পোশাক শিল্পে নৈরাজ্য কাম্য নয়
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নৈরাজ্য সৃষ্টির এক ধরনের পাঁয়তারা লক্ষ করা গেছে, যার পেছনে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে। দেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আহরিত হয় তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে। সৌহার্দ-সম্প্রীতি-পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এ শিল্পের প্রসার ও বিস্তার কর্মসংস্থানের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে। নগর-গ্রামীণ জনপদে বিশেষ করে কর্মক্ষম নারীদের কর্মপযোগী করার অপার সম্ভাবনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে এ শিল্প সর্বত্রই সমাদৃত। স্বল্পশিক্ষিত নারীরা অল্প সময়ের মধ্যে কারিগরি দক্ষতায় নিজেদের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে এ শিল্পকে করেছেন অধিকতর সমৃদ্ধ। বিশ্ববাজার ব্যবস্থা পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট, নানা প্রতিকূলতা ও অসম প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ একক দেশ হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের বাজার হিস্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ২০২২ সালে ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানির ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালে বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ হিসাবমতে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের ২০২২ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে দেশটির বাজার হিস্যা ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বিপরীতে ২০২২ সালে হয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বরাবরের মতো বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে আছে চীন। ২০২২ সালে চীন ১৮২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, যা মোট বাজারের ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের তুলনায় দেশটির বাজার হিস্যা কমেছে।
শিল্পে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জোগানে বিশাল বিনিয়োগ, কাঁচামাল আমদানি এবং স্টক লটখ্যাত বিভিন্ন ঝুঁকি সামাল দিয়ে রপ্তানি বাজারে মালিকপক্ষের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণ এবং ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে অনেকেই ঋণখেলাপি হিসাবে বিবেচিত। অনেক প্রতিষ্ঠানকে এ বাণিজ্যে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসংগতি এবং উসকানিমূলক অপকৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক পোশাক কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্যাদির গভীরে প্রোথিত আনুষঙ্গিক জটিলতাগুলো ধারণায় আনা না হলে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাগুলো অনাবিষ্কৃত থেকে যাবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত করে পোশাক শিল্পে অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড চালিয়েছে কতিপয় সুযোগ সন্ধানী। মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন যৌক্তিকতা পায় তখনই, যখন মালিকপক্ষের অর্ডার ও আয়-উপার্জনে ভারসাম্য বিরাজ করে।
সম্প্রতি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ঢাকার দুটি বিশেষ অঞ্চলে তাণ্ডব চালানো হয়। শিল্প-কারখানায় আক্রমণ, গণপরিবহণ ভাঙচুরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কতিপয় শ্রমিক নামধারী উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসীর মারমুখী আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রমিকদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে, তারা কর্মহীন অবস্থান থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়ে শ্রমজীবী মানবসম্পদে পরিণত হয়েছেন। মাস শেষে বেতন, ওভারটাইম মজুরি, উৎসব ভাতা ও অন্যান্য প্রদেয় সুবিধা ভোগ করে নিজ পরিবারকে জীবিকা নির্বাহে আর্থিক জোগান দেওয়ার বিষয়টি শ্রমিকদের উপলব্ধি করতে হবে। এদের অধিকাংশ সম্ভবত কম শিক্ষিত হওয়ার কারণে তেমন কোনো শিল্প-কারখানায় উপযুক্ত কর্মসংস্থান জোগাড়ে অপারগ। মহান স্রষ্টার অপার কৃপায় মালিকপক্ষের বিনিয়োগের কারণে তারা পোশাক শিল্পে কর্মরত থেকে উপার্জন ও সাবলীল জীবন নির্বাহ করতে পারছেন। অন্যদিকে এদের মনোজগতে মালিকদের বিপক্ষে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে তৎপর কথিত শ্রমিক সংগঠনের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বৈশ্বিক বা দেশীয় চলমান মন্দাভাব বা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে রপ্তানি খাতকে নিরাপদ রাখার বিষয়ে তাদের এক ধরনের অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি শত্রুদের যোগসাজশে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাকশিল্পকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে অশুভ প্ররোচনা চালানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে শ্রমিকপক্ষের আচরণ অনেক ক্ষেত্রে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায়। অগ্রহণযোগ্য এসব কর্মকাণ্ডে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর ৭ নভেম্বর কারখানা মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মজুরি বোর্ডের বৈঠক শেষে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবুও শ্রমিকদের কয়েকটি অংশ মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। চলতি মাসের ১৬ তারিখ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা-ন্যায্যতা ও প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে। এ খাতে মজুরি নিয়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনায় সংস্থাটির উদ্বেগ প্রকাশও হতাশাব্যঞ্জক। আরও প্রাণহানি ও জীবিকার ক্ষতি এড়াতে শান্ত-সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নিতে আইএলও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে উৎসাহিত করে। পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পর বিভিন্ন পক্ষের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সঙ্গে বিজিএমইএ’র বৈঠকে পোশাক খাতের মজুরির ৫টি গ্রেড কমিয়ে ৪টি করা হয়েছে। কিন্তু গ্রেড-৪-এর র্নিধারিত ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা অপরিবর্তিত রেখে বাকি ৩ গ্রেডে বাড়ানো হয়েছে।
১৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রমঅধিকার ও তাদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন অধিকার ও উচ্চ শ্রমমান উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ নতুন নীতির ঘোষণায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারক, বিশেষ করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, কোনো কারণে শ্রমঅধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন নীতি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর করলে দেশের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিজিএমইএ’র নেতাদের মতানুসারে, আগে থেকেই এ খাতের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। সেসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেই গার্মেন্ট শিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হিসাবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। এ শিল্পে সুন্দর কর্মপরিবেশ বিরাজ করছে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে কুচক্রী মহল তাদের অপতৎপরতা বাড়িয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত এক দশকে গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার নামে শতাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে প্রায় দেড় ডজন রয়েছে ফেডারেশন। বেশিরভাগ সংগঠনের নিবন্ধও নেই। এসব সংগঠনের নেতাদের বেশিরভাগই গার্মেন্ট কারখানার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এসব ব্যক্তি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের হয়ে কাজ করছে। তারাই মূলত শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে নিজেরা কদর্য উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যস্ত। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের চিহ্নিত নেতাদের অনেকেরই বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিষয়ে জনশ্রুতি রয়েছে। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা এবং ডিসেম্বর থেকেই বর্ধিত বেতন কার্যকরণে সরকার-মালিকপক্ষ-শ্রমিক সবাই একমত পোষণ করার পরও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো সহিংস ঘটনা ঘটায় এসব তথাকথিত শ্রমিক নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে শ্রমিক-নেতা নামধারী ৩৬ জনের তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। তাদের মোবাইল ফোন রেকর্ডসহ বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা বেতন বৃদ্ধির বিষয়টিকে পুঁজি করে নানা উসকানি দিয়ে গার্মেন্ট শিল্পে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এসব নেতা গার্মেন্টসে চাকরি করেন না, গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গেও জড়িত নন। কিন্তু তারা স্বার্থান্বেষী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট নেতা। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক সংগঠনের নামে কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকেন। ওইসব দেশ তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী গার্মেন্টস শ্রমিকদের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। মোদ্দাকথা, বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবননির্বাহের অবলম্বনকে বিপদগ্রস্ত করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে সব পক্ষকে দেশের রপ্তানি আয় অধিকতর সমৃদ্ধ করার জন্যই সম্মিলিত উদ্যোগকে সচল রাখতে হবে। অন্যথায় দেশের অন্যান্য খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়