মিয়ানমারের চলমান সংঘাত ও রোহিঙ্গা ইস্যু

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গারা তাদের বাসভূমি মিয়ানমার থেকে স্থানীয় রাখাইন ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর গত ছয় বছরেরও বেশি সময়ে নিজ দেশে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। এখনো রোহিঙ্গারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে মিয়ানমার থেকে বিপৎসংকুল সাগরে ভেসে চলছে নানা দেশের দিকে।
তাদের নেতৃত্ব এ সংকট সমাধানে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে কতটুকু এগিয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর (ইএও) সমন্বিত আক্রমণে পর্যুদস্ত। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত অক্টোবরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। তাদের হামলা শুরু হলে ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সামরিক জান্তা। ন্যাশনালন ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) দেশের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে। তারা কূটনৈতিকভাবে জান্তা সরকারকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। এনইউজি সমর্থিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) কমান্ডে অন্তত ৩০০ ইউনিট রয়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২৭ অক্টোবর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ৪২২টি সেনাঘাঁটি ও সাতটি শহর দখল করে নিয়েছে। এ সমন্বিত আক্রমণে চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য রুট এবং বাণিজ্য ক্রসিং পোস্টগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগসহ এক ডজন টাউনশিপ ইএওগুলোর দখলে এসেছে। বর্তমানে মিয়ানমারের প্রায় ৫২ শতাংশ এলাকা ইএও’র কার্যকর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মিয়ানমারের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ভুলে সবাই একসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে। মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা মিলে জান্তার বিরুদ্ধে চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্সে (সিডিএফ) একত্রে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে লড়াই করছে। সিডিএফ চিন রাজ্যের খ্রিষ্টানদের নিয়ে গঠিত, তবে এতে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী বামার বৌদ্ধরাও রয়েছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা বৈধতার জন্য মিয়ানমারে ধর্মীয় বিভাজনের দিকে ঝুঁকেছে। জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বৌদ্ধধর্মের রক্ষক হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করে বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিভিন্ন জাতিগত এবং ধর্মীয় যোদ্ধারা নিজেদের এক পরিবারের অংশ মনে করে এবং তাদের শত্রু এখন শুধু মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক পটভূমির যুবকরা প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে। তারা একটা আদর্শ মিয়ানমার চায়, যেখানে সব জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান আচরণ, বাক্স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ থাকবে।
মিয়ানমারে বহু দশক ধরে সেনাবাহিনীর প্রতি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন সেনাবাহিনীর মনোবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিভক্তি ও সেনাবাহিনীর প্রতি একতরফা সমর্থন হ্রাসের কারণে অনেক সাধারণ মানুষও সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের সমর্থন থেকে সরে এসেছে। মিয়ানমারের সব ভিক্ষু বর্তমান সেনাশাসন সমর্থন করেন না। এখন বৌদ্ধ মঠগুলোতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে এবং সেখান থেকে অনেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছেন। একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়িয়েছিল। এখন অনেক নেতৃস্থানীয় ভিক্ষু মনে করেন, মা বা থা ভিক্ষুরা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ঘৃণা না ছড়িয়ে রাখাইনের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হলে জনগণের জীবনমানের উন্নতি হতো এবং দেশে শান্তি বিরাজ করত। চলমান প্রেক্ষাপটে ভিক্ষুরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন, তাদের নিজস্ব অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন এবং সীমান্তবর্তী জঙ্গলে ছাত্রদের সঙ্গে অল বার্মা ইয়াং মঙ্কস ইউনিয়ন নামে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধে অংশ নিচ্ছেন। জাতিধর্মনির্বিশেষে সংগঠিত এ সমন্বিত কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলে তা জাতিগত সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে ও রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জান্তা বর্তমানে দেশের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে যুদ্ধরত ইএও’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রাখাইনে অবরোধ আরোপ করেছে। তারা মিয়ানমারের সঙ্গে চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের সীমান্তে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনকে টার্গেট করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তার অবরোধের ফলে বাসিন্দারা ক্রমবর্ধমানভাবে মরিয়া ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের চলাচলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে এবং রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে সব রাস্তা ও জলপথে অবরোধ আরোপ করার ফলে খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য মৌলিক সামগ্রীর অভাবে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। আরাকান আর্মি (এএ) এবং রাখাইনের জনগণ জান্তার ‘ফোর কাট স্ট্র্যাটেজি’র কারণে মানবিক সংকটে রয়েছে এবং ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা চাইছে। রাখাইনের এ পরিস্থিতিতে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় কমিটির একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। মিয়ানমার সরকারের একটি প্রতিনিধিদল ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর কক্সবাজার সফর করেছে। তারা তালিকাভুক্ত আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চলমান রেখেছে। তবে রাখাইনে এ সংকটময় অবস্থা চলতে থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্পের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান মামলায় কানাডা ও ব্রিটেনসহ বিশ্বের ছয়টি প্রভাবশালী দেশ যুক্ত হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় সর্বসম্মতিতে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন তারা।
রোহিঙ্গারা রাখাইন ও মিয়ানমার জান্তা উভয়ের দ্বারাই নির্মম অত্যাচারের শিকার। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের ঘৃণার মনোভাব রয়েছে। এটি দূর না হলে প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। তাই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একটি রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। এনইউজি জানিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবে। এ প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করা। আন্তর্জাতিক আদালতকে সমর্থন প্রদান অব্যাহত রাখা এবং এনইউজির সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনের পতন হলে তারাই মিয়ানমারের বৈধ রাজনৈতিক শক্তি হবে। এনইউজি ক্ষমতায় এলেও রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি এএ এবং এর রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) রাজনৈতিক ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী সংগঠনগুলোর উচিত এ সময়ে এএ ও ইউএলএ’র সঙ্গে তাদের সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া।
বর্তমানে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের হাতে পর্যুদস্ত হচ্ছে; ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে জান্তা সরকার। অতি সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান মামলায় কানাডা ও ব্রিটেনসহ বিশ্বের ছয়টি প্রভাবশালী দেশ যুক্ত হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় সর্বসম্মতিতে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে বলে অনেকে মনে করছেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপে আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর উচিত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা।
মিয়ানমারের এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা এবং তাদের প্রতিনিধিরা রাখাইন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে। বিদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। রাখাইনদের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও এনইউজির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপন ও সমন্বয় জরুরি। আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এআরএনএ) এবং অন্যান্য রোহিঙ্গা সংগঠন এ সংকটময় সময়ে এএ ও এনইউজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের জন্য সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোকেও মিয়ানমারে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক