নির্বাচন-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধসহ নানামুখী সমস্যায় বৈশ্বিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রায় পর্যুদস্ত। ফলে বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি এবং ডলার-জ্বালানি সংকটে জনজীবন ওষ্ঠাগত।
বিরাজমান এ বিশ্বমন্দা ও ডলার সংকট কেটে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। অধিকন্তু বিশ্ব রাজনীতি জটিল থেকে জটিলতর রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। এ সংকট খুব শিগ্গির দূরীভূত হওয়ার নয়। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণসংকট বিদ্যমান ডলার সমস্যাকে আরও তীব্র ও দীর্ঘায়িত করছে।
বাংলাদেশেও ডলার সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার, পণ্য আমদানি-রপ্তানি, রাজস্বসহ কোনো সূচকেই সন্তোষজনক অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নানা কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে ১ হাজার ৬৭৫ কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে। দেশের মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতায় ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজারে ডলারের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রারও সংকট তৈরি হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা কর্মকৌশল অবলম্বন করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছে না। বছরব্যাপী মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯ শতাংশের বেশি হওয়ায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও অর্থনীতির বেশকিছু সূচকের অবনমনের চিত্র স্পষ্ট। সামগ্রিকভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন প্রতিরোধের চেষ্টায় কতিপয় বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডের ফলে নিরীহ মানুষের প্রাণহানিসহ বিনষ্ট হচ্ছে দেশের মূল্যবান সম্পদ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের জীবনপ্রবাহ। গণমাধ্যম সূত্রমতে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ। এ হিসাব অনুযায়ী অক্টোবরে মোট রপ্তানি কমেছে ১২৪ কোটি ডলার। এ ছাড়াও চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর শেষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ৩৯২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। বিগত অর্থবছরে একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ৮৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও লক্ষ্য পূরণের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
তারল্য সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে চলছে দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তঃব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকায়। তন্মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার করা হয়েছে ৫৫ হাজার ৮৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি রেকর্ড।
একই দিনে কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২১ সালের জুনে তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে এটি কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকায়। তারল্য সংকট সত্ত্বেও ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় ২১ হাজার কোটি টাকা বেশি।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শ্রেণিকৃত ঋণের হার হয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২২ সালের একই মাসে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। বর্তমানে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সাম্প্রতিককালে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের অপতৎপরতায় দেশের অর্থনীতিকে মোটামুটি সচল রাখা পোশাকশিল্পে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা লক্ষ করা গেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে যুক্ত করে কতিপয় সুযোগসন্ধানী পোশাকশিল্পেও অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করছে। বিগত কয়েক মাস ধরে পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ঢাকার দুটি বিশেষ অঞ্চলে নারকীয় তাণ্ডব, শিল্প কারখানায় আক্রমণ, গণপরিবহণ ভাঙচুরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কতিপয় শ্রমিক নামধারী উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির মারমুখী আচরণ এ শিল্পকে ধ্বংসের অশুভ পাঁয়তারা ছাড়া কিছুই নয়।
দেশে হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেও নানা কৌশলে পোশাক কারখানাগুলো চালু থাকলেও ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সময়মতো কাপড়-এক্সেসরিজের পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কমেছে পোশাকের উৎপাদন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, একের পর এক হরতাল-অবরোধে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
হঠাৎ করেই বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছে ২৫-৩০ শতাংশ এবং পোশাকের মূল্যও কমিয়ে দিয়েছে ২০-২৫ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দা ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে ৪০-৪৫ শতাংশ ব্যবসা হারিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘পোশাকশিল্প খাতের উদ্যোক্তারা অতীতেও নানা রকম সংকটে পড়েছেন। তবে এখন একসঙ্গে যতগুলো সংকট এসেছে, তা অতীতে কখনো মোকাবিলা করতে হয়নি শিল্প মালিকদের।
দুটি যুদ্ধ চলছে এখন বিশ্বে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। বাইরের এ ধরনের সংকট এলে আমরা ঠেকাতে পারবো না। তবে অভ্যন্তরীণ যেসব সংকট তৈরি হয়েছে পোশাক শিল্পে, আমরা সেগুলোর দ্রুত সমাধান চাই। আমরা রাজনৈতিক অস্থিরতা চাই না, হরতাল-অবরোধ চাই না। এসব শিল্পের ক্ষতগুলোকে আরও গভীর করছে। তাই আমি মনে করি, দেশের স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে সংকটগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে রিজার্ভ-রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ছাড়াও রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হবে। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাই হবে নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন যেহেতু আর বিশেষ কোনো নীতি সংস্কার হবে না, তাই নির্বাচনের পর দ্রব্যমূল্য, মুদ্রার বিনিময় হার এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হারে মনোযোগ দিতে হবে। দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি। খেয়াল রাখতে হবে, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংক বা কোনো খাতে যেন কাঠামোগত সংকট দেখা না দেয় এবং বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়।
দেশের অধিকাংশ ব্যাংকই এখন রীতিমতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চলছে। কিছু ব্যাংক অনেক আগেই তাদের পুরোপুরি সক্ষমতা হারিয়েছে। প্রয়োজনে অনেক ব্যাংককে অন্যদের সঙ্গে একীভূত কিংবা গুটিয়ে ফেলতে হবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সরকার আইএমএফ ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে যেসব সংস্কারের শর্তে ঋণ পাচ্ছে, নির্বাচনের পর সেগুলো বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বিজ্ঞজনদের মতে, বড় ধরনের কোনো সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা হবে কঠিন। এটি নির্ভর করছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে একটি ভালো নির্বাচন আবশ্যক। নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে, তার ওপর অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।
অর্থনৈতিক সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না। নানা ধরনের অপপ্রচার ও নিষেধাজ্ঞার হুমকিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখার উদ্দেশ্যে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই কাম্য। নির্বাচনকেন্দ্রিক সব বিরূপ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নিরাপদ ও অহিংস পরিস্থিতি তৈরি একান্তই বাঞ্ছনীয়। জনগণের রায়কে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করাই হবে প্রার্থীদের পবিত্র দায়িত্ব।
উদ্ভূত যে কোনো সমস্যার সমাধানে সহিংস কার্যক্রম পরিহারে যৌক্তিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতাই হয়ে উঠুক অন্যতম নির্বাচনি ব্রত। ধর্ম-বর্ণ-দল-মত-অঞ্চল নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক নিজের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করে একটি সুন্দর নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, এটিই প্রত্যাশিত। সব অপতৎপরতাকে সংহার করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অধিকাংশ সদস্যের রায়ে পরবর্তী সরকার গঠনই সত্যিকার অর্থে সম্ভাব্য সমাধান।
নানামুখী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে এর দেশি-বিদেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সরকারের গ্রহণযোগ্যতায় এবং পরবর্তী রাজনীতি-অর্থনীতিতে। জনগণের ভাগ্য নিয়ে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশের নাগরিকরা তা মেনে নেবে বলে মনে করি না।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়