে রাখাইনে নিজ নিজ বাসস্থানে পুনর্বাসিত করেছিল। এখন তারা সে কথা ভুলে গেছে, কারণ, মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক চাপ এখন আগের মতো নেই।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আশঙ্কা করেন, বিদেশি মুরব্বিরা কোনোদিন হয়তো বাংলাদেশকে বলে বসবে, ‘শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশেই রেখে দিন। দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগ করে নিন। না হলে ওরা যাবে কোথায়?’ যদিও এটা একটি আশঙ্কা মাত্র; কিন্তু যদি কখনো সত্য হয়, আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চলের একটি অংশই রোহিঙ্গারা হয়তো দাবি করে বসতে পারে। অতএব, যে কোনো পরিস্থিতির জন্য সাবধান ও সচেতন থাকতে হবে।

সমাধান কোন পথে?

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান একটাই-মিয়ানমারের এই নাগরিকদের যেভাবেই হোক এদেশ থেকে বিদায় করা। প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানবিকতা দেখানোর সুযোগ আর নেই। বাংলাদেশ ওদের জন্য যথেষ্ট করেছে, অনেক ক্ষতি স্বীকার করেছে। আর নয়। এবার ঘাড়ের বোঝা, যেভাবেই হোক নামাতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।

এখন প্রয়োজন বিশ্ব নেতৃত্বকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার কূটনীতি-যাতে চীন, ভারত ও রাশিয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করে। এ তিন দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। এ তিন দেশ আবার মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষমতাও রাখে।

মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। চীন সক্রিয় ও কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে রাজি করাতে পারে, এজন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যতটা সম্ভব জোরদার করতে হবে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য এটা কঠিন পরীক্ষা; এ পরীক্ষায় তাকে উত্তীর্ণ হতে হবে।

চপল বাশার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম