Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আশেপাশে চারপাশে

যথেষ্ট ভোটার উপস্থিত করানোই বড় চ্যালেঞ্জ

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যথেষ্ট ভোটার উপস্থিত করানোই বড় চ্যালেঞ্জ

অনেক আলাপ-আলোচনা, টানাপোড়েনের পর অবশেষে আওয়ামী লীগ সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন-সমঝোতায় পৌঁছেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষদিন ১৭ ডিসেম্বর (রোববার) এই সমঝোতার কথা প্রকাশ করা হয়।

আওয়ামী লীগ সমঝোতা অনুযায়ী জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এছাড়া ১৪ দলীয় জোটের তিন শরিক দলকে ছেড়েছে ছয়টি আসন। এসব আসনে নৌকা মার্কা নিয়ে কোনো প্রার্থী থাকবে না। তবে স্বতন্ত্র হিসাবে আওয়ামী লীগ-দলীয় প্রার্থী থাকতে পারে। এটি মেনে নিয়েই জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। তবে নৌকা মার্কা না থাকায় ভোটের লড়াইটা তাদের জন্য অনেকটা সহজ হবে। ১৪ দলের প্রার্থীরা অবশ্য নৌকা প্রতীক পাবেন ছয় আসনে।

জাতীয় পার্টি ঘোষণা করেছে, সমঝোতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত ২৬ আসনসহ ২৮৩ আসনে দলের প্রার্থীরা লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করবেন। জাতীয় পার্টি অন্তত ৪০টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা চেয়েছিল। কিন্তু অনেক দরকষাকষির পর ২৬টি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছে, সংসদের ৩০০ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই তারা লড়বেন। একটি রাজনৈতিক দলের নীতি-আদর্শ এমনটাই হওয়া উচিত।

এর আগে জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায় থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, দলটি নির্বাচন নাও করতে পারে। এ নিয়ে গুজব চলে কয়েকদিন। গণমাধ্যমেও খবরটি চলে আসে। পরে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক সংবাদ সম্মেলনে জানান, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে রয়েছে এবং ২৮৩ আসনে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। জাতীয় পার্টির মতো বড় দল যদি নির্বাচন বর্জন করত, তাহলে নির্বাচনি দৃশ্যপট পালটে যেত, নির্বাচনটি একতরফা হয়ে যেত। কারণ, তখন মাঠে থাকত একমাত্র বড় দল আওয়ামী লীগ এবং ছোট দলগুলো। আরেকটি বড় দল বিএনপি আগেই নির্বাচন বর্জন করে ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬ আসনে সমঝোতার পরও জাতীয় পার্টি মোট ২৮৩ আসনে নির্বাচনি লড়াইতে থাকছে। এতে দলটির রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বাড়বে। রাজনৈতিক দল হিসাবে টিকে থাকতে হলে নির্বাচন করতে হয়। জনগণের কাছে ভোটের জন্য যেতে হয় এবং ভোট নিয়ে সংসদে বসতে হয়। সংসদের ভেতরে-বাইরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো যায় একই সঙ্গে। এতে একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে।

নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি রাজনীতির সঠিক পথেই রয়েছে। কিন্তু বিএনপি, ১৯৭৫-এর পর যে দলটি বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় গিয়েছিল, সেই দল নির্বাচন বর্জন করে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ও সভা-সমাবেশ করে আসছে। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশে গোলযোগের পর বিএনপি তাদের আন্দোলনের ধরন পালটে অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি দিচ্ছে।

অবরোধ-হরতালের সময় সহিংস ঘটনাও ঘটছে। এ পর্যন্ত প্রায় তিনশ যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে রেললাইনও উপড়ে ফেলা হয়। মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি ট্রেনে আগুন লাগানো হলে তিনটি বগি পুড়ে যায়, মারা যান চার যাত্রী। এসব সহিংসতার জন্য সরকারপক্ষ বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলোকেই দায়ী করছে। এখানে প্রশ্ন থাকে, সরকার এসব সহিংসতা দমন করতে পারছে না কেন? অপরাধীদের শনাক্ত ও আটক করার ক্ষমতা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই? জনগণকে নিরাপত্তা দেবে কে?

দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি অবরোধ-হরতাল ও সহিংসতার যে পথ বেছে নিয়েছে, সেই পথে কি কোনোদিন ক্ষমতায় যেতে পারবে? বরং এ পথে গেলে বিএনপি জনগণ থেকে শুধু দূরেই সরে যাবে। জনগণ শান্তিতে ও স্বস্তিতে থাকতে চায়, সহিংসতা চায় না।

বিএনপি যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করল, তাতে দলটির কী লাভ হলো? দলটির শীর্ষ নেতারা ও বহু কর্মী-ক্যাডার কারাগারে। এদিকে নির্বাচন তো হয়েই যাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতসহ সহযোগীরা কি নির্বাচন ঠেকাতে পারছে? আওয়ামী লীগ আরও একবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, এটি প্রায় নিশ্চিত।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক দল হিসাবে টিকে থাকতে হলে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও অল্প আসন নিয়ে সংসদে বসার সুযোগ থাকে। সংসদ অধিবেশনে সব কথা বলা যায়, যা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। সংসদের ভেতরে-বাইরে কথা বলে, আন্দোলন করে জনমত গড়ে তোলা যায়। এতে একটি রাজনৈতিক দলের জনসম্পৃক্ততা বাড়ে, দল শক্তিশালী হয়।

১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনিই গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সংসদ নির্বাচন যখন দেওয়া হয়, তখন আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে দুর্বল অবস্থায় ছিল। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার অবর্তমানে মধ্যম সারির নেতারা দল চালাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখনো দেশে ফিরতে পারেননি। আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর সামরিক সরকারের দমন-পীড়নও চলছিল।

এ অবস্থার মধ্যেও আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ৩৯টি আসন পায়। তিনশ আসনের সংসদে নবগঠিত বিএনপি পেয়েছিল ২০৭ আসন। মাত্র ৩৯টি আসন নিয়েই আওয়ামী লীগ সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে। এভাবেই আওয়ামী লীগ সংসদের ভেতরে-বাইরে রাজনৈতিক তৎপরতা ও আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ফলে সারা দেশে দলের সাংগঠনিক শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৮১ সালের মে মাসে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

১৯৭৫ সালের পর অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আওয়ামী লীগ আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে দেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রেখে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কখনো সরকারে থেকেছে, কখনো বিরোধী দলে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভের পর এখন পর্যন্ত দলটি ক্ষমতায় আছে এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যত সমালোচনাই থাকুক, এটি মানতেই হবে যে, দলটি নির্বাচনের মাধ্যমেই বারবার ক্ষমতায় এসেছে, বিপ্লবের মাধ্যমে নয়। বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে হরতাল-অবরোধ-সহিংসতার যে পথে চলেছে, এতে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হবে, আর কিছু নয়। নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি বড় ধরনের রাজনৈতিক ভুল করেছে, এর মাশুল তাদের দিতে হবে।

প্রস্তুতির সব ধাপ অতিক্রম করে নির্বাচন কমিশন এখন ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের জন্য তৈরি হচ্ছে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটকে ৩২ আসনে ছাড় দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ ২৬৩ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। আরও পাঁচটি আসনে প্রার্থিতা উচ্চ আদালতে বিবেচনাধীন আছে।

আওয়ামী লীগসহ ২৭টি দলের ১ হাজার ৮৯৫ প্রার্থী এখন নির্বাচনি প্রচারে নেমে পড়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি ও সহযোগীরা নির্বাচন বর্জনের প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্তসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এজন্য ভোটারদের নিরাপত্তা ও ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। তাহলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম