আশেপাশে চারপাশে
জীবনের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে
চপল বাশার
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর রাজপথে সমাবেশ, মিছিল, পদযাত্রা নতুন কিছু নয়। আগেও হয়েছে। এখনো হচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুতে। কিন্তু গত ২৩ ডিসেম্বর শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যে সমাবেশ ও পরে পদযাত্রা হলো, তা এককথায় অভূতপূর্ব। সমাজের সর্বস্তরের বিভিন্ন পেশার কয়েক হাজার মানুষ সেদিন সমবেত হয়েছিলেন শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা ও বিভিন্ন আকারের ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ডাকে ওই সমাবেশ-পদযাত্রা হয়নি। প্রতিবাদী সমাবেশ ও পদযাত্রাটি ছিল সন্ত্রাস-নাশকতার বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে। প্রতিবাদী মানুষদের প্রধান স্লোগান ছিল ‘নাশকতাকে না’।
২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশে যানবাহন ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের যে নাশকতা ও সন্ত্রাস চলছে ধারাবাহিকভাবে, তার প্রতিবাদেই ছিল শনিবারের সমাবেশ-পদযাত্রা। পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহু সংগঠনের মিলিত উদ্যোগে এ প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন ছাড়াও কিছু প্রতীকী উপস্থাপন পদযাত্রাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
সম্প্রতি তেজগাঁও রেলস্টেশনে ঢাকাগামী একটি ট্রেনে আগুন দেওয়ায় তিনটি বগি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এতে ট্রেনের পাঁচজন যাত্রী পুড়ে মারা যান। তাদের মধ্যে দুজন মা ও শিশু। হতভাগ্য নারী তার শিশুসন্তানটি বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন এবং ওই অবস্থায় আগুনে দগ্ধ হন। ট্রেন থেকে নামতে পারেননি। শনিবার আগুনে দগ্ধ মা ও শিশুর একটি কালো স্ট্যাচু তৈরি করে রিকশা-ভ্যানে রেখে মিছিলে বহন করা হয়।
তিনজন বয়স্ক পুরুষ তাদের শরীরে আগুনে পোড়ার ক্ষত রং দিয়ে এঁকে স্ট্রেচারে শুয়েছিলেন। আর একজন অগ্নিদগ্ধ মানুষের শরীর সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো ছিল। তাদের মিছিলের সঙ্গে বহন করে নিয়ে যান স্বাস্থ্যকর্মীরা। এসব প্রতীকী উপস্থাপন অগ্নিসন্ত্রাসের নৃশংসতা ও ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলে।
প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগঠন, ছাত্র, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংস্কৃতিক কর্মী, অভিনয়শিল্পী, সাংবাদিক, আইনজীবী, নারী সংগঠন, ক্রীড়াবিদ, আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। মিছিলের শেষপ্রান্তে ছিলেন হিজড়াদের সংগঠনের বেশকিছু সদস্য। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত সুশৃঙ্খল সুসজ্জিত মিছিলটি ছিল সন্ত্রাস-নাশকতার বিরুদ্ধে দেশবাসীর প্রতিবাদের প্রতীক।
নাশকতার টার্গেট বাস, ট্রেন
২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশে গোলযোগের পর বিএনপি ও সহযোগী দলগুলো সারা দেশে অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচি দেওয়া শুরু করে। প্রতিটি অবরোধের ব্যাপ্তি ছিল ৪৮ ঘণ্টা। এ পর্যন্ত ১৩ বার অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয়। অবরোধের পাশাপাশি হরতালও ডাকা হয়। হরতালগুলো জনগণের সাড়া পায়নি, জনজীবন স্বাভাবিক ছিল। অবরোধ দিয়েও কাজ হয়নি, রাজধানীসহ সর্বত্র সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। শুধু রাতের বেলা দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ বা সীমিত ছিল। কারণ এ বাসগুলোই ছিল নাশকতার টার্গেট। বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী ট্রেনও রাতে বা ভোরে অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়।
দমকল বাহিনীর দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশে ২৮৭টি মোটরযান পোড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ১৬০টি যাত্রীবাহী বাস, ৬০টি ট্রাক এবং অন্যগুলো পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান ও গাড়ি। এছাড়া ১৩টি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাতেও আগুন লাগানো হয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেন ও রেলপথেও নাশকতার ঘটনা ঘটে। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে সুপরিকল্পিতভাবে রেললাইনের বিরাট অংশ কেটে ফেলা হয়। এতে ইঞ্জিনসহ একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা অন্যান্য স্থানেও ঘটেছে।
রেলপথে নিরাপত্তা
রেলপথে নিরাপত্তাব্যবস্থা হিসাবে কর্তৃপক্ষ পাঁচটি এক্সপ্রেস ট্রেনের রাত্রিকালীন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেনের কামরায় ক্যামেরা লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে নাশকতায় লিপ্ত দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা যায়। ক্যামেরা বসানোর ব্যবস্থা কতটা হয়েছে বা আদৌ হচ্ছে কিনা জানা যায়নি। তবে পুরো রেলব্যবস্থা ক্যামেরার আওতায় রাখা উচিত ছিল অনেক আগেই। এখন বিপদ ঘটে যাওয়ার পর ক্যামেরার চিন্তা মাথায় এসেছে। রেলওয়ে রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদ। তদুপরি হাজার হাজার যাত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্নও আছে। রেলওয়েকে নিরাপদ রাখার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সতর্কতা জরুরি।
রেলপথে নাশকতা চালানো হয় রাতের অন্ধকারে। তাই বলে রাতে ট্রেন চলাচল বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়। রাতে যাতে দুর্বৃত্তরা রেললাইনের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য পর্যাপ্ত আলো ও সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক কারণে যেহেতু দেশে এখন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, নাশকতার আশঙ্কা বেড়েছে, তাই রাতে রেলপথ পাহারার বিশেষ ব্যবস্থা দরকার। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের রেলপথ অতিদীর্ঘ নয়। আমাদের রেলপথের আশপাশে গ্রাম, জনপদ, জনবসতি রয়েছে। পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ ছাড়াও রেলপথের কাছে বসবাসকারী জনগণের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
জনগণের সম্পৃক্ততা চাই
আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে দলের কমিটি ও সংগঠন রয়েছে। যেসব ইউনিয়নের উপর দিয়ে রেললাইন গেছে, সেসব এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রেলপথ রক্ষার দায়িত্ব নিতে পারেন। এজন্য অবশ্য দলের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ প্রয়োজন হবে। এটা যদি করা যায়, তাহলে রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষায় জনগণের সম্পৃক্ততা গড়ে উঠবে।
দুই মাস ধরে দেশে যে নাশকতার তাণ্ডব চলছে, তাতে প্রাণহানি ছাড়াও সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়েও এ ধরনের নাশকতা ও অগ্নিসন্ত্রাস চলেছিল দীর্ঘসময় ধরে। এতে প্রায় দুইশ মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই নির্বাচনও বিএনপি ও তার সহযোগীরা বয়কট করেছিল। ২০১৪ সাল এবং এ বছরের নির্বাচনকালীন নাশকতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকেই সরকারপক্ষ দায়ী করেছে। নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কিছু লোক গ্রেফতার হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করেছে। আটক ব্যক্তিরা সবাই বিএনপিদলীয়।
নাশকতা ও জঙ্গিবাদ
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হিসাবে রয়েছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। মৌলবাদী জঙ্গিরা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বড় ধরনের হামলা চালিয়ে ১৩ বিদেশিসহ ২৪ জনকে হত্যা করে। দেশে জঙ্গি হামলার সেটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে-পরেও জঙ্গি হামলার বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের পর জঙ্গি তৎপরতা এখন স্তিমিত। কিন্তু নিষ্ক্রিয় নয়। ২০১৪ সালে এবং বর্তমানে দেশজুড়ে যে নাশকতা ঘটেছে ও ঘটছে, তার সঙ্গে জঙ্গিদের তৎপরতার মিল পাওয়া যায়।
নাশকতা ও জঙ্গিবাদ উভয়ই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, টাকার এপিঠ-ওপিঠ। বিশেষজ্ঞরা নাশকতা তথা সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন দেখা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রুস হফম্যান সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটা সহিংসতা বা তার মতোই গুরুত্বপূর্ণ সহিংসতার হুমকি, যা একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধন বা সেই লক্ষ্যে ব্যবহৃত ও নির্দেশিত।’ একইভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য লুইস রিচার্ডসন বিশ্বাস করেন, সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সহিংসভাবে বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করে।’ বিশেষজ্ঞদের এ সংজ্ঞাকে বিবেচনায় নিলে স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশে অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা জঙ্গিবাদেরই আরেকটি রূপ।
জঙ্গিবাদ দমনকে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গি দমনে বিশেষ বাহিনী ও সংস্থা গঠন করা হয়েছে এবং তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। এ কারণে দেশে জঙ্গি থাকলেও তারা মাথা তুলতে পারছে না। জঙ্গিদের যেভাবে দমন করা হয়েছে বা হচ্ছে, ঠিক সেই উদ্যম ও উদ্যোগ নিয়ে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের দমন করতে হবে। জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য নাশকতা দমনকেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com