স্বদেশ ভাবনা
সর্বাবস্থায় নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা
আবদুল লতিফ মণ্ডল
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছে ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন বা ২৮ লাখ মানুষ। ২০২২ সালের হিসাবে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে এই করোনা মহামারি। একই বছরে বৈশ্বিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অনেক পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় সরাসরি বাড়িয়ে দিয়েছে। চলতি বৈশ্বিক মন্দা দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। শুধু বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাড়তি ৫০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন নিষেধাজ্ঞা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে (যুগান্তর, ৯ ডিসেম্বর)। খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞা ও উপাদান, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী করণীয়, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞা অনুযায়ী, তখনই খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজমান, যখন সবার একটি কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্যনীতি ২০০৬-এ বলা হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম একটি উপাদান হলো জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের লভ্যতা (availability of food)। অপর অপরিহার্য উপাদান হলো, ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতা (access to food)। খাদ্য নিরাপত্তার তৃতীয় অপরিহার্য উপাদন হলো খাদ্যের জৈবিক ব্যবহার (utilisation of food)।
দেশে খাদ্য লভ্যতার মূল উৎস হলো কৃষি খাতে (শস্য উপখাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে কৃষি খাত গঠিত) উৎপাদিত খাদ্যপণ্য। উপর্যুক্ত সম্মেলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে দেশের কৃষি খাতে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতের ৬.৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে পরবর্তী এক দশকে গড়ে ৩.৭ শতাংশে দাঁড়ায় (অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ২০১৯-২০)। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এ বলা হয়েছে, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.১৭ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩.০৫ শতাংশে। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ২.৬১ শতাংশে।’ কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শস্য উপখাতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফসল ধান তথা চালের ওপর। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) তথ্য মোতাবেক ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ১ শতাংশ। এদিকে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১.৩৭ ও ১.৩ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ ও ২০২৩)। এর অর্থ দাঁড়ায়, চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। এতে চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্য লভ্যতার অন্য উৎসটি হলো আমদানি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক দেশের চাহিদা মেটাতে ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে যথাক্রমে ১৩ লাখ ৫৯ হাজার, ৯ লাখ ৮৭ হাজার এবং ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়। বোরোর আশানুরূপ উৎপাদন এবং চলতি আমন মৌসুমে ভালো ফলনের আশায় ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাল আমদানি না করার সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি করা হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আশা করছে, এবার আমন উৎপাদন দাঁড়াবে ১ কোটি ৭০ লাখ টনে, যা লক্ষ্যমাত্রার (১ কোটি ৬৩ লাখ টন) চেয়ে ৭ লাখ টন বেশি। অন্যদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সময়মতো প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের অভাবে এবার আমন উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ কোটি ৪০ লাখ টনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিতব্য হিসাবে জানা যাবে এ বছর আমন উৎপাদনের প্রকৃত পরিমাণ। তবে অতীতের উদাহরণ থেকে অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবের সঙ্গে বিবিএসের হিসাবের তারতম্য ঘটবে অর্থাৎ বিবিএসের হিসাবে আমনের উৎপাদন হ্রাস পাবে। এদিকে আমনের ভরা মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। টিসিবির বরাত দিয়ে ডেইলি স্টারের ১ ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক মাসে চালের দাম ২ থেকে ৫.৬১ শতাংশ বেড়েছে। চাল আমদানি না করা হলে মার্চে দেশে চালের মজুত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারের উচিত হবে জরুরিভিত্তিতে একটি জরিপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা মার্চ ও এপ্রিলে কী পরিমাণ চাল আমদানি প্রয়োজন হতে পারে এবং তদনুযায়ী চাল আমদানির পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
আমাদের দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমের উৎপাদন ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের ১৯ লাখ টনের তুলনায় সাম্প্রতিককালে ১১ লাখ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে গমের চাহিদার (কম-বেশি ৭০ লাখ টন) প্রায় ৮৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হচ্ছে। এদিকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়, তা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। আর মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কম-বেশি ২৫ শতাংশ হ্রাস পাওয়ায় দেশে গমের দামে উল্লম্ফন ঘটেছে। ডেইলি স্টারের উপর্যুক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক মাসে দেশে প্রতি কেজি গমের দাম ৯.২০ থেকে ১৪.২৯ শতাংশ বেড়েছে।
শুধু খাদ্যশস্য নয়, অন্যান্য খাদ্যপণ্য যথা-ডাল, ভোজ্যতেল, দুধ, চিনি, ফল, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ, আদাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলার উৎপাদন দেশের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক ২০-২১ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ ৪ থেকে ৫ লাখ টন। বছরে ২৫-২৬ লাখ টন ডালের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ৮-৯ লাখ টন। বছরে চিনির ১৪-১৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম-বেশি ১ লাখ টন। পেঁয়াজের বার্ষিক ২২ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম-বেশি ১৯ লাখ টন। বছরে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন আদার চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ কম-বেশি ২ থেকে আড়াই লাখ টন। আমদানির মাধ্যমে এসব খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে হয়।
খাদ্যের লভ্যতা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতা (access to food) এবং এজন্য যা দরকার তা হলো খাদ্য কেনার সামর্থ্য। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সোয়া ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আইএলও’র এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে (অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৯৩ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৫৬ শতাংশ) প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দ্য স্টেট অফ ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৩ মোতাবেক ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ৫ কোটি ২৭ লাখ মানুষ। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৯ লাখ। অর্থাৎ দেশে তীব্র থেকে মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ২০১৬ সালের পর গত ছয় বছরে প্রায় ১৮ লাখ বেড়েছে। এসব মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটিকে দেশে খাদ্য নিরাপত্তার আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হয়েছে বিআইডিএসের উপর্যুক্ত সম্মেলনে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখছেন। ৮ ডিসেম্বর নিজ নির্বাচনি এলাকা কোটালীপাড়ায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেছেন, ‘সামনে নির্বাচন। বিএনপি চিন্তা করেছিল নির্বাচন হবে না। এখন নির্বাচন হয়ে যাচ্ছে। এক সময় বলেছিল নির্বাচন হতে দেবে না। উসকানি আছে নির্বাচন ঠেকাও। নির্বাচনের শিডিউল হয়ে গেছে। এখন তারা মনে করছে নির্বাচন হয়েই যাবে। তাই তারা মার্চের দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে। এটা হচ্ছে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। এটা শুধু দেশের নয়, বাইরের দেশেরও পরিকল্পনা। যেভাবেই হোক দুর্ভিক্ষ ঘটাতে হবে।’ তবে বিএনপি কীভাবে দুর্ভিক্ষ ঘটাবে তা খোলাসা করেননি তিনি। তাছাড়া দুর্ভিক্ষের পরিকল্পনাকারী বাইরের দেশের নামও তিনি উল্লেখ করেননি। আসলে একই দিনে (৮ ডিসেম্বর) বিআইডিএসের সম্মেলনে এমন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। নিবন্ধের শুরুতে সম্মেলনের প্রাসঙ্গিক বক্তব্যটির উল্লেখ করা হয়েছে। খুব সম্ভবত সম্মেলনের বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী মার্চে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
উপরের আলোচনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যের অবস্থান শীর্ষে। আমাদের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের তালিকায় ‘অন্ন’কে শীর্ষে রাখা হয়েছে। তাই দেশে সর্বাবস্থায় নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com