Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

খাদ্য নিরাপত্তায় সাফল্য ধরে রাখতে হবে

Icon

ড. মো. জামাল উদ্দিন

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খাদ্য নিরাপত্তায় সাফল্য ধরে রাখতে হবে

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ‘ফুডফ্লুয়েন্সার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। অসামান্য কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য বারিকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রোটিনের জন্য দ্রুত ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে যারা তাদের কর্মজীবনকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য উৎসর্গ করে, ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল তথা ইউএসএসইসি সে অঞ্চলের সেরা প্রতিষ্ঠান/প্রার্থীকে এজন্য স্বীকৃতি দেয় এবং পুরস্কৃত করে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা ও যুক্তরাষ্ট্রের সয়া ভ্যালু চেইন আওতাধীন বিশ্বজুড়ে ১৩০টিরও বেশি শিল্প নেতাদের অংশগ্রহণে গত ১২-১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ দুবাইয়ে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ক্রাশকন এবং হাঙ্গারকন এ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সম্মিলিতভাবে বাণিজ্যের অপরিহার্য ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়। টেকসই অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রোটিনের জন্য দ্রুত ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। সম্মেলনে বারি’র পক্ষে পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. আব্দুল্লাহ ইউছুফ আখন্দ ফুডফ্লুয়েন্সার অব দ্য ইয়ার পুরস্কার গ্রহণ করেন। এটি প্রতিষ্ঠানের জন্য তথা দেশের জন্য বড় গৌরবের বিষয়। বারি’র একজন বিজ্ঞানী হিসাবে আমি এ খবরে গর্বিত!

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সংক্ষেপে ‘বারি’ দেশের সর্ববৃহৎ বহুফসলভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ২১১টি ফসল নিয়ে বহুমুখী গবেষণা পরিচালনা করে থাকে। উল্লিখিত ফসলের মধ্যে ডাল ও তেলজাতীয় ফসল, সবজি, ফল, কন্দাল ফসল, মসলাজাতীয় ফসল, অপ্রধান দানাজাতীয় ফসল ও ফুল অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানীদের নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা ও সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা এবং সরকারের নীতি-সহায়তায় বারি এ যাবৎ ৬৫০টি ফসলের জাত এবং ৬৪০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে।

গত ৮ ডিসেম্বর গাজীপুরে বাৎসরিক ‘কেন্দ্রীয় গবেষণা পর্যালোচনা এবং কর্মসূচি প্রণয়ন কর্মশালা ২০২৩’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বারি পরিচালক (গবেষণা) ড. ইউছুপ আকন্দের উপস্থাপনা থেকে জানা যায়, বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত ৬৫০টি জাতের মধ্যে কন্দাল ফসলের ১৪২টি জাত, সবজি ফসলের ১৩৬টি (ওপি-১১৩টি এবং হাইব্রিড-২৩টি), ফলের ১০১টি, দানাদার ফসলের ৮৬টি, মসলাজাতীয় ফসলের ৫৫টি, তেলবীজ ফসলের ৫৪টি, ডালজাতীয় ফসলের ৪৪টি, ফুলের জাত ২৫টি এবং সী উইড-এর জাত, অন্যান্য ফসল ১০টিসহ মোট ৬৫০টি ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব জাত খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বারি’র ৬৪০টি প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে ফসল, মাটি, পানি এবং বালাই ব্যবস্থাপনার ২৮৮টি, ফার্মিং সিস্টেম রিসার্চ প্রযুক্তি ১৯৬টি, ফার্ম মেশিনারি প্রযুক্তি ১৫০টি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা ৩৮টি, ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি ৩৪টি, বায়ো-টেকনোলজি ৩০টি এবং নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত প্রযুক্তি ৪টি। এসব প্রযুক্তি ফসলের উৎপাদনশীলতা এবং সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

মানুষের খাদ্য তালিকায় সবজির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এবং সবজির আবাদ এলাকা বৃদ্ধিতে প্রথম স্থান দখল করে আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৭০-৭৪ সালে দেশে সবজির মোট আবাদ এলাকা ছিল ০.০৫ মিলিয়ন হেক্টর। সেটি ২০২১-২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ০.৪৭ মিলিয়ন হেক্টরে। ওই বছরগুলোতে সবজির মোট উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ০.৬ মিলিয়ন টন এবং ২১.৩২ মিলিয়ন টন। সরকারের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভের সূত্রমতে, ১৯৭০-৭৪ সালে মাথাপিছু দৈনিক সবজি গ্রহণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ গ্রাম, সেটি ২০২১-২২ সালে ২০২ গ্রামে দাঁড়িয়েছে। এটি কৃষির একটি সফলতা! পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ফলেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বারি এ পর্যন্ত ৩৮ প্রজাতি ফলের ৯৭টি জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সঙ্গে আলু চাষিদের/উদ্যোক্তাদের সংযোগ বাড়ালে ভ্যালু এডেড পণ্য তৈরির সুযোগ বাড়বে। কচু একটি পুষ্টিমানসমৃদ্ধ ফসল। বারি পানিকচু-১ (লতিরাজ), বারি পানিকচু-২ সারা দেশে সুখ্যাতি অর্জন করে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশে তেলবীজ ফসলের গুরুত্ব অধিক। দেশে তেলবীজের বর্তমান উৎপাদন চাহিদার মাত্র ১২ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। বাকিটা আমদানি নির্ভর। তাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ৪০ শতাংশ বাড়ানোর ওপর সরকারের তরফ থেকে তাগিদ রয়েছে। সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, বাদাম, সয়াবিন, সেফফ্লাওয়ার, লিনসীড, নাইজার এ পেরিলা নিয়ে বারি গবেষণা করে থাকে। বারি’র কৃষি অর্থনীতি বিভাগের এক গবেষণায় বারি উদ্ভাবিত সরিষা জাতের মাঠ পর্যায়ে এডাপশন বা গ্রহণযোগ্যতা গড়ে ৭৬ শতাংশ, সয়াবিনের ৮০ শতাংশ এবং বাদামের ৬৭ শতাংশ বলে জানা যায়। বারি উদ্ভাবিত সরিষার মেগা ভ্যারাইটির মধ্যে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮ সারা দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বারি সরিষা-১৪ ও বারি সরিষা-১৭ স্বল্প জীবনকাল হওয়ায়, আমন-সরিষা-বোরো ফসলধারায় উপযুক্ততার প্রমাণ মিলেছে। বারি সরিষা-১৮ ক্যানোলা মানসম্পন্ন, যার মধ্যে ইরুসিক এসিডের মাত্রা খুব কম যা ১.০৬ শতাংশ। এ জাতের সরিষায় ৪০-৪২ শতাংশ তেল রয়েছে বলে এ জাতটি দিন দিন বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। বারি সূর্যমুখী-৩ ডুয়ার্ফজাতীয় জাত, যার মধ্যে ৪০-৪২ শতাংশ তেল রয়েছে। এটি কিছুটা লবন সহিষ্ণু এবং উপকূলীয় এলাকার জন্য বেশ উপযুক্ত।

জনসাধারণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ডালের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। দেশে মোট ফসলি জমির ২.৩৮ শতাংশে ডালজাতীয় ফসলের আবাদ হয়। দেশে চাহিদার ৪০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে মিটে। ডালজাতীয় ফসলের গবেষণায় বারি সফলতা অর্জন করেছে। বারি এ পর্যন্ত সাত রকমের ডালজাতীয় ফসল থেকে ৪৩টি জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। যার মধ্যে বারি মুগ-৬, বারি মসুর-৮, বারি মটর-৩, বারি ছোলা-১১, বারি খেসারি-৬, বারি মাস-৩ বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মসলাজাতীয় ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনেও বারি এগিয়ে। এ পর্যন্ত ২৬টি মসলাজাতীয় ফসলের ৫৪টি জাত, ১২০টি উৎপাদন প্রযুক্তি ও ৮টি ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে ৫৩৮টি জার্মপ্লাজমও সংগ্রহে রেখেছে। বারি’র সরেজমিন গবেষণা বিভাগের উদ্ভাবিত বসতবাড়ির আঙিনায় বছরব্যাপী বিভিন্ন সবজি উৎপাদনের মডেলগুলো যেমন-কালিকাপুর মডেল, গয়েশপুর মডেল ইত্যাদি পারিবারিক পুষ্টি নিরাপত্তায় বেশ অবদান রাখছে। বারি’র উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তিগুলো কৃষকের দোরগোড়ায় ব্যাপক আকারে বিস্তার ঘটাতে পারলে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা আরও বেগবান হবে। আশা করা যায়, সামনের বছরগুলোতে ‘পার্টনার’ প্রকল্প বারি’র জাত ও প্রযুক্তিগুলো মাঠ পর্যায়ে বিস্তার ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ড. মো. জামাল উদ্দিন : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি

jamaluddin1971@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম