Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

নির্বাচনের পর অর্থনীতি সামাল দেওয়ার রূপরেখা কী?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচনের পর অর্থনীতি সামাল দেওয়ার রূপরেখা কী?

নির্বাচন তো এসেই গেল। ৭ জানুয়ারি আর বেশি দূরে নয়। প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। এর আগে তারা তাদের আয়-দায়ের হিসাব দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে। সেসব দেখে বোঝা গেল ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই নির্বাচনে লড়ছেন। দেখা যাচ্ছে, তাদের আয়-সম্পদ শনৈঃ শনৈঃ করে বাড়ছে। খুবই ভালো খবর। তবে যে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয় তা হলো, তারা নির্বাচিত হলে আগামী ৫ বছর দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কী করবেন। তারা দেশের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো কী পন্থায় মোকাবিলা করবেন। সামনে পবিত্র রমজান মাস। মাস তিনেক বাকি। ব্যবসায়ী ও চেম্বার নেতারা এখনো অভিযোগ করছেন, তারা আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরছেন। শুধু বড়রা সুবিধা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ। ছোট আমদানিকারকরা ব্যাংকে পাত্তা পাচ্ছেন না। ডলার নেই। ১১০ টাকার ডলার ১২০-১৩০-এও মিলছে না। সবচেয়ে বড় কথা, রমজান মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য, ভোগ্যপণ্য-চিনি, তেল, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর ইত্যাদির জন্য এখনই ঋণপত্র খোলা দরকার। পণ্য আসবে, গুদামজাত হবে, আমদানিকারকদের হাত থেকে পাইকারি বাজারে যাবে, পাইকারদের হাত থেকে খুচরা বাজারে যাবে। অনেক সময় দরকার। ইতোমধ্যেই ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীরা রমজানের সময় পণ্যের দাম কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী রাখা যায়, তার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে কাগজে খবর বেরোচ্ছে। ব্যবসায়ী নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, কারসাজি করলে তারা নিজেরাই লোভী ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেবেন।

পেঁয়াজ, চিনি, আলু নিয়ে বাজার টালমাটাল এখনো। একটার দাম কিছু কমে তো আরেকটার দাম বাড়ে। শীতকাল। এখনই সময় একটু স্বস্তিতে খাওয়া-দাওয়ার। শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ খেয়ে এখনই আরাম। এ সময় এসবের দাম একটু স্থিতিশীল ও সহনশীল থাকে। কিন্তু এবার আর সে অবস্থা নেই। সবজির দামই ৭০, ৮০, ১০০ টাকা কেজি। এদিকে কৃষক পাটের দাম পাচ্ছেন না। হতাশা তাদের মধ্যে। ধান বিক্রিতে মন্দা। কাগজে দেখলাম আশুগঞ্জের আড়তে বেচাকেনা কম। সুনামগঞ্জের পাইকাররা ধান নিয়ে মোকামে আসছেন, কিন্তু ক্রেতা নেই। জায়গায় জায়গায় অসময়ে বৃষ্টি হওয়ায়, আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় রবিশস্য নষ্ট হয়েছে। এ সময়ই আসছে পবিত্র রমজান। মানুষ এমনিতেই এ মাসে আতঙ্কে থাকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত সমস্যা নিয়ে। যেমন থাকে বাজেটের সময়; বন্যা, খরার সময়। চারদিকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। স্বাভাবিক অবস্থার কোনো আলামত নেই। এমনিতেই শীতে মানুষের জীবনে নেমে আসে স্থবিরতা, রোগ-শোক। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার লড়াই। অসহায় মানুষ, নিরুপায় তারা।

এই মহাসংকট, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময়ে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, নির্বাচনে নেমে পড়া প্রার্থীরা সহসা আমাদের জন্য কী করবেন, কী করবেন আগামী ৫ বছর। চেয়েছিলাম তাদের অঙ্গীকারনামা, ঘোষণাপত্র। না তা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি সবার কাছ থেকে। অথচ ক্ষমতায় আরোহণের জন্য সবাই ব্যস্ত। আমরা চাই, প্রার্থীরা বলুন মূল্যস্ফীতি রোধে তারা কী করবেন। দেশবাসী, সাধারণ মানুষের নিরিখে মূল্যস্ফীতি এক নম্বর সমস্যা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ভীষণভাবে ব্যর্থ। ব্যর্থ মন্ত্রীরা আলুর দাম, পেঁয়াজের দাম, চিনির দাম, ডিমের দাম, চালের দাম ইত্যাদি নিয়ে একেক দিন একেক কথা বলছেন। আবার সবাই দোষারোপ করছেন ‘সিন্ডিকেট’র ওপর-পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, মূল্যস্ফীতি রোধে প্রার্থীরা কী মুদ্রানীতি গ্রহণ করবেন, কী রাজস্বনীতি (ফিসক্যাল পালিসি) গ্রহণ করবেন। কী ধরনের হবে তাদের বাণিজ্যনীতি। আর যেহেতু নেতারা বলছেন ‘সিন্ডিকেট’র কথা, তাই জানা দরকার আমাদের এ সর্বনাশী সিন্ডিকেট রোধে প্রার্থীরা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ডলারের অভাবে। বাজারে ডলারের টানাটানি। আবার অসাধু ব্যবসায়ী, হুন্ডিওয়ালারা বিদেশে ‘ওয়েজআর্নার’দের কাছ থেকে ডলার কিনে সেখানেই রেখে দিচ্ছে। সরকার অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু হুন্ডিওয়ালাদের দমাতে পারছে না। লোকে বলছে, এর সঙ্গে জড়িত অর্থ পাচারের ঘটনা। অনেক অর্থ এখন সমানে পাচার হচ্ছে। এ অর্থ পাচার নাকি নির্বাচনকেন্দ্রিক। প্রার্থীদের কাছে প্রশ্ন-তারা কী করবেন হুন্ডি দমাতে, কী করবেন অর্থ পাচার বন্ধ করতে? এ প্রশ্ন অনেক দিনের। কোনো ‘ওষুধ’ই কাজে লাগছে না এই ‘অসুখ’ রোধে। এ কারণেই দেশপ্রেমিক প্রার্থী, জনদরদি, দেশসেবক প্রার্থীদের কাছে আমাদের প্রশ্ন : আপনারা খুলে বলুন-ডলারের আমদানি কীভাবে বাড়াবেন, ডলারের দাম কীভাবে স্থিতিশীল করবেন, কীভাবে হুন্ডি রোধ করবেন, কীভাবে অর্থ পাচার বন্ধ করবেন? এটা একটা জটিল কাজ। ডলারের দাম খোলাবাজারে ছেড়ে দিতে হবে এই হচ্ছে আইএমএফের সঙ্গে আমাদের চুক্তি। আবার মানুষ চায় মূল্যস্ফীতি রোধ, আইএমএফও চায় মূল্যস্ফীতি রোধ। আগামী দিনের সংসদ-সদস্যদের কাছে প্রশ্ন-আপনারা বলুন, কীভাবে আপনারা ডলারের দাম খোলাবাজারে ছেড়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতি ঠেকাবেন? ডলারের দাম যদি ১২০, ১৩০, ১৪০ টাকা হয়, তাহলে মহা আমদানিনির্ভর বাংলাদেশে কীভাবে মূল্যস্ফীতি ঠেকাবেন-তাদের কাছে এটিও জিজ্ঞাসা।

কেউ কেউ বলছেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি বেশ সহজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা করে। তার কাছে অনেক ‘ব্যবস্থাপত্র’ (টুল) আছে। তারা তা ব্যবহার করে নিয়মিত। এটা করতে গিয়ে তারা আবার নোট ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয় অন্যায্যভাবে। এতে মূল্যস্ফীতির কিছু যায় আসে না। অতএব, কী করণীয়? করণীয় হচ্ছে রাজস্বনীতিকে ব্যবহার করা। কর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এখানেই আগামী দিনের মন্ত্রী-মিনিস্টারদের কাছে প্রশ্ন : আপনারা অগ্রিম বলুন-রাজস্বনীতিকে কীভাবে আপনারা ব্যবহার করবেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে? আপনারা কি পণ্য আমদানি, বেচাকেনাতে ট্যাক্স, ভ্যাট হ্রাস করবেন? করাই তো উচিত, তা না হলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে কী করে। প্রতিটি পণ্যের ওপর নানা ধরনের শুল্ক বসানো হয়, রয়েছে ভ্যাট ও সম্পূরক কর। এসব কমালে অবশ্যই দ্রব্যমূল্যের ওপর এর প্রভাব পড়বে। অতএব, তা কমানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আবার প্রশ্ন : সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির কী হবে? সরকার চায়, মানুষ চায়, আইএমএফ চায় রাজস্ব বৃদ্ধি পাক, রাজস্ব বৃদ্ধি দরকার। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাতে হতাশাজনক। বর্তমান সরকার বলছে, কর মওকুফ, কর ছাড়, কর অবকাশ, নিচুহারে করারোপ ইত্যাদি কারণে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে হয় সরকারকে। একে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্যাক্স এক্সপেন্ডিচার’। বলুন, এসব ইস্যুতে কী করবেন? ‘ট্যাক্স এক্সপেন্ডিচার’ হ্রাস করবেন, ট্যাক্স কমাবেন, ভ্যাট কমাবেন? পরিষ্কার করে বলুন, এসব ক্ষেত্রে কী করবেন? আমরা মূল্যস্ফীতির ভারে আক্রান্ত। সহ্যসীমার বাইরে কাঁধের ভার। আগামী দিনের মন্ত্রী মহোদয়, সংসদ সদস্য মহোদয়রা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে, অনেকেই নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওইসব করুন; মানুষকে ‘সন্তুষ্ট’ করার জন্য যা যা করার তা করুন। কিন্তু আসল কথা বলুন, আপনারা ট্যাক্স কমিয়ে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দ্রব্যমূল্য হ্রাস করবেন কিনা। আবার বলতে হবে, কীভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি করবেন? একটি পথ হচ্ছে ‘ইনফরমাল সেক্টরে’ জোর দিয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি।

বর্তমানে দেখা যায় রাজস্ব বৃদ্ধির কথা উঠলেই যত বোঝা তা চাপানো হয় চাকরিজীবীদের কাঁধে। তারা জালের মধ্যে আছে। কাজেই তাদের কাঁধে বোঝা চাপানো সহজ। তা-ই করা হচ্ছে। যেমন একটি উদাহরণ দিই। বেসরকারি চাকরিজীবীদের ‘প্রভিডেন্ট ফান্ড’ আছে। ওই টাকা খাটিয়ে কোম্পানিগুলো সুদ পায়, যা কর্মচারীরা অবসরগ্রহণের সময় পায়। দেখা গেল প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর প্রাপ্ত সুদ আয়ের ওপর কর বসানো হয়েছে ৩০-৩৫ শতাংশ। এটা তো অবিচার। পরে কিছুটা কমানো হয়েছে অবশ্য। এ অবিচার থেকে বাঁচানোর একটা পথ হচ্ছে ‘ইনফরমাল সেক্টরে’ কর বাড়ানোর চেষ্টা। আমাদের ‘ইনফরমাল সেক্টর’ বেশ বড়। ভবিষ্যৎ মন্ত্রীরা বলুন, আপনারা কি ওই পথে যাবেন, নাকি যাবেন না? রাস্তা বানিয়ে দেবেন, খাল কেটে দেবেন-এগুলো সহজ কাজ। আবার খরচের কাজ। এতে উৎসাহ সবারই। আমরা জানতে চাই, রাজস্ব কীভাবে বাড়াবেন?

এগুলোই শুধু ইস্যু নয়। ইস্যু আরও হচ্ছে। অর্থ খাতের সংস্কার, খেলাপি ঋণ, বৈদেশিক ঋণ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ, শিক্ষার মানের অধঃপতন, বায়ুদূষণ, সামাজিক উগ্রতা ইত্যাদি ইস্যু। ইস্যুর কোনো অভাব নেই। প্রতিটি ইস্যুতে আপনাদের পদক্ষেপ কী কী হবে, তা দেশবাসীকে খুলে বলুন।

নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই। এখনো বলছেন না-এটা ঠিক নয়। যারা নির্বাচন করবেন না, তাদেরও উচিত বলা-তারা নির্বাচনে গেলে, নির্বাচন করলে দেশবাসীর জন্য কী কী করতেন। খালি মাঠে তারা অনেক কথা বলছেন। সরকারের শুধু সমালোচনাই তারা করছেন-তাও রাজনৈতিক সমালোচনা। তারা বলছেন না যে, তারা নির্বাচনে গেলে মূল্যস্ফীতি রোধ, টাকার মূল্যমান নির্ধারণ, সিন্ডিকেট দমন, ডলার প্রবাহ বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ, বৈদেশিক ঋণ থেকে শুরু করে সব ইস্যুতে কী করবেন। অথচ এসব বলা উচিত। তাহলে মানুষ একটা ‘পজিশন’ নিতে পারত। আমাদের দুর্ভাগ্য, নির্বাচনের সময় রাজনীতির কথাই বলা হয়, প্রচারিত হয় বেশি। অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসার চর্চা নেই বললেই চলে। সবারই ধারণা, সস্তা রাজনীতিই হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ। অর্থনীতি মূল কথা নয়, সমাজ প্রগতি মূল কথা নয়। অথচ এ সবই হওয়া উচিত ছিল নির্বাচনের কথা।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম