অনলাইনে বিচরণে সতর্ক হোন
সালাহ্উদ্দিন নাগরী
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
বেশ কিছুদিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো প্রভাব-প্রতিপত্তি, ধনসম্পত্তি, নারীর রূপ লাবণ্য, নতুন নতুন জামা-কাপড় ও গয়নাগাটির ছবি প্রদর্শনের জায়গায় পরিণত হয়েছে। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, ছবি তোলার স্টুডিও থেকে কোনো নারীর ছবির প্রিন্টআউট যার ছবি তাকে বা তার বাবা/ভাই ছাড়া আর কাউকে দেওয়া হতো না। আর এখন অনেকেই কারণে-অকারণে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ত্রী, কন্যা, প্রেমিকার ছবি পোস্ট করছেন, পাবলিক করছেন।
স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে যাকে-তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধু বানাচ্ছেন। সেই বন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করছেন, স্পর্শকাতর বহু বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন। যখন-তখন রাতবিরাতে কল করছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছেন। এতে করে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক অনেক বিষয়-আশয় প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে সহজসরল মানুষকে নানা প্রতারণার জালে, মানহানিকর পরিস্থিতিতে ফেলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত আরও নানা ঝুটঝামেলা বাড়ছে।
আমাদের দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়েরা পরস্পরের প্রেমে পড়ছে। আর এ প্রেম-ভালোবাসার মোহে তারা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকেও আমাদের দেশে প্রিয়জনের কাছে ছুটে আসছে। বিয়ে করে মিডিয়ায় সুখী দাম্পত্য জীবনের সাক্ষাৎকারও দিচ্ছে। কিন্তু দুই, চার, দশদিন অবস্থান করে নববিবাহিত স্ত্রী/স্বামীকে তার দেশে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে এবং ঘর-সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে চলে যাচ্ছে এবং পরে আর কোনো খোঁজখবর রাখছে না। শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রেম, পরিণয়। এ ধরনের ঘটনা একটি বা দুটি নয়, অহরহ ঘটছে। আর এ বিষয়গুলো ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ফেসবুকে বিভিন্ন চিন্তা, চেতনা ও সম্পর্কের মানুষজন একে অন্যের বন্ধু। ১৭/১৮ বছরের একজন তরুণের তার সমবয়সিদের পাশাপাশি ৮০ বছরের একজন বৃদ্ধও তার বন্ধু। ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে বয়স ও প্রকৃত সম্পর্কের পার্থক্যটি অনেকে আমলে না নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন, ছবি আপলোড করছেন, এতে একেকজন একেকভাবে সেই পোস্টটি বিবেচনা করছেন। ফলে অনেক সময় পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ-ভালোবাসার জায়গাটি ওলটপালট ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। বাস্তব জীবনের বন্ধুর সঙ্গে যে কথা শেয়ার করা যায়, সেটা তো ভিন্ন প্রজন্মের ফেসবুক বন্ধুর সঙ্গে পারা যায় না। প্রত্যেকের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে কিছু না কিছু প্রাইভেসি থাকতেই পারে এবং থাকা উচিতও।
অনেক সময় প্রোফাইল পিকচারে দেশিবিদেশি নায়িকা-মডেলের ছবি ব্যবহার করে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পাঠানো হচ্ছে, আর অনেকেই কোনো কিছু খতিয়ে না দেখে সেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করছে। আজকাল ছেলেরা মেয়ের নাম দিয়ে আর মেয়েরা ছেলের নাম দিয়ে ফেসবুক আইডি তৈরি করছে এবং প্রয়োজনমতো সেসব ব্যবহার করে ফায়দা লুটে নিচ্ছে।
ফেসবুকের কিছু কিছু আইডি দেখলেই বোঝা যায় এগুলো ফেক (নকল), বিশেষ উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে। ওই ধরনের আইডির প্রোফাইল পিকচার ও কভার ফটো হিসাবে ব্যবহৃত ছবিগুলো যথাযথ বলে মনে হয় না। ওসব আইডিতে যেসব বিষয় পোস্ট করা হয় তা-ও আপত্তিকর। আর ওই ধরনের আইডি থেকে আসা ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ অনেক সচেতন ব্যক্তিও অ্যাকসেপ্ট করছে। শুদ্ধাচারী ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের তালিকায় ফেক আইডিধারীদের নাম দেখে অন্যরাও ওসব বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করছে। এক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতন মানুষও কেমন জানি বোধহীন হয়ে যাচ্ছেন! আর ভুয়া আইডিধারীরা তো তা-ই চায়, অপেক্ষা করতে থাকে মাহেন্দ্রক্ষণের, সুযোগ বুঝে ভাব জমিয়ে আম-ছালা সবই লুটে নেয়।
আমাদের দেশের নারী-পুরুষের কাছে অন্যান্য দেশের অনেকের কাছ থেকে অহরহ ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ আসে। ওইসব বিদেশির প্রোফাইল ঘাঁটলে বন্ধু তালিকায় দু’একজন বাংলাদেশি ছাড়া তাদের দেশের বা সমাজের কারও নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন কথা হলো, শুধু দু’-চারজন বাংলাদেশিই কেন সেই বিদেশির বন্ধুত্বের তালিকায়? তাদের কি নিজস্ব কোনো সার্কেল নেই? হাজার হাজার মাইল দূরের দেশের কারও কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর কারণ কী? এ ধরনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার আগে আমাদের মাথায় কি এ বিষয়গুলো উঁকি দেয় না? এগুলো চিন্তায় না আনলে পদে পদে প্রতারিত হতে হবে।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এক যুবকের। এরপর তাদের সম্পর্ক প্রেমে রূপ নেয়, এক পর্যায়ে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে নানা কারণ দেখিয়ে ছেলেটির কাছ থেকে মেয়েটি ৮০ লাখ টাকা নেয়। তারপর মেয়েটি হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। প্রেমিক প্রবর পরে বুঝতে পারেন, তিনি ইতোমধ্যে প্রতারণার শিকার হয়ে গেছেন।
কয়েকদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্র ঢাকার একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন-এক তরুণীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পরিচয় হয়। তারপর তাদের মধ্যে কথাবার্তা হতো এবং এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের ডিসেম্বরে একটি রেস্টুরেন্টে তারা দেখা করেন। এরপর রিকশায় ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে ওই তরুণী জানায় তার বাসা এখন ফাঁকা, কেউ নেই এবং তাকে (তরুণ) সে (তরুণী) তার বাসায় নিয়ে যেতে চায়। তরুণ রাজি হলে তারা বসুন্ধরার এক বাসায় যায়। ওই বাসায় পৌঁছামাত্র অপেক্ষমাণ দুষ্কৃতকারীরা তার হাত-পা বেঁধে ফেলে। চাঁদার দাবিতে তার বাবার কাছে ছবি পাঠায় এবং বিকাশের মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলে। এমনকি চাঁদা না পেলে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। এই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের পরিণতি!
ফেসবুকে প্রেম, অতঃপর বিয়ে এবং বিয়ের পর পাচারকারীর হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হবিগঞ্জ জেলার এক ব্যক্তির সঙ্গে টিকটক ভিডিও তৈরির সুবাদে পাবনার এক তরুণীর পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, এক পর্যায়ে ছেলেটি মেয়েটিকে নিয়ে সাতক্ষীরা সীমান্তপথে ভারতে নিয়ে কলকাতায় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে।
এ ধরনের অঘটন রোধে আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? অবশ্যই আছে। চ্যাটিং, ফোনালাপ ও ভিডিও কলে খুব সংযত থাকতে হবে। এখন ফোনালাপ ও অবচেতন মুহূর্তে ভিডিও রেকর্ডকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের হাতিয়ারে পরিণত করা হচ্ছে। প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে ভান করা মানুষটি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে খোলামেলা ছবি ও ভিডিও চাইছে, যা পরবর্তীকালে দরকষাকষির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। উঠতি বয়সের অনেক মেয়ে তো এমন আশঙ্কায় আত্মহত্যাও করেছে। এসব উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হুমকিতে পড়া ছাড়াও এর মাধ্যমে অপরাধীদের সাইবার অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। সাইবার অপরাধ বা কম্পিউটার অপরাধ এমন একটি অপরাধ, যা কম্পিউটার এবং কম্পিউটার নেটওয়ার্কেও সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে কারও ব্যক্তিগত ছবি, শ্লীলতাহানি চেষ্টা করার ছবি অথবা অডিও বা ভিডিও এবং অনলাইনে ই-কমার্সের নামে ভুয়া পেজ খুলে নিম্নমানের পণ্য বিক্রয় করে ঠকানোসহ যাবতীয় অপকর্ম, প্রতারণা, হয়রানি সাইবার ক্রাইমের আওতাভুক্ত। অর্থাৎ অসৎ উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংঘটিত যে কোনো কার্যক্রমই সাইবার অপরাধ।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে সাইবার ক্রাইম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ, ২০১৯ সালে যা ছিল ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্তদের বেশির ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে আক্রান্তদের অধিকাংশ কমবয়সি হলেও সাইবার জগতে বয়োজ্যেষ্ঠরাও নিরাপদ নয়।
সম্প্রতি অনলাইনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর ক্ষতিকর দিকগুলো বিশ্বমানবকে এক কঠিন চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, ওয়েবসাইটগুলোতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কোনো কোনো অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে নারীদের তাদের ছবিতেই নগ্ন করা যাচ্ছে। ‘গ্রাফিকা’ নামক একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক অ্যানালাইসিস কোম্পানির সমীক্ষায় দেখা যায়, শুধু গত সেপ্টেম্বর মাসেই প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এমন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে এই কাণ্ড করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এ ছবিগুলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়গুলো অসম্মতিমূলক পর্নোগ্রাফির অংশ, যা ডিপফেক পর্নোগ্রাফি নামে পরিচিত। কেতাবি ভাষায় ডিপফেক হলো-‘দেখতে বাস্তবসম্মত, কিন্তু নকল বা কিছুটা পরিবর্তিত কনটেন্ট, যা ভিডিও বা অডিও উপাদান সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়।’
আসলেই অসম্মতিমূলক এসব পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটের একটি ক্ষতিকর বিষয় হয়ে উঠেছে। মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তো ডিপফেক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে জনৈক অভিনেত্রীর ডিপফেক অডিও ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ তো এত কিছু বোঝে না। কিছু দেখলে বা শুনলে সেটাকেই সত্য বলে মেনে নেয়। কিন্তু এর সবই প্রযুক্তির অপব্যবহারের অনিবার্য ফল এবং মিথ্যা ও বানোয়াট।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে বর্তমানে আমরা একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে বসবাস করছি। এতে করে বিশ্ববাসীর পরস্পর যোগাযোগ দ্রুত ও সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ইন্টারনেটনির্ভরতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই অনলাইনে অসংযত আচরণের জন্য নানা ধরনের বিপর্যয় ও দুঃখজনক ঘটনাগুলো বাড়তে পারে। এ প্রেক্ষাপটে নিজের করণীয়টুকু নির্ধারণ করতে হবে, মনের মধ্যে এই বোধ ও বিবেক জাগিয়ে তুলতে হবে যে, আমার দ্বারা কেউ যেমন প্রতারিত হবে না, ঠিক একইভাবে আমিও কারও দ্বারা প্রতারিত হবো না। সবার সতর্ক পদক্ষেপই অনলাইনে স্বস্তিকর বিচরণের একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : কলাম লেখক
snagari2012@gmail.com