‘জাগো মাতা, ভগিনী, কন্যা’
ফওজিয়া মোসলেম
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘ভগিনীরা! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন’-বাংলা ১৩৩৭ সালের আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যা ‘মোয়াজ্জিনে’ প্রকাশিত ‘সুবহে-সাদিক’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের আহ্বান। এখন আমরা বাংলা ক্যালেন্ডারের ১৪৩০ সাল অতিক্রম করছি। বেগম রোকেয়ার এ আহ্বানের পর এক শতাব্দীর বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। দেশে-বিদেশে নারীর জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ‘জাগিয়া উঠা’ বা ‘অগ্রসর হওয়া’র প্রয়োজন এখনো ফুরায়নি। এ কারণেই রোকেয়া ক্ষণজন্মা ও সবসময় সমকালীন।
বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয় ১৯৮০ সালে। শতবার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি পর্বের এক সভায় আলোচনা ওঠে-বেগম রোকেয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞের ভিত্তিতে তাকে আমরা কীভাবে চিহ্নিত করতে পারি। তিনি সমাজ সংস্কারক নাকি বিপ্লবী। সেদিন সেই বিতর্কের অবসান হয়নি। কিন্তু আজ নির্দ্বিধায় বলতে চাই, সমাজ সংস্কারের যে রূপরেখা তিনি তুলে ধরেছেন, সেটি সে সময়ের জন্য এবং সব সময়ের জন্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের অংশ। এ বিপ্লবে অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি; কিন্তু যে সময়কালে বেগম রোকেয়া সমাজের অভ্যন্তরের অসংগতিগুলোকে নারীর জীবনে অবরোধের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে মুক্ত হওয়ার পথনির্দেশ করেছেন, সেই অবরোধের সময়কালে সেটা বিপ্লব ভিন্ন কিছু নয়।
বেগম রোকেয়ার কর্মযজ্ঞ নারীর মানবাধিকার উন্মোচিত, বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। তার ক্ষুরধার লেখনী, নারীর অধস্তনতার দর্শন ব্যাখ্যা, সমতা প্রতিষ্ঠার পথরেখা নির্ণয় তাকে একজন প্রাজ্ঞ সমাজচিন্তক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারীদের সংগঠিত করার জন্য আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং নারী শিক্ষার জন্য সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুল স্থাপন তার চিন্তার সঙ্গে বাস্তবের সম্মিলনের স্মারক। জীবনাবসনের এত বছর পরও এ অসামান্য নারীর জীবন অস্তমিত হয়নি। শুধু প্রাচ্যে নয়, পাশ্চাত্যও তার ধীশক্তি ও কর্মের মূল্যায়ন করে চলেছে। সম্প্রতি তার রচিত ‘সুলতানার স্বপ্ন’ অবলম্বনে স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা তৈরি করেছেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র, স্প্যানিশ ভাষায় যার নামকরণ হয়েছে ‘এল সুয়েনো দে লা সুলতানা’। এ বছর (২০২৩ সাল) স্পেনের ৭১তম স্যান সেবাস্তিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় ছবিটি। বিবিসি বাংলার ২০০৪ সালের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনের তালিকায় বেগম রোকেয়ার নাম রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। তার যে চিন্তা, দর্শন ও কর্মকাণ্ড তাকে এ উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা।
নারীর জীবনের মূল সংকটের যে ক্ষেত্রটি বেগম রোকেয়া তার লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, সেটি হলো নারী ও পুরুষের অসমতা। এ অসমতার চিত্রটি তিনি তার লেখনীতে বর্ণনা করেছেন এভাবে-‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন। স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালাবেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাল-ডাল ওজন করেন ও রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন’ (মতিচূর)। স্বামী-স্ত্রীর কল্পনা ও কর্মপরিমণ্ডলের ভিন্নতা নারীকে সমাজে অধস্তন রাখা এবং নারী-পুরুষের অসমতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
নারী-পুরুষের অসমতার কারণ যে সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে নিহিত, সে বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘স্ত্রীর অবনতি’ প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এ বিশ্বব্যাপী অধঃপতনের কারণ কেহ বলিতে পারেন কি? সম্ভবত সুযোগের অভাব ইহার প্রধান কারণ।’ বর্তমান সময়ে নারী সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নের আন্দোলন সমসুযোগের অভাবকে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে নারী সমাজের অন্যতম দাবি সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার। উত্তরাধিকারের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন পারিবারিক বিধি (Uniform Family Code) বর্তমান সময়ের নারী আন্দোলনের অন্যতম দাবি। এ দাবির উল্লেখ আমরা বেগম রোকেয়ার ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে দেখতে পাই।
নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকাশ ঘটে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়নের মতো ঘৃণ্য ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আজ বিশ্বব্যাপী মহামারির আকার গ্রহণ করেছে। নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়া রচনা করেছেন ‘পদ্মরাগ’। এ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র সিদ্দিকার আত্মনির্ভর হয়ে গড়ে ওঠার বিবরণ পাই। শুধু তাই নয়, সহিংসতার শিকার নারীদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা, আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা এবং সেখানকার নানামুখী কর্মসূচির বিবরণও আমরা পাই ‘পদ্মরাগ’ উল্লেখিত ‘তারিনী ভবনের’ কর্মকাণ্ডে। বর্তমান সময়েও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আন্দোলনে আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া জীবনের মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়াটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘পদ্মরাগ’। এ উপন্যাসে আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মানের জন্য আত্মনির্ভরতা অর্জনে ‘সিদ্দিকার’ সাহসের প্রচেষ্টার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নারীর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য হতে হবে স্বাবলম্বী, তার জন্য চাই শিক্ষা।
নারীর জীবনে শিক্ষার দ্বার উন্মোচনের জন্য তীব্র লড়াইয়ের সম্মুখীন হয়েছেন বেগম রোকেয়া। শিক্ষাকে তিনি দেখেছেন সামগ্রিকতার বিকাশের লক্ষ্যে। তিনি বলেছেন, ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (Faculty) দিয়েছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। ওই গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ। আরও বলেছেন, আমরা কেবল ‘পাশ করা বিদ্যা’কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না। নারী শিক্ষার বিষয়ে সমাজের নেতিবাচক ধারণার বিভিন্ন ক্ষেত্র তিনি তুলে ধরেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন ‘মতিচূর’ গ্রন্থে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। এর পর ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াৎ মোমোরিয়াল গার্লস স্কুল। ইতঃপূর্বে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর প্রদত্ত অর্থে পাঁচজন ছাত্র নিয়ে তার আবাসস্থল ভাগলপুরে স্কুল শুরু করেন। পারিবারিক কারণে তিনি ভাগলপুর ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুল পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি কলকাতার বেথুন ও গোথেল মেমোরিয়াল স্কুলে গিয়ে স্কুল পরিচালনা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। স্কুল পরিচালনার জন্য নারী শিক্ষাবিরোধীরা তাকে নানাভাবে অবমাননা করে। নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ১৯৩০ সালে তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। এ রূপান্তরের মূলে ছিল তার অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা ও অক্লান্ত পরিশ্রম। তার এ সাফল্যের প্রশংসা করেন ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেত্রী সরোজিনী নাইডু। তিনি চিঠির মাধ্যমে বলেন, ‘মুসলিম বালিকাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আপনি যে কাজ হাতে নিয়েছেন এবং তার সাফল্যের জন্য যে কাজ হাত নিয়েছেন, তা দুঃসাহসিক ও বাস্তবিকই বিস্ময়কর।’ ১৯৩১ সালে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্রীরা প্রথমবারের মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং ৬০০ ছাত্রী বঙ্গীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হয়। ১৯৩৫ সালে বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর পর সরকার স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এটি এখনো পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ স্কুলে এখন বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু তিনটি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থান ও তার কারণ ব্যাখ্যার পাশাপাশি বেগম রোকেয়া নারীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৬ সালে। এ ছাড়াও নারীদের বিভিন্ন সমিতিতে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
কলকাতায় নিজ বাড়িতে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কর্মরত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার কায়সার রোডের একটি মসজিদে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকসহ অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। কলকাতার নিকটস্থ সোদপুরের পানিহাটিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। পানিহাটি স্কুল প্রাঙ্গণে শায়িত আছেন নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া।
রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে তার স্মৃতি রক্ষায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে ছাত্রীদের হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রংপুরে বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ প্রকাশ করেছে স্মারক ডাকটিকিট। অন্তঃপুর ভেঙে অবরোধবাসিনী নারীকে যিনি পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কোনো স্মৃতিস্তম্ভ আজও নির্মিত হয়নি। তিনি বাংলাদেশের অনেক দূরে শায়িত থাকায় তাকে নিয়মিত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস যদি মৃত্যু দিবসে তার সমাধিতে নিয়মিত শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্যোগ নিতে পারে, তাকে নিয়মিত শ্রদ্ধা জানাতে পারে, তাহলে আমাদের ঋণ স্বীকারের কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
বেগম রোকেয়া তার কবিতায় আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন-‘সোনার পিঞ্জরে ধরে রেখো না আমায়। আমারে উড়িতে দাও দূর নীলিমায়।’ আজও নারী সমাজ নানা প্রচলিত প্রথার পিঞ্জরে আবদ্ধ। এ পিঞ্জর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বেগম রোকেয়ার আহ্বান-জাগো মাতা, ভগিনী কন্যা-উঠ। শয্যা ত্যাগ করিয়া আইস; অগ্রসর হও (সুবহে-সাদিক)। আজকের নারী আন্দোলনও রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের এ আহ্বানের প্রতিধ্বনি ঘোষণা করে।
ফওজিয়া মোসলেম : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ