Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের বাধা দূর করতে হবে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের বাধা দূর করতে হবে

বাংলাদেশের শিক্ষার কারিকুলাম ও সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। কারিকুলাম বলতে আমরা বুঝি একটি স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব কোর্স অধ্যয়নের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, বিদ্যমান কারিকুলাম অনুযায়ী কোনো একটি বিষয় পড়ানো হচ্ছে না। যখন কোনো বিষয় পড়ানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন আমরা বলি, কারিকুলামে নতুন বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, সমাজবিদ্যা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় আছে যাকে বলা হয় সিলেবাস। সিলেবাস হলো, সুনির্দিষ্ট একটি কোর্সে যা কিছু অধ্যয়ন করতে হয়। অনেক সময় আমরা বলি, পদার্থ বিদ্যার সিলেবাসটি খুবই ব্যাপক।

বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ পঞ্চম শ্রেণিতে কোনো পাবলিক পরীক্ষা ছিল না। পঞ্চম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়েছিল এবং সে পরীক্ষা কয়েক বছর চালু ছিল। একইভাবে অষ্টম শ্রেণিতেও কোনো পাবলিক পরীক্ষা ছিল না। সেখানেও পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়। এ পরীক্ষাটি জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা নামে পরিচিতি পায়। মোদ্দা কথা হলো, কোমলমতি শিশুরা একের পর এক পরীক্ষা নামের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে। এছাড়া পরীক্ষার ফল মূল্যায়নেও পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন সনাতন শ্রেণি বা বিভাগের পরিবর্তে গ্রেডিং সিস্টেম নামে পরিচিত। কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর জিপিএ ফাইভ অথবা জিপিএ গোল্ডেন নিয়ে এক ধরনের মাতামাতি চলতে দেখেছি।

যে কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কিছু লক্ষ্য থাকে। এ লক্ষ্য অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন করেন। প্রাচীন গ্রিসে শরীরচর্চা শিক্ষার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল। সেখানে সেকালে প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ হতো। যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য নাগরিকদের প্রস্তুত করে তোলা ছিল শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। তার মানে এই নয়, তাত্ত্বিক বা গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো পড়ানো হতো না। জ্ঞানের গভীর বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা হওয়ার ফলে প্রাচীন গ্রিসে দর্শনশাস্ত্র প্রভূতভাবে বিকশিত হয়। শিক্ষার লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সিলেবাস ও কারিকুলাম চালু করতে অত সময়ের প্রয়োজন হয় না।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে। ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে শুধু একাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে। ২০২৭ শিক্ষাবর্ষে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে।

প্রাক-প্রাথমিক স্তর হবে ২ বছরের জন্য, যা ২০২২ পর্যন্ত ছিল ১ বছরের। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে থাকছে না সরকার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই পড়াবেন তাদের নিজেদের মতো করে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে না কোনো পরীক্ষা। ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে শ্রেণিতে শেখার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করা হবে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই থাকবে ৩টি। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয়ের ৮টি বই থাকবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয়ের ১০টি বই থাকবে।

এতদিন ধরে চলে আসা পরীক্ষার বাইরে মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন সামষ্টিক উপায়ে। উঠে যাচ্ছে পিইসি, এবতেদায়ি ও জেএসসি/জেডিসি নামের পাবলিক পরীক্ষা। শিখনকালীন মূল্যায়নের ধরন হচ্ছে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ এবং হাতেকলমে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। নবম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ। একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ। এসএসসি পরীক্ষা আর আগের মতো নবম-দশম শ্রেণির বই মিলিয়ে হবে না। শুধু দশম শ্রেণির বই ও সিলেবাস অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে শিক্ষার্থীদের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। মাধ্যমিক পর্যায়ে থাকছে না বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য শাখা। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাজন চালু করা হয়েছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে। অনেকে মনে করেন, শিশুদের এ পর্যায়ে লেখাপড়ার শাখা বেছে নিতে বলা ছিল অপরিণত ও মানসিক প্রস্তুতিহীন অবস্থায়। ২০২৩-এর শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের শাখা পছন্দ করতে পারবে একাদশ শ্রেণিতে। এমন ব্যবস্থা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে চালু ছিল। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত হবে পৃথক দুটি পরীক্ষা। এ দুই শ্রেণির পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসি পরীক্ষার ফল নির্ণয় করা হবে। সৃজনশীল ও গ্রেড পদ্ধতি উঠে যাবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে তিনটি স্তরে। যথাক্রমে প্রথম স্তর অর্থাৎ এলিমেন্টারি, দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ মিডল লেভেল এবং তৃতীয় স্তর অর্থাৎ এক্সপার্ট লেভেল। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে দুদিন। এ লেখায় নতুন শিক্ষাক্রমসংক্রান্ত তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একজন শিক্ষাবিদের বর্ণনা থেকে।

বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ২০১৬ সালে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। এ সাবকমিটিগুলো ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর শিক্ষা কারিকুলামসংক্রান্ত ৮ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করে। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বলেন, ‘আমাদের কারিকুলাম পুরো পর্যালোচনা হচ্ছে। শিগ্গির চূড়ান্ত করা হবে।’ ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী পরিমার্জিত কারিকুলামের প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদন করেন। এরপর শিক্ষামন্ত্রী পরিমার্জিত কারিকুলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা এবং শ্রেণিকক্ষেই পাঠদান সম্পূর্ণ করার ব্যবস্থা রেখে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে। শিক্ষাক্রম হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, পড়াশোনা হবে আনন্দময়। বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা এবং চাপ কমানো হবে। মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভরতার বিষয়টি যাতে না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখানোর ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। শিক্ষার্র্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অন্যান্য বিষয়, যেমন জীবন-জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সাংস্কৃতিক শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ।

শ্রেণিকক্ষেই পাঠ্য বিষয় আত্মস্থ করার চর্চা উন্নত পাশ্চাত্য দেশগুলোতে চালু রয়েছে। এর জন্য সেসব দেশে নানা ধরনের আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা চিন্তাভাবনা, আচরণ ও জ্ঞানের দিক থেকে হয়ে থাকেন অতি উন্নতমানের। এমন শিক্ষক ও শিক্ষিকারা বিদ্যালয়ে শিশুদের নিয়ে আনন্দময় বাগান সৃষ্টি করেন। শিশুরা এমনভাবে শিখে, যাতে তারা কোনো ধরনের ভার বা চাপ অনুভব না করে। সব কিছুতেই তারা আনন্দ খুঁজে পায়। শিশুরা কতটা শিখছে তার মূল্যায়ন শ্রেণিকক্ষেই হতে পারে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে উপস্থাপন, আলোচনা-পর্যালোচনা এবং সিন্ডিকেট করে তর্ক-বিতর্ক করার ব্যবস্থা চালু আছে। এ চর্চা প্রত্যক্ষ করে অধ্যাপক ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করেন। সেমিস্টারজুড়ে একাধিক মূল্যায়নের ফল লিখিত পরীক্ষার ফলের সঙ্গে যোগ করে চূড়ান্ত ফল তৈরি করা হয়। এর জন্য অধ্যাপককে হতে হয় প্রত্যুৎপন্নমতি।

বাংলাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত একেবারেই সদৃশ নয়। এর ফলে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে সব শিক্ষার্থীর প্রতি দৃষ্টি দিতে পারেন না। অনেক সময় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি হয় যে, পাঠদানে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে হলে এ ঘাটতি দূর করতে হবে। প্রয়োজন গুণসম্পন্ন শিক্ষকের। আমরা দেখেছি, হঠাৎ করে গৃহে অতিথি এলে সুগৃহিণী গৃহে আপ্যায়নের মতো কিছু না থাকলেও নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা খরচ করে অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। ঠিক তেমনি নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের জন্য তেমন গুণসম্পন্ন শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। সর্বোপরি নতুন ব্যবস্থায় পাঠদানের জন্য শিক্ষক তৈরি করতে প্রয়োজন হবে ব্যাপক এবং মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের। শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা উপকরণ যথাযথভাবে জোগান দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ। সঠিকভাবে দুর্নীতিমুক্তভাবে এবং সঠিক তত্ত্বাবধানে এমন বিনিয়োগ করা সম্ভব হলে পরিকল্পিত ব্যবস্থা থেকে সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।

দেশে একটি নতুন কারিকুলাম চালু হতে যাচ্ছে-এ বিষয়টি অনেকের কাছেই অজানা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষার মতো বিষয় দেশবাসীর আগোচরে থাকা মোটেও কাম্য নয়। সুতরাং এ নিয়ে ফলপ্রসূ বিতর্কের সূচনা করে বিষয়টিকে স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান করে তোলা উচিত। এ ব্যাপারে কোনোরকম গাফিলতি জাতির জন্য কল্যাণকর হবে না।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম