দেশপ্রেমের চশমা
অবসরের পরও শিক্ষকতা করা যায়

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ দিনটি কয়েক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দিক দিয়ে এর গুরুত্ব বেশি। এ দিন সরকারি ও বিরোধী দলগুলো ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকে। সংঘাতের কারণে রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। পুলিশ বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার শুরু করে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, জনগণ সেসব নিয়ে ভাবছেন। অন্য কোনো লেখায় এ বিষয় বিশ্লেষণ করব। এ প্রবন্ধে শিক্ষকতা জীবনের কিছু ব্যক্তিগত বিষয় আলোচিত হবে। ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল আমার চাকরিজীবনের শেষ দিন। ওইদিন থেকে আমার এলপিআর শুরু হয়। আর ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের আন্দোলনমুখর দিনে এলপিআর শেষ হয়ে আমার চার দশকের শিক্ষকতা জীবনের অবসান ঘটে। সবাই বিষয়টিকে এভাবে দেখলেও আমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। আমি অবসরগ্রহণকে শিক্ষকতাজীবনের পরিসমাপ্তি ভাবি না। আমার দৃষ্টিতে একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকের অবসর নেওয়ার সুযোগ নেই। তার শিক্ষকতা আমৃত্যু চলতে থাকে। যে এক বছর আমি এলপিআরে ছিলাম, সে সময়টায় আমি ক্লাস নেইনি। একেবারেই যে ক্লাস নেইনি, তা নয়। অতিথি শিক্ষক হিসাবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগে কয়েকটি লেকচার দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পরে তাদের অনেকে আমাকে ফোন করেছেন। আমিও তাদের দু-চারজনকে ফোন করেছি। লেখাপড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক নতুন তথ্য জেনেছি। তারাও আমার কাছ থেকে একাডেমিক জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়েছেন। ডিজিটাল যুগের সুবিধা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে।
চার দশকের শিক্ষকতাজীবনে আমি শ্রেণিকক্ষেই সময় কাটিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত বর্ণের রাজনীতিতে জড়িত না হওয়ায় অন্য কোনো দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাইনি। এজন্য আমি শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় দিতে পেরেছি। কোনো শিক্ষার্থীই আমার কাছে এসে ফিরে যাননি। আমার অফিসকক্ষের দরজা ছাত্রছাত্রীদের জন্য সবসময় খোলা থেকেছে। নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আমার কাছে এসেছেন। তারা কেবল লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করেননি, অনেক ব্যক্তিগত বিষয়ও শেয়ার করেছেন। ফলে তাদের সঙ্গে আমার মধুময় সময় কেটেছে। এ কথা সত্য, সব ছাত্রছাত্রীর সব সমস্যা সমাধান করতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি। পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে মনমরা-হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীকে কীভাবে আবার নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে ভালো করা সম্ভব, সে বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছি। কফি-শিঙাড়া খাইয়ে, মনমানসিকতা বুঝে বন্ধুর মতো আচরণ করে তাদের নতুন করে লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ করেছি। আমার বিশ্বাস, আমার সংস্পর্শে আসা হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা আমার পরামর্শ শুনে উপকৃত হয়েছেন। আমার সঙ্গ উপভোগ করেছেন।
শিক্ষকতাজীবনে সবসময় ভাবতাম, শিক্ষার্থীরা আছেন বলেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীরাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা যেন উপভোগ্য হয়, সেজন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত। এ কারণে আমি শ্রেণিকক্ষের এবং বিভাগের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। ক্যাম্পাসের রাস্তায় চলাচল করার সময় পাশের ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে আমি সবসময় কথা বলেছি। তাদের জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। সদ্য পরিচিত অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীকে নিজকক্ষে কফি খেতে ও গল্প করতে ডেকেছি। অনেকে এসেছেন। অনেকে আসেননি। আমি শিক্ষকতাজীবনের শেষ দিকে কিছুদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাস করেছি। ওই সময় ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষক বাসে না চড়ে আমি সাধারণত কাটা পাহাড়ের মনোরম রাস্তা দিয়ে হেঁটে বিভাগে যাওয়া পছন্দ করতাম। এতে আমার চার-পাঁচ মিনিট হাঁটা হতো। ভালো লাগত। এ ক্ষেত্রে আমি দেখতাম, শিক্ষার্থীরা অপরিচিত শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না। পাশ কাটিয়ে চলে যেতেন। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে সংকোচ ও জড়তা কাজ করত। সেজন্য আমি সবসময় নিজে যেচে তাদের সঙ্গে আলাপ শুরু করতাম।
আমার আলাপের প্রথম দুটি বাক্য অধিকাংশ সময় এমন হতো : কেমন আছেন বাবা? আপনি কোন বিভাগে পড়েন? অথবা কেমন আছেন মামণি? আপনি কোন বিভাগের ছাত্রী? যেহেতু আমি প্রায় প্রতি বিভাগের দু-চারজন শিক্ষককে জানতাম, সেজন্য এমন প্রশ্নের জবাব পেলে তাদের আরও সহজ করে নিতে বলতাম, ওমুক স্যার কি আপনাদের কোনো ক্লাস নেন? উনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এভাবে শিক্ষার্থীকে সহজ করে নিয়ে তার এবং তার বিভাগের খোঁজখবর নিতাম। কথা বলতে বলতে মিনিটচারেক হেঁটে শহিদ মিনারের কাছে এলে বলতাম আপনি তো সোজা যাবেন, আমি ডানে আমার বিভাগে যাব। আপনার ক্লাস কখন শুরু হবে? তিনি যদি বলতেন স্যার, আমার ক্লাস শুরু হতে এখনো সময় আছে, আমি সে সুযোগ নিয়ে বলতাম, আপনার আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গে আমার অফিসে আসতে পারেন। আরও কিছুক্ষণ গল্প করে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। এমন প্রস্তাবে অনেকে অবাক হতেন, আসতে চাইতেন না। ধন্যবাদ দিয়ে চলে যেতেন। আবার কেউ কেউ আসতেন। আমি তাদের যত্ন করে রুমে বসিয়ে কফি আর শিঙাড়া খাইয়ে গল্প করে আনন্দ পেতাম। অনেক অজানা তথ্য তাদের কাছ থেকে জানতে পারতাম। এভাবে গল্প করা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আমার কাছে একটি না পড়া উপন্যাসের মতো মনে হতো। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে পারলে এসব উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো তথ্য জানা যেত।
এলপিআরে যাওয়ার পর এমন কোনো দিন কি আমি পার করতে পেরেছি, যেদিন আমার সঙ্গে কোনো বর্তমান বা সাবেক শিক্ষার্থীর কথা হয়নি? আমার তো মনে হয় কদাচিৎ এমন দিন গিয়েছে। নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও আমাকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ফোন করেছেন। আমার লেখালেখির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। এদের বেশিরভাগই সমাজবিজ্ঞান ও কলা অনুষদের শিক্ষার্থী। তবে বিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান বা অন্য কোনো অনুষদের শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যক্রমভুক্ত কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেননি। আমার সেসব বিষয়ে আলোচনার যোগ্যতাও নেই। এ কথা ঠিক, আমি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে রুটিন অনুযায়ী ক্লাসে যাচ্ছি না। তবে বিশেষ করে রাতের বেলায় হোয়াটসঅ্যাপে এবং মেসেঞ্জারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। প্রশ্নের জবাব জানা না থাকলে ওই বিষয়ে যিনি ভালো জানেন এমন শিক্ষকের ফোন নম্বর জোগাড় করে দিচ্ছি। আবার সে শিক্ষককে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর নাম বলে তাকে সহায়তা করতে অনুরোধ করছি। এভাবে আমার ভিন্নরকম শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তবে দিনের বেলায় বৈষয়িক কাজের ব্যস্ততায় কেউ ফোন করলে আমি তাকে সময় দিতে না পারলে রাতে ফোন করতে অনুরোধ করছি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে, যখন রাতে বিদেশ থেকে কোনো শিক্ষার্থী ফোন করে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। বলেন, স্যার আমি আপনাকে অনেক মিস করি। আপনাকে ভুলিনি। তাদের এমন কথায় আমার কণ্ঠ ভারি হয়ে যায়। চার দশক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিয়ে পড়িয়েছি। আমার ধারণা, যারা আমার ক্লাস করেছেন, তারা আমাকে মনে রেখেছেন।
এলপিআরে যাওয়ার পর আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন না কেন? কেউ কেউ একটু বাড়িয়ে বলেছেন, আপনি তো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে পারেন। চেষ্টা করছেন না কেন? আমি বলেছি, আমার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই। আমি উপাচার্য হতে চাই না। তারা অবাক হয়েছেন। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য প্যানেলে নাম দেওয়ার জন্য আমার সিভি চাওয়া হলে আমি রাজি হইনি। বলেছি, এলপিআরে থাকাকালীন আমি যে বেতন পাচ্ছি, আপনারা তো আমাকে তার চেয়ে খুব বেশি বেতন দেবেন না। হয়তো ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি দেবেন। এর জন্য আমি বাড়তি চাপ নিয়ে রাতের ঘুম নষ্ট করতে চাই না। তারা অবাক হয়ে বলেছেন, আমাদের কাছে উপাচার্য হতে লোকজন এসে তদবির করছেন, আর আপনি বলা সত্ত্বেও সিভি দিতে চাইছেন না! আমি বলেছি, যারা উপাচার্য হতে লালায়িত, তাদের মধ্যে কারও কারও হয়তো নিয়োগ বাণিজ্য করে বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার বাসনা থাকতে পারে। আমার তেমন ইচ্ছে নেই। একজনকে বলেছি, উপাচার্য হওয়ার দরকার নেই, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে যাব। ক্লাসে একটি লেকচার দেওয়ার সুযোগ দিলে খুশি হব। খুলনায় দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একটি বিভাগে আমি চলমান রাজনৈতিক সংকটের ওপর শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী লেকচার দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে সাড়া পাইনি। তারা ভেবেছেন, আমি রাজনীতির শিক্ষক, না জানি কী বলতে কী বলি। সেজন্য আমার অনুরোধ এড়িয়ে গিয়ে তারা ঝুঁকিমুক্ত থেকেছেন।
চার দশক শিক্ষকতা করে নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। সুস্থ শরীরে চাকরিজীবন শেষ করতে পারায় আমি মহান আল্লাহ সুবহানাতায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। শিক্ষকতাজীবনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমি যে সমাদর ও সম্মান পেয়েছি, তার জন্য আমি তাদের কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এখনো অবসর জীবনে শিক্ষার্থীরা আমাকে স্মরণ করেন, আমাকে দেখতে আসেন। সেজন্য আমি তাদের কাছে ঋণী। তারা ছিলেন বলেই তো আমি শিক্ষকতা করতে পেরেছিলাম। আমার মনে হয়, আমি এখনো অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকতা করছি। বৈষয়িক ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করছি ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সময় পেলে কথা বলছি। এভাবেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসাবে প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের দোয়ায় সুস্থ শরীরে ব্যস্ততার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। আমার সর্বশেষ প্রকাশনা ‘শিক্ষকতা পেশা ব্যতিক্রমী নেশা’ (২০২২) বইটি পড়লে শিক্ষক হিসাবে আমার দায়িত্ব পালন এবং শিক্ষকতাবিষয়ক অন্য বিষয়গুলো আমাকে ভালোভাবে না জানা শিক্ষার্থী ও সম্মানিত পাঠকরা অনুধাবন করতে পারবেন। কাজেই যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন আমি হয় আনুষ্ঠানিকভাবে, না হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকতা করে যাব। শিক্ষকতা থেকে কখনো অবসর নেব না, যদিও ২৮ তারিখের পর থেকে আমার পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : সাবেক অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com