রাজনীতিতে কিশোর গ্যাংয়ের ব্যবহার উদ্বেগজনক
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সভা-সমাবেশ, মিছিল, পিকেটিংসহ নানামুখী সহিংস ও অবিবেচক কর্মসূচি পালনে কিশোর গ্যাংয়ের ব্যবহার বেড়েছে। দল-মত নির্বিশেষে নগর-শহর-গ্রামীণ জনপদে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতায় দেশবাসী যারপরনাই আতঙ্কগ্রস্ত। সন্ত্রাস, ভাঙচুর, আক্রমণ, ভূমি দখল, মাদক পাচার, হত্যা ইত্যাদি অবাঞ্ছিত কাজে কিশোরদের উপস্থিতি এবং নৈরাজ্য সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকা সর্বমহলে আলোচিত। সম্প্রতি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনকালে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় কিশোরদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যানুসারে নির্বাচনকেন্দ্রিক অরাজকতা-নাশকতা সৃষ্টিতে কিশোর গ্যাং নানামুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, গবেষণার ফলাফল ও জনশ্রুতি অনুসারে-পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব, অপরাজনীতির কদর্য প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা, অনৈতিক-অবৈধ পন্থায় অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিদের পদ-পদায়ন, জঙ্গি-সন্ত্রাসী-মাদকসেবী-দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের প্রভাবে কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। দরিদ্র, শিক্ষা ও কর্মবঞ্চিত, নিপীড়িত-নিগৃহীত ব্যক্তি ও পরিবারের, এমনকি নিম্ন-উচ্চবিত্তের সন্তানদের অনেকেই এ অপসংস্কৃতির শিকার হচ্ছে। একদিকে রাতারাতি বা স্বল্প সময়ের মধ্যেই অনৈতিক প্রাচুর্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির ব্যাপক দূরত্বের সাংঘর্ষিক মিথস্ক্রিয়া এ অপসংস্কৃতিকে গতিশীল করছে। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে এই অবুঝ, অনেকটা নির্বোধ শিশু-কিশোরদের ব্যবহারে তৎপর কথিত ‘বড় ভাই’ নামধারীরা কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। এদের ধনসম্পদ ও বিত্ত-বৈভব অর্জনের জঘন্য প্রক্রিয়ায় কিশোরদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় নষ্ট চরিত্রের ঘৃণ্য ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের অপরাধে কিশোরদের সম্পৃক্ত করছে। কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে আছে স্থানীয় পর্যায়ের অপরাধী চক্র ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতা। সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের পর এই অপরাধীদের আইনগত সহায়তাও দেয় আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া রাজনৈতিক নেতারা। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজে লাগাতে তারা নতুন নতুন গ্যাং তৈরিতেও ইন্ধন জোগাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশের ৬৪ জেলায় গ্যাং কালচারের অস্তিত্ব পেয়েছে।
২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় ছাত্র হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়ার পর দেশব্যাপী এর দ্রুত বিস্তার ঘটেছে। সারা দেশে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়। গণমাধ্যম সূত্রমতে, চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরে কিশোর গ্যাং পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২২৫টি। ওই সদস্যরা আলাদাভাবে ১১০টি গ্যাংয়ের সদস্য। গ্যাংগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। উল্লেখিত সময়ে গ্রেফতার হয়েছে বিভিন্ন গ্যাংয়ের ৫২৯ সদস্য, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। বৈঠকে আরও বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকাভিত্তিক মাদকের কারবার-সেবন-সরবরাহ, ছিনতাই, ইভটিজিং, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িত। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৫২ এবং সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। সবচেয়ে বেশি গ্যাং রয়েছে ঢাকার মিরপুরে। ডিএমপির তথ্যানুসারে, পুলিশের মিরপুর বিভাগে ১৩টি কিশোর গ্যাংয়ের ১৭২ জন সক্রিয় সদস্য আছে। ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচনে কিশোর গ্যাং সক্রিয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা তাদের কাজে লাগালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত অর্ধশত খুনের ঘটনা ঘটেছে। নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ানক অপতৎপরতার পাশাপাশি জামাল খান ও চকবাজার ওয়ার্ডেও এদের সক্রিয়তা স্পষ্ট। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের ৩০০টি স্পটে বিশেষ করে উঠতি বয়সি কিশোররা বড়ভাইদের মাধ্যমে গ্যাংয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তারা মাদক ব্যবসা, ইয়াবা সেবন, মোটরসাইকেল ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে জড়াচ্ছে। অতি নগণ্য বিষয় নিয়ে হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। রাজশাহীতে দুই বছর আগে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যের তথ্য-উপাত্ত তৈরি করেছিল পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গত ২৭ অক্টোবর রাজশাহীতে প্রকাশ্যে অস্ত্রধারী কিশোরদের নৃত্যের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাদের মধ্যে ১১ জন শনাক্ত হলে কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে। এসব কিশোর ইতোমধ্যে অনেক গুরুতর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে। একইভাবে যশোর শহরেও ২৫-৩০টি কিশোর গ্যাং বেপরোয়া তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) কর্তৃক আয়োজিত ‘কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার ভূমিকা এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা জানান, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে শুধু আইনের কঠোরতা দিয়ে শিশু-কিশোর বা গ্যাং কালচারের অপরাধে জড়িতদের নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর নেপথ্য মদতদাতাদের চিহ্নিত করে তাদেরও আইনের আওতায় আনা অতি আবশ্যক। কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন, যা মোটেও কাম্য নয়।
দেশে জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৫ কোটি ৭০ লাখ শিশু-কিশোর। তাদের বিকাশের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা যদি আমরা করতে না পারি; তাহলে এটা সামাজিক ও রাষ্ট্রের একটা বড় অসংগতি। তাই কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে রাজনৈতিক উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধ রোধে প্রশাসন, গণমাধ্যম, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় অথনৈতিক বিপর্যয় কিশোর অপরাধকে গ্যাংভিত্তিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাব, ক্রমবর্ধমান অসমতা ও বৈষম্য সমাজে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ফলে ১৯৫৫ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক কিশোর অপরাধী ও গ্যাংয়ের উত্থান ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা সহজে প্রাপ্তির কারণে কিশোররা বেপরোয়াভাবে তাদের স্বাধীন সত্তার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাজ্যে কিশোর গ্যাংগুলো ভয়ানক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সম্ভবত ‘টেডস’ যুদ্ধোত্তর বিশ্বে প্রথম অপসংস্কৃতি। পরবর্তী সময়ে ‘রক এন রোল’ ধরনের বহুমাত্রিক কিশোর গ্যাং এ অপসংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজে’র সংঘাতের বিষয়টি জনগণের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। এসব অপরাধী সংগঠনের সঙ্গে কালক্রমে যুক্ত হয়েছে ‘বিগবস’, ‘কাশ্মীরি গ্রুপ’, ‘টিকটক অ্যাপ’, ‘ফার্স্ট হিটার বস’, ‘এফবিএএইচ’,‘মোল্লা রাব্বি’, ‘স্টার বন্ড’ নামের বিভিন্ন কিশোর গ্যাং। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রুপের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল কাটার ধরন ও রঙের ভিন্নমুখী ব্যবহার।
অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে, কিশোর বয়সে হিরোইজমের মনোভাব কাজ করে। এ হিরোইজমকে সঠিক পথের অনুসারী করে তুলতে হবে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। এর দায় আমাদের সবার। অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি তাদের আয়ত্তে চলে আসায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগ এ কিশোর গ্যাং কালচার থেকে বিপথগামী কিশোরদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে পারে। বিভিন্ন সংশোধনাগার, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, পরিবার-সমাজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার শিশু-কিশোরদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের উপযোগী আচরণগত উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বস্তু ও সত্যনিষ্ঠ মূল্যায়ন, গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।
কিশোর অপরাধ নির্ধারণে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশাকে বিবেচনায় না এনে সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক উন্নত ভবিষ্যৎ রচনায় শিশু-কিশোরদের সামনে ‘জাতীয় আদর্শে’র উন্মোচন একান্তই জরুরি। দেশপ্রেমিক, সৎ, যোগ্য, মেধাবী, নীতি-নৈতিকতায় ঋদ্ধ, ত্যাগী ব্যক্তিত্ব, পেশাজীবী ও রাজনীতিকদের সমৃদ্ধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরলে তা কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমাতে ভূমিকা রাখবে। এর পাশাপাশি পাঠ্যবই ও অন্যান্য বিষয়ে রচিত পুস্তকসহ বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় আদর্শের চেতনায় শিশু-কিশোরদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়