Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভোটার উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নির্দেশক

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তাই এ নির্বাচন আইনগত বৈধতা পেলেও অংশগ্রণমূলক হওয়ার আখ্যা থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের দেশের মানুষ বরাবরই নির্বাচনমুখী ছিলেন। তারা ভোটের দিনকে উৎসব হিসাবেই পালন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু গত দেড় দশকে সেই উৎসাহে ভাটা পড়েছে। এমনকি সাধারণ মানুষ ভোট ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা হারিয়েছেন বললেও অত্যুক্তি হবে না। মানুষের এ মানসিক পরিবর্তনের জন্য কারা দায়ী তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু যে-ই দায়ী হোক না কেন, বাস্তবতা হলো দিন দিন মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছেন। আর ভোট যেহেতু রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনারই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, তাই তাদের এ অনাগ্রহ। গত এক বছরে যেকটি উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে ভোটার উপস্থিতি ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। সুতরাং, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী দলের সমর্থক উভয়ই এখন ভোটবিমুখ। খুব বড় ধরনের পরিবর্তন ছাড়া সাধারণ ভোটারের এ মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হবে না।

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ নির্বাচন একটি অপরিহার্য শর্ত। এ নির্বাচনের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ তাদের স্বার্থের অনুকূলে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। তবে হ্যাঁ, আজকের যে গণতন্ত্রের সংস্কৃতি, তাতে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নির্বাচন করা কতটা সম্ভব তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। তারপরও প্রচলিত ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি সাধারণ নির্বাচনের প্রয়োজন। আমরা পাকিস্তান আমলের পুরো সময়টাই কাটিয়েছি সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবিতে লড়াই-সংগ্রাম করে। এর ধারাবাহিতায় অর্জিত হয়েছে লাখো শহিদের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।

গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের মাচে। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে। এরপর গণতান্ত্রিক ধারায় ব্যাঘাত ঘটে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক সরকারের অধীনে। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে। ওই নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। মেয়াদ শেষ করে নির্বাচনের আগেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ অপরাপর দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলে। কিন্তু বিএনপি সরকার সেই দাবি উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফাভাবে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। কিন্তু নির্বাচন থেকে বিরত থাকা বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়কের দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সেই মোতাবেক ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ২১ বছর পর সরকার গঠন করে।

১৯৯৬ সালের তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে, তাতে সাধারণ মানুষের মুক্তি নিশ্চিত না হলেও প্রচলিত ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থার প্রতিফলন ঘটে। সেই আলোকেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিএনপি পরাজিত করে সরকার গঠন করে। সাধারণত কোনো নির্বাচনে পরাজিত দল ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে থাকে, তা সূক্ষ্মই হোক আর স্থূলই হোক। কিন্তু সাধারণ ভোটাররা তা গ্রহণযোগ্যই মনে করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপিকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরই নির্বাচনি ব্যবস্থা নাটকীয় মোড় নেয়। যে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাজপথ উত্তপ্ত করেছিল, সেই আওয়ামী লীগই তা প্রত্যাখ্যানের উদ্যোগ নেয়। সে সময়ে আদালত তার এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে সংবিধানের পরিপন্থি বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু অনেকেই এ রায়কে আওয়ামী লীগ দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে করেন। এ মনে করার পেছনে কারণটি হলো, রায়ের অপর অংশটিকে বিবেচনায় না নেওয়া। এ রায়ের আরেকটি অংশ ছিল চাইলে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নেওয়া যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে কর্ণপাত করেনি। সেই থেকে আওয়ামী লীগের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।

অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করতে থাকে। সরকারি দল সেই দাবি উপেক্ষা করে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সম্পন্ন করে দশম সাধারণ নির্বাচন। বিএনপি তাতে অংশগ্রহণ করেনি। একতরফা সেই নির্বাচনের ৫০ শতাংশ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। টিকে রইল নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সেই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর দিয়েই অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সমালোচকরা ও পরবর্তীকালে খোদ নির্বাচন কমিশন একাদশ নির্বাচনকে ‘রাতের ভোট’ বলে আখ্যায়িত করেছে, যে কারণে ভোটব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমে গেছে। তারা মনে করছেন, সরকার পরিবর্তনে কিংবা সরকার বহালে তাদের ভোটের কোনো প্রয়োজন নেই, নেই কোনো গুরুত্ব। তারা না আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন, না বিএনপিকে ভরসা করতে পারছেন। এক রাজনৈতিক অভিভাবকহীনতার মধ্য দিয়ে চলেছেন সাধারণ মানুষ। এর থেকে সহসা মুক্তির সম্ভাবনা কম।

বিরোধী দলের ভোট বর্জন সত্ত্বেও আজকের নির্বাচনকে আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে অবৈধ বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, শাসকগোষ্ঠী দেশের আইনগুলো এমনভাবে তৈরি করে থাকে, যা তাদের ক্ষমতাকে পোক্ত করে। যেহেতু আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে ক্ষমতাসীনরা, তাই ক্ষমতাহীনদের স্বার্থ এক্ষেত্রে বরাবরই উপেক্ষিত হয়। আজকের ক্ষমতাহীনরা যদি কোনোদিন ক্ষমতাসীন হয়, তাহলেও একই চিত্র পাওয়া যাবে। সেই অর্থে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে বৈধ নির্বাচনই বলতে হবে। তবে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি যে নির্বাচন করেছিল তা-ও সাংবাধিনকভাবে বৈধ ছিল। কিন্তু তারপরও বিএনপি সরকার টিকে থাকতে পারেনি। ৪ মাস পর আবারও নির্বাচন দিতে হয়েছিল। সেরকম পরিস্থিতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য এটি সম্পূর্ণই নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক সক্ষমতার ওপর। আগেই বলেছি, সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, অন্যদিকে একইভাবে বিএনপির ওপরও ভরসা করতে পারছে না। তাই আওয়ামী লীগকে বাইরের চাপটাই বেশি মোকাবিলা করতে হবে। বিএনপিবিহীন নির্বাচনকে আংশিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতেও প্রধান চ্যালেঞ্জটা হবে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের সন্তোষজনক উপস্থিতি। এ উপস্থিতিই হতে পারে নির্বাচনের গুণগতমানের একটি পরিমাপক। ভোটে রাজশক্তির ব্যবহার না হলেও নির্বাচনটি কিছুটা অনুকূল দৃষ্টি পেতে পারে। বিএনপি মাঠে নেই, তারপরও নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা দেশ ১৫৬টিরও বেশি সংঘাতে তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এটি ভালো লক্ষণ নয়; দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের বাস্তবতা।

নির্বাচনের পরের সময়টা আমাদের জন্য সুখকর হবে বলে মনে হয় না। বিএনপির সামনে আর কোনো পথ নেই। একমাত্র পথ হলো রাজপথে আন্দোলন করা। তাতে সফলতা কতখানি আসবে তার চেয়েও বড় কথা হলো, রাজনীতি ও অর্থনীতি অস্থিতিশীল হবে। এক হিসাবে দেখা গেছে, আমাদের দেশে ১ দিনের হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচিতে দৈনিক গড়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, হরতাল বা অবরোধের দায় থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কেউ মুক্ত নয়। আমরা সব সময়ই বলে থাকি, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের শাসকরা কোনো না কোনোভাবে বাইরের শক্তির ওপর তাদের নির্ভরশীল করে ফেলেছে। ফলে নামে-বেনামে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বাইরের প্রভাব আমাদের প্রভাবিত করে। যদি নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সে ধরনের কোনো প্রভাবের ছায়া আমাদের অর্থনীতিতে পড়ে, তাহলে তা হবে বিপজ্জনক।

আমাদের রপ্তানিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে হলে সমঝোতার রাজনীতিই প্রত্যাশিত। রাজনীতিতে বৈরিতা থাকলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হয় অর্থনীতির, সেই সঙ্গে ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের। সেই ভোগান্তিরই কি ইঙ্গিত দিচ্ছে আজকের নির্বাচন?

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম