Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দেশপ্রেমের চশমা

আবারও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন!

Icon

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর ২০২৪-এ অভিনব ও বিরোধিতাহীন নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল বিতর্কিত নির্বাচনের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করল। দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ওই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে সরকারদলীয় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে ভোটারদের কাছে নির্বাচনটি গুরুত্ব হারায়। কোন দল নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে সে বিষয়টি নির্বাচনের আগে নির্ধারিত হয়ে গেলে তেমন নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ থাকে না। চট্টগ্রামে থাকায় দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা আমাকে দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনের দিন প্রকাশের জন্য ওই নির্বাচনের ওপর একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতে অনুরোধ করে। আমি রাজি হই এবং লেখাটি জমা দিলে তারা পত্রিকার ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সংখ্যায় ‘একটি নিকৃষ্ট নির্বাচন’ শীর্ষক মন্তব্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট দশম সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। এ নির্বাচনের প্রাক্কালেও জনগণ জানতেন যে নির্বাচনে কোন দল জিতে সরকার গঠন করবে। আবার এ নির্বাচনেও দশম সংসদ নির্বাচনের মতো বিএনপিসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দল অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনটিতে যেভাবে জাপাপ্রধান এরশাদের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে তাকে অসুস্থ বানিয়ে মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল, এবারও তার ছোট ভাই জাপাপ্রধান জিএম কাদেরকেও একই প্রক্রিয়ায় চাপ প্রয়োগ করে আসন ভাগাভাগিতে রাজি করিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হয়। দশম নির্বাচনের প্রাক্কালে বিদেশি কূটনীতিকরা অনেক চেষ্টা করেও সব বড় দলের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করতে পারেনি; দ্বাদশ নির্বাচনেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সব দলকে নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপে বসাতে ব্যর্থ হয়। কাজেই নেতিবাচকতার দিক দিয়ে দুটি নির্বাচনের মধ্যে বেশ মিল রয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমাকে কোনো পত্রিকা এ নির্বাচনের ওপর মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতে অনুরোধ করেনি। নানা কারণে আমি এমন অনুরোধ পাইনি। যদি আমাকে কোনো পত্রিকা ৭ জানুয়ারি প্রকাশের জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ওপর একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতে অনুরোধ করত, তাহলে আমি ‘অভিনব ও নিকৃষ্ট নির্বাচনের হ্যাটট্রিক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখতাম। আমার ধারণা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের চাপের মধ্যে সে প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট পত্রিকা ছাপতে পারত না। দশম সংসদ নির্বাচনের পর ওই নির্বাচনের ওপর আমি ‘অভিনব নির্বাচন অসহিষ্ণু সরকার : দশম সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর’ শিরোনামে একটি বই

লিখেছিলাম। ঢাকার একটি প্রকাশনা সংস্থা সাহস করে বইটি প্রকাশ করেছিল এবং বইটি ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় বিক্রি হয়েছিল। ওই গ্রন্থে আমি দশম সংসদ নির্বাচনের অভিনবত্ব, নেতিবাচকতা এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলাম। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আমি যদি ‘ডামি-স্বতন্ত্রের আসন ভাগাভাগির নির্বাচন : বেকায়দায় সরকার’ শিরোনামে একটি বই লিখি এবং সে বইয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অগণতান্ত্রিকতা ও নেতিবাচকতা উন্মোচন করি, তাহলে কি ওই বই প্রকাশ করতে কোনো প্রকাশক সাহস করবে? সে বই কি ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায় বিক্রি করা সম্ভব হবে? সম্ভব না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি মনে হয়। কারণ, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের পর প্রকাশকরা ঝুঁকিপূর্ণ পাণ্ডুলিপি ছাপতে চায় না। এ কারণে লেখালেখির স্বাধীনতা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে।

সরকারি দল জানত যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে ভোটারদের ভোট বর্জনের আহ্বান জানালে সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। সেজন্য সরকারদলীয় নেতারা নিজ দলের মধ্য থেকে সনাতনী নির্বাচনি প্রথা ভেঙে একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচনে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেন। সৃষ্টি করেন ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী। সুযোগ দেন স্বদলীয় এমপিদের পদত্যাগ না করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে। এর ফলে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দল সৃষ্টির জন্য অনেক নাটকীয়তার পর জাপার সঙ্গে ২৬ আসনে ছাড় দিয়ে আঁতাত করে। ফলে প্রচারণা শুরু হওয়ার পর এ ২৬ প্রার্থীর নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সরকারদলীয় ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মারামারি, খুনাখুনি শুরু হয়। ঘটে সন্ত্রাস ও হতাহত হওয়ার মতো ঘটনা। শুধু ভোটকেন্দ্রে লোক সমাগম ঘটাতে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় যুগপৎ আওয়ামী লীগ ও জাপায় অন্তর্জ্বালা ও আত্মঘাতী গৃহদাহের সূচনা হয়। ২৬ আসনের আওয়ামী লীগের সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের কুরবানি দিয়ে জাপাকে সরকারের সমর্থন দেওয়ায় ওইসব সরকারদলীয় প্রার্থীর যে হৃদয়জ্বালা সৃষ্টি হয়, তা নির্বাচনের পরও প্রবহমান থেকে দলীয় ব্যবস্থার অভ্যন্তরে নাজুক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পরে জাপা মাত্র ১১ আসনে পেয়ে এ আসন ভাগাভাগিকে সরকারের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসাবে উল্লেখ করে।

৭ জানুয়ারির নির্বাচন ‘ইনক্লুসিভ’ হয়নি। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া কিছু নামসর্বস্ব দল এবং জাপার অংশগ্রহণ ছিল। তারা ২৮৩ আসনে প্রার্থী দিয়ে ২৬ আসনে সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। বাকি ২৫৭ আসনের জাপা প্রার্থীদের কুরবানি দেওয়ায় ওইসব প্রার্থীর মনের অবস্থা পড়লে অনুধাবন করা যায় তারা দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি কতটা ক্ষুব্ধ। গোড়া থেকেই জাপাপ্রধান জিএম কাদের নাটকীয় কথাবার্তা বলে নির্বাচনি মাঠে রহস্যময়তা সৃষ্টি করেন। প্রথমে দলটি বলে, তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে এককভাবে নির্বাচন করবে। পরে ২৬ আসনে সমঝোতায় আসে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এতে যুক্তিপ্রবণ ও বিবেকবান দেশপ্রেমিক নাগরিকদের মাঝে দলটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তারা তাদের নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অনড় থাকায় জনগণের মাঝে দলটির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। নির্বাচনের পর দলটির দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারেনি। হাজার হাজার বিএনপি নেতাকে গ্রেফতার করেও তাদের ‘ন্যায্য’ দাবি থেকে নড়াতে পারেনি। বিএনপি এবং গণতন্ত্রমনা দলগুলোর আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলনরত দলগুলো তাদের দাবির প্রতি গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে। চীন, ভারত, রাশিয়া এবং আরও দু-চারটি দেশ বাদ দিলে গণতান্ত্রিক দেশগুলো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বীকৃতি দেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দেশগুলো এ নির্বাচনকে মানসম্পন্ন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সনদ দেয়নি। জাতিসংঘও আলোচ্য নির্বাচন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত বর্তমানে ওয়াশিংটনভিত্তিক রাইট টু ফ্রিডমের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম বি মাইলাম দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও অধিকার লঙ্ঘনের মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বাইডেন প্রশাসন এবং কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানাব বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সব সম্পর্ক পর্যালোচনা করার।’ জাতিসংঘের

মানবাধিকারবিষয়ক

হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎকে ‘হুমকির মুখে’ উল্লেখ করে বাংলাদেশকে ‘বর্তমান গতিপথ পরিবর্তন করে একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানান।’

পশ্চিমা দেশগুলোর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে। এখন দেখার বিষয় পরপর এমন বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের পর ত্বরিত গতিতে সরকার গঠন করে গণতান্ত্রিক বিশ্বের অসহযোগিতার মধ্যে কতদিন ক্ষমতাসীন দল সে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পারে। স্মর্তব্য, এর আগের দুটি প্রহসনের নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে এবার বাংলাদেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্ব তীব্রভাবে সক্রিয়। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগের যে সূচনা করে, তা সম্প্রতি আরও প্রসারিত করতে পারে। জাতিসংঘ এবং পরাশক্তিধর গণতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করে তাদের রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের পথ থেকে নিবৃত্ত করতে প্রয়াস নেবে। হয়তো সরকারকে একগুঁয়েমি পরিহার করে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করে আরেকটি অংশগ্রহণমূলক অগ্রিম নির্বাচনের ঘোষণা দিতে সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করবে। দেখার বিষয়, নিকৃষ্ট নির্বাচনের হ্যাটট্রিকের পর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক বিশ্বকে অবজ্ঞা করে একলা চলো নীতি অবলম্বন করে, নাকি গণতান্ত্রিক বিশ্বের যৌক্তিক অনুরোধ আমলে নিয়ে আন্দোলনরত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিপীড়ন বন্ধ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সমঝোতার পথে এগোয়।

 

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : সাবেক সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম