Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আশেপাশে চারপাশে

নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক অঙ্গনে বছরব্যাপী উত্তেজনা-উত্তাপ এবং জনজীবনে ব্যাপক অশান্তির পর অবশেষে সম্পন্ন হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আওয়ামী লীগ আরও ৫ বছর থাকার সুযোগ পেল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর আগে তিনি ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সরকার পরিচালনা করেছিলেন। সেই বিবেচনায় এবার তিনি পঞ্চমবার সরকারপ্রধান হচ্ছেন।

সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করাই ছিল সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। দেশের ভেতরে বিরোধী শিবিরের নির্বাচনবিরোধী আন্দোলন এবং বিদেশি শক্তির অব্যাহত চাপ মোকাবিলা করেই শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বিঘ্নে। স্থানীয় পর্যবেক্ষক ছাড়াও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি পর্যবেক্ষক এসেছিলেন নির্বাচন দেখতে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেও পর্যবেক্ষক এসেছিলেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচন ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ’ হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর ঢাকায় নিযুক্ত ভারত, রাশিয়া ও চীনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কেউ যাননি বরং নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, সে দেশের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র সোমবার ওয়াশিংটনে বলেছেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হয়নি। তিনি ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে অনিয়ম, সহিংসতা, বিরোধী দলের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে গ্রেফতার এবং নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ না করার কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর পরে অবশ্য আরেক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বিজয়কে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিক্রিয়ায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে বাংলাদেশের প্রতি ওয়াশিংটনের মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। কথাটা সঠিক। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এটাই বড় সাফল্য। ৭ জানুয়ারি সারা দেশে ২৯৯টি আসনে বিকাল ৪টা পর্যন্ত অবাধে ভোটগ্রহণ চলেছে। কোনো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়নি। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের গোলযোগ কোথাও হয়নি। নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, প্রায় ৪২ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট দিয়েছেন। ভোটার উপস্থিতির এ হারকে কমিশন সন্তোষজনক বলেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ভোটের আগের দিন বলেছিলেন, যদি ১ শতাংশ ভোটারও ভোট দেন, তাহলে সে নির্বাচনকে অবৈধ বলা যাবে না।

সিইসির বক্তব্য সঠিক। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ভোটের আয়োজন সুসম্পন্ন করা, ত্রুটিমুক্ত ব্যবস্থাপনা রাখা, যাতে ভোটাররা অবাধে, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়। এ দায়িত্ব ভোটপ্রার্থীদের তথা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রায় ৪২ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিকে খারাপ বলা যাবে না। তবে এটি ঠিক, আগের সংসদ নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের ভোটার উপস্থিতির হার কম।

ভোটার উপস্থিতি কম কেন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হলো কেন? এর অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং এর সমমনা কিছু রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জন। এসব দলের সমর্থক-ভোটাররা ভোট দিতে আসেননি তা ধরে নেওয়াই যায়। দ্বিতীয়ত, বিএনপিসহ সমমনারা নির্বাচন বর্জনের জন্য যেভাবে আন্দোলন ও প্রচার চালিয়েছে, তাতে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়া নিরাপদ মনে করেননি। বিশেষ করে ভোটের আগের দুদিন হরতাল ডাকা, ট্রেনে-বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আতঙ্কিত মানুষ ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, গত একটি বছর, বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর দেশে যেরকম রাজনৈতিক হানাহানি, সহিংসতা ও নাশকতা হয়েছে, তা জনগণকে রাজনীতির প্রতি নিরুৎসাহিত করে তুলেছে। ভোটের প্রতিও তারা আকর্ষণ হারিয়েছেন কম-বেশি। সবশেষে আরেকটি বিষয় মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলেছে। সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য মধ্যবিত্ত, নিুবিত্ত ও দরিদ্র মানুষকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে ভোটের আকর্ষণ কতটা থাকবে? তাদের কাছে রাজনীতি ও নির্বাচন অর্থহীন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। জনগণ রাজনীতিবিমুখ হলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না।

সন্দেহ নেই, এবারের নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে ভালো হয়েছে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। কারণ, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। সে ঘটনা মনে রেখে এবার আওয়ামী লীগ নিজ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহিত করেছিল। এ কারণে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এটি রেকর্ড। একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, সেই নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগের রাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে বাক্স ভর্তি করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন এবার তাই ভোটগ্রহণের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠিয়েছে, যাতে রাতে ভোট দেওয়ার অভিযোগ না থাকে।

ঢাকা-১ আসনে অবাঞ্ছিত ঘটনা

সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন এবারের নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকা-১ আসনে সংঘটিত সন্ত্রাস, সহিংসতা ও অনিয়ম। এ আসনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ক্যাডারদের সন্ত্রাসের কবলে পড়েন। সব ধরনের সন্ত্রাস ও অনিয়ম ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনের প্রায় সব কেন্দ্রে হয়েছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেই আসনে নির্বাচনের ফল মেনে নেননি। তিনি পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয় সেটাই দেখার বিষয়। নির্বাচন কমিশনকে আরও কঠোর হতে হবে, অন্যথায় প্রশ্ন উঠবে।

নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ

অনেক চ্যালেঞ্জ ও বিদেশি চাপ অতিক্রম করে শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সামনে এখন রয়েছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি হচ্ছে, তার জনপ্রিয়তাকে ধরে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া এবং জনজীবনের সংকট দূর করা। অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি এখন জনগণের জন্য প্রধান সমস্যা। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে। বাজারে সিন্ডিকেটের দাপট ও আধিপত্যের কথা গত দু’বছর ধরে শুনে আসছি। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কোনো ফল হয়নি। নতুন সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যদি আনতে পারেন, সেটাই হবে বিরাট সাফল্য।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম