Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

শুধুই কি মেধা পাচার, অর্থ পাচার নয়?

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুধুই কি মেধা পাচার, অর্থ পাচার নয়?

দুদিন আগের ঘটনা। ব্যাংকে গিয়েছি, হাতে টাকা নেই, কিছু টাকা তুলব বলে। সরাসরি ম্যানেজার সাহেবের চেম্বারে-আজকাল যাদের নাম ‘রিলেশনশিপ ম্যানেজার’-একটু বসলাম। শরীর ভালো নয়। ম্যানেজার সাহেব কফি অফার করলেন। আমি কফি খেতে খেতে গ্রাহকের নানা সমস্যার কথা শুনছিলাম। কত সমস্যা মানুষের, ভাবা যায় না। ব্যাংক আজকাল টাকা তোলা ও জমার সময় নানা ঝামেলা করে। এসব নিয়েই দেখলাম বেশি বেশি কথা-বোঝানো, যুক্তি দেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের অজুহাত দেওয়া ইত্যাদি। যেমন একজনের সমস্যা-দুই লাখ টাকার চেক দিয়েছে; ব্যাংক থেকে ‘ড্রয়ার’ অর্থাৎ ‘চেক’ যে দিয়েছে তার কাছে ফোন : আপনি কি ‘চেক’ কেটেছেন? ‘ইয়েস’ হলে ‘পেমেন্ট’, নতুবা নয়। ‘বিয়ারার চেকে’র ক্ষেত্রে এ নিয়ম কেন-প্রশ্নের পর প্রশ্ন গ্রাহকের। কেন এত হুজ্জুতি! মানি লন্ডারিংয়ের ভয়? ভুল হাতে ‘পেমেন্ট’ যাওয়ার ভয়? হয়তো তা-ই। কিন্তু গ্রাহক তা মানতে রাজি নন। গ্রাহক বলছেন, অযথা ‘কোয়েরি’, সময় নষ্ট। কত টাকা কত ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার হিসাব নেই। ব্যাংক ব্যস্ত দুই লাখ টাকা নিয়ে। নাছোড়বান্দা ম্যানেজার। উপায় নেই, বিধি মানতে হবে। বিধি না মানলে ‘অডিট’ ধরবে। দুর্দিনে চাকরির কোনো অসুবিধা হলে বাঁচার পথ নেই।

এভাবেই গ্রাহকরা আসছেন, যাচ্ছেন। আমার কফি খাওয়া দীর্ঘায়িত হয়। অসুবিধা নেই। কোনো তাড়া নেই আমার। ৮-১০ দিন পর অসুস্থ অবস্থায় বেরিয়েছি। শুনছি মানুষের ছোট ছোট দুঃখের কথা, যার কোনো ‘ওষুধ’ নেই। এই ফাঁকেই এক দম্পতি এসে হাজির। ম্যানেজার সাদরে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তারা বয়স্ক। কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছেন বলে জানালেন। মেয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন প্রায় তিন মাস। কথায় কথায় জানাচ্ছিলেন, মেয়ে ও মেয়ের জামাই ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল চাকরি করেন তারা। বিশাল বাড়ি করেছেন, বিশাল গাড়ি। দুই শহরে বাড়ি। মন জুড়িয়ে যায় বাড়ি দেখলে। ফলের গাছ, ফুলের গাছ-কী নেই সেখানে। বাংলাদেশ থেকে গাছপালা, ফুলের চারা নিয়েছেন তারা। ফলমূল, শাকসবজি তাজা খান। উদ্বৃত্ত থাকে।

চেম্বারে ঢুকেই এই যে ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন, তার কোনো শেষ নেই। ম্যানেজার অস্বস্তিতে পড়েছেন বোঝাই যায়। আমার অসুবিধা নেই। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যেখানেই যাই, সেখানেই এই গল্প। ছেলেমেয়ে-নাতির গল্প। তারা দেশে নেই। বিদেশের নাগরিক। কে কত ভালো আছে, আনন্দে আছে, ‘সুখে’ আছে-তার গল্প সর্বত্র। বিয়ে বাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস, আড্ডাখানা, ক্লাব, সমিতি-সর্বত্র একই কথা। ছেলেমেয়ের কথা, তাদের ‘পারফরম্যান্সে’র কথা। রোজগারের কথা। বাড়িঘরের কথা। সুখ-শান্তির কথা। বিদেশি বউয়ের কথা, বিদেশি জামাইয়ের কথা। এসব গল্প যারা করতে পারে না, তারা বরং অস্বস্তিতে পড়ে। তারা ভোগে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায়।

তাহলে কি ছেলেমেয়ে দেশে রাখা যাবে না? রাখাটা সামাজিক ‘অবনমনের’ পরিচায়ক! মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, বিত্তবান, ধনাঢ্য ব্যক্তি, অতিধনী-প্রায় সবারই ছেলেমেয়ে বিদেশে। এ গল্পই সর্বত্র। তাদের কাছে দেশ আর এখন ভালো লাগে না। এখানকার আলো-বাতাস দূষিত। পানি পান করা যায় না। রাস্তাঘাট নোংরা। মানুষের আচরণও নোংরা। মানুষে গিজগিজ করে। প্রশাসন নেই, বিচার নেই, চাকরি নেই, চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ডাক্তারদের অধিকাংশই অমানবিক আচরণ করেন। আলোচনায় দেখা যায় দেশের কিছুই আর তাদের ভালো লাগে না। ছেলেমেয়েদেরও তাই।

এসবই শুনছিলাম সেদিন। আমার কপালই মন্দ কিনা জানি না, উপস্থিত দম্পতির কথা শুনতে শুনতেই আরেকজন পরিচিত লোক এসে হাজির। তারও দেখি একই সমস্যা। তিনিও সদ্য বিদেশ ফেরত। বসার আগেই সেই একই গল্প শুরু করে দিলেন। দুই দম্পতির মধ্যে প্রতিযোগিতা ছেলেমেয়েদের বাড়িঘর, গাড়ি নিয়ে। আমি শুনছি আর শুনছি। পরিষ্কার বোঝা যায়-বিদেশ গমন, বিদেশে পড়াশোনা করা, চাকরি করা, সেখানকার নাগরিকত্ব নেওয়ার বিষয়টি একটি সামাজিক পদমর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা আর এখন মেধা পাচার ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত নয়। কেউ একে আর ভিন্ন চোখে দেখে না।

এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। বিদেশে পড়তে যাবে, ডিগ্রি নেবে, ‘টেকনোলজিতে’ হাত পাকাবে, দরকার বোধে বিদেশে চাকরি করবে, ডলার রোজগার করবে। তারা বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে-কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যে জায়গাটায় কোনো হিসাব মেলাতে পারি না সেটা হচ্ছে-নাগরিকত্ব কেন? আবার এতে গার্জিয়ানদের স্বীকৃতি কেন, গার্জিয়ানদের আনন্দ কেন? মেধাবীরা যদি দেশ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে দেশে কি শুধু সাধারণ মানুয, ছেলেমেয়ে থাকবে? গুণগতভাবে নিকৃষ্টরা দেশ চালাবে আর ভালোরা চালাবে অন্য দেশ-এ বিষয়টি মানতে পারি না। তারপরের কাজটি আরও ‘ডেঞ্জারাস’, যে কথাটা বলা দরকার।

সেদিনের আলোচনায় এক দম্পতির সমস্যা একটি এবং তা হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা দেশে আসবে না, ফিরবে না। একথাই দুঃখ করে বলছিলেন। তার এখন দুশ্চিন্তা-তার সম্পদের কী হবে? দেশে সম্পদ আছে, জমি আছে, ফ্ল্যাট আছে, ক্যাশ আছে, বিনিয়োগ আছে। এগুলোর কী হবে? এর একটার সমাধান কিছুটা হয়েছে। তিনি আস্তে আস্তে সব বিক্রি করছেন। দুই মেয়ে দেশে আছে। তাদের ভাগ তাদের দিয়ে দিচ্ছেন। বাকিটা দিতে হবে দুই ছেলের পরিবারকে, যাদের একজন থাকে অস্ট্রেলিয়ায়, আরেকজন কানাডায়। সম্পত্তি বিক্রির টাকা ধীরে ধীরে তাদের কাছে পাঠাতে হবে। ওই কাজটিই করছেন এখন। বিক্রি, আর টাকা পাঠানো-যাকে সাদা বাংলায় বলা হয় অর্থ পাচার। মধ্যবিত্তের অর্থ পাচার। উপায় কী? এত সম্পত্তি কীভাবে অর্জন করেছেন, তার হিসাব তিনি নিজেই জানেন না। ওই সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ পাঠাতে হচ্ছে। সেখানে ছেলেমেয়েরা ব্যবসার চেষ্টায় আছে। ‘বিনিয়োগ ফান্ডের’ সঙ্গে যোগাযোগ করছে। কিছু একটা হবে। কিন্তু সমস্যা আরেকটা। মন চায় না ‘সোনার বাংলা’ ছেড়ে চলে যেতে। ছেলেমেয়েরা অবিরত বলছে, আব্বা-আম্মা তোমাদের বয়স হয়েছে, তোমাদের চিকিৎসা দরকার। নানাবিধ সেবার দরকার। তোমাদের কে তা দেবে। তাছাড়া ওই চিকিৎসা দেশে কোথায় পাবে? অতএব, সব ‘শেষ’ করে একবারে চলে আস।

স্বাভাবিক আবদার। বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকলে উভয়েরই শান্তি। তারা শান্তিতে ব্যবসা-অফিস করতে পারে। বাবা-মা বাসাবাড়ি দেখা শোনা করতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অন্য জায়গায়। সারাদিন কাটবে কী করে? দেখা যায়, কিছু দম্পতি আছে যারা বিদেশে থাকে; তাদের কাজ হচ্ছে সব বিষয়ে ‘টাইম’ ধরে ঢাকার বন্ধুদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা। সময় কাটানো। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য তাদের পরিতাপের শেষ নেই। দেশে এই হচ্ছে, ওই হচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন-এতে তাদের কী? তারা তো আর এসবে ক্ষতিগ্রস্ত বা উপকৃত হচ্ছে না। ছেলেমেয়েরাও এসবে ক্ষতিগ্রস্ত বা উপকৃত হচ্ছে না। কিন্তু দেখা যায় তাদের মধ্যে এসব নিয়ে উৎকণ্ঠা সবচেয়ে বেশি। একজনকে চিনি। তার মেয়ে একটা বাইরের দেশের নাগরিক। বিয়ে করেছে এক ‘ফিলিপিনোকে’। তাদের বাবা-মা থাকেন ঢাকায়। সারাদিন দুশ্চিন্তা-নির্বাচনে কী হবে? তাকে তো জিজ্ঞেস করাই যায়-নির্বাচনে কী হবে তা নিয়ে তার উৎকণ্ঠার কারণ কী? তার তো কোনো দায় বাংলাদেশে নেই। মেয়ে-নাতি বাংলাদেশে কোনোদিন ফেরবে না। তাহলে কেন এত দুশ্চিন্তা ‘সোনার বাংলার’ জন্য?

এখানে প্রশ্ন আছে। অনেক প্রশ্ন। এই যে মেধা পাচার, তা মেধা পাচারে সীমিত নয়। স্টুডেন্ট ফাইল খুলে বছরের পর বছর বাংলাদেশ থেকে ডলার নিয়ে লেখাপড়া করা হয়েছে। তারা যদি দেশে ফিরতে নাও চায়, অন্তত বাংলাদেশের এই দুর্দিনে সাহায্য করতে পারে। দেশে ডলার পাঠাতে পারে। এতে আমরা উপকৃত হই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডলার পাঠানো তো দূরের কথা, তারা দেশ থেকে সম্পদও পাচার করে নিচ্ছে। বিদেশে পড়াশোনা করে অথচ তারা সেখানে বাড়িঘর কিনছে, ব্যবসা করছে। এ কারণে ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার অনেক জায়গায় জমির দাম বাড়ছে। তাই সেখানকার সরকার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তারা এখন ‘অভিবাসন’ সীমিত করার কথা চিন্তা করছে। বিদেশে পড়ুয়া বাংলাদেশি কথাকথিত ছাত্রছাত্রী যারা আসে বা আসছে, তারা এখন বিভিন্ন দেশে বাঙালি পাড়া তৈরি করছে। সব দেশীয় সম্পদ সেখানে পাচার করছে। এটাই এখন মুখরোচক গল্প। মন্ত্রী-মিনিস্টাররা পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলছেন। কাদের সহায়-সম্পদ বিদেশে, এটা আলোচনায় আসছে।

বিদেশে পড়াশোনা, মেধা পাচারের বিষয়টি কার্যত এখন সম্পদ পাচারের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে, টেকনোলজি আয়ত্ত করে দেশে এসে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে, এটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। এর বদলে উচ্চবিত্তরা শুধু নয়, মধ্যবিত্তরাও তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশের নাগরিক করাকে আত্মসম্মানের বিষয় হিসাবে নিচ্ছে। এর প্রভাব দেশে পড়ছে। দেশ থেকে সম্পদ পাচার হচ্ছে। দেশ মেধাশূন্য হচ্ছে। দেশে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অভাব দেখা দিচ্ছে। কোম্পানিগুলো প্রশিক্ষিত কর্মী পায় না, উলটো অভিযোগ-দেশে চাকরি নেই। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবেই এটা ঘটছে, তাই নয় কি?

এটা কি মনে হয় না যে, সরকারি নীতি এ ধরনের আত্মবিনাশী কাজে উৎসাহ জোগাচ্ছে? বিনা ডলারে সরকার দ্বৈত নাগরিকত্ব দিয়ে যাচ্ছে। নানা সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ব্যাংক-বিমা কোম্পানি করতে পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের দেশে ডলার আনার কথা ছিল। উলটো বরং দেখলাম একটি ব্যাংকের মালিক ব্যাংক ‘খোলাসা’ করে বিদেশে পালিয়েছে।

আবার আরেকটি দিকও আছে। দ্বৈত নাগরিকত্ব ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে আমরা বিদেশিদের স্বার্থে কাজ করছি। বিদেশিদের দরকার ডলার, শিক্ষিত লোকজন। আমাদের নীতির ফলে তারা ডলারও পাচ্ছে, শিক্ষিত লোকজনও পাচ্ছে। আমাদের মতো দেশ থেকে যারাই ডলার নিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে তারা নাগরিকত্ব দিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা ভুগছি পুঁজির অভাবে। চোর, গুন্ডা, বদমায়েশের সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে মেধাসম্পন্ন লোকজন নিয়ে নিচ্ছে। সঙ্গে পাচ্ছে ডলার, অর্থাৎ পাচারকৃত সম্পদের উপকার। দুদিক থেকে তারা উপকৃত হচ্ছে। তাদের সেবা করে আমাদের মধ্যবিত্তরা ভাবছে, তারা সমাজে ‘উপরে’ উঠছে। তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ছে। এই মনোজাগতিক সমস্যা থেকে মুক্তির পথ কী?

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম