সংবিধান তো রক্ষা হলো, এবার হোক সমঝোতা
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র দফায় দফায় সরকার ও বিরোধী দলগুলোকে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। সবশেষ ১৩ নভেম্বর ডোনাল্ড লু তিনটি রাজনৈতিক দলকে এক অভিন্ন বার্তায় শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। সেই একই চিঠির মাধ্যমে দলগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শর্তহীন সংলাপের সঙ্গে ভিসানীতির কথা মনে করিয়ে দেওয়া একটি সতর্কবার্তা। রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় ব্যর্থ হলে তাদের ভিসানীতি আরও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হতে পারে, এটি সেই বার্তাই বহন করে।
মার্কিন ভিসানীতির পর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। যদিও পিটার হাস আজ (১৫ নভেম্বর) আইএমএফের বাংলাদেশ প্রধান জয়েন্দু দে, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেকসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ ভিসানীতির মূল উদ্দেশ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও সরকারের ভূমিকা অনেক বড়। সরকারই তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করে। আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করতে চায়; কিন্তু তারা তাদের দ্বারা পরিবর্তিত বর্তমান সংবিধানের অধীনে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন করেছে। সে দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলেও আন্তর্জাতিকভাবে সে দুটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অর্থাৎ সরকার তথা বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা সরকার নিজেই দুবার প্রমাণ করেছে। কাজেই, আমেরিকা যদি মনে করত যে, সংবিধানের অধীনে এ সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তাহলে তাদের নতুন ভিসানীতি প্রণয়ন করার প্রয়োজন হতো না। পিটার হাসেরও এত দৌড়ঝাঁপ করা লাগত না। কাজেই, সংবিধানের বাইরে গিয়ে সমঝোতার পথ সরকারকেই রচনা করতে হবে। সংবিধান রক্ষা করা যেমন সরকারের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, সুষ্ঠু নির্বাচন করাও তেমনি।
তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান দায় সরকারের হলেও বিএনপির দায়ও কম নয়। বিএনপিকেও সংলাপের ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপির আন্তরিক সহযোগিতা ছিল কিনা সেটাও যাচাই করবে যুক্তরাষ্ট্র। না হলে ভিসানীতি তাদের ওপরও প্রয়োগ হতে পারে।
সরকারের দাবি, অতীতেও তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে, ভবিষ্যতেও তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। তবে, এ নির্বাচন হতে হবে সংবিধানের আলোকে অর্থাৎ সরকারের অধীনেই। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। দুই পক্ষের এ বিপরীতমুখী অবস্থানের মাঝামাঝি কোনো পথ নেই; কিন্তু তারপরও আমাদের সমঝোতার ওপরই গুরুত্ব দিতে হবে। সে সমঝোতা যেভাবেই হোক না কেন। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে তা সংবিধানসম্মত করে নেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ১৯৯১-এর তিন জোটের রূপরেখা বা ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংশোধনী তার উত্তম নজির।
সমঝোতা যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। দিন যত যাবে, সমঝোতা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। সংসদ অধিবেশ শেষ হয়ে যাওয়া ও তফশিল ঘোষণা সমঝোতার পথকে আরও কঠিন করে ফেলল সন্দেহ নেই। যদিও শেষমেশ সমঝোতা হলে কোনো বাধাই আর থাকবে না, এটাও সত্যি। সংবিধান অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদপূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন তফশিল ঘোষণা করেছে। তফশিল অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি ভোট। কমিশন এখন দিনক্ষণ গুনে নির্বাচনের দিকে এগোবে। সরকার একদিকে সমঝোতার কথা বলছে, আবার অন্যদিকে ইসি তফশিল ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি উপলব্ধি করে তফশিলের আগেই কমিশন ও সরকারকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছিল; কিন্তু সেটি সফল হয়নি। সরকার বলছে, এখন আর সংলাপের কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু তফশিলের পরে সংলাপ করা যাবে না তা সঠিক নয়। তফশিলের বিষয় হচ্ছে নির্বাচনের দিনক্ষণ আর সংলাপের বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার। কোনো নির্বাচন কমিশনার, এমনকি সিইসি পদত্যাগ করলেও ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী নির্বাচন হতে বাধা নেই। আবার সরকার পদত্যাগ করলে বা অন্য কোনো সরকারের (যে নামেই হোক) অধীনে নির্বাচন হলেও তফশিল পরিবর্তনের দরকার নেই। এটি হলো সাংবিধানিক বিধান। আবার প্রয়োজন হলে তফশিল সংশোধন করে পুনঃতফশিলও ঘোষণা করা যেতে পারে।
সংলাপ-সমঝোতার স্বার্থে ২০০৬ সালের পরে বহুবার তফশিল সংশোধন করা হয়েছে। পাশাপাশি সংলাপের চেষ্টাও অব্যাহত ছিল। অবশেষে সে তফশিল অনুযায়ী নির্বাচনও হয়নি এবং সংলাপ অনুযায়ী সমঝোতাও হয়নি। এর ফলে আমরা পেয়েছি ১/১১-পরবর্তী দুই বছরের সেনা সমর্থিত সরকার। কাজেই, তফশিলের অজুহাতে সংলাপের পথ রুদ্ধ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সমঝোতা হলে তফশিল অনুযায়ীই নির্বাচন সম্ভব, আবার তফশিল পরিবর্তনও সম্ভব।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপ নতুন কিছু নয়। আজকে যেমন ডোনাল্ড লু বার্তা দিচ্ছেন, ঢাকা ঘুরে গেছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। ২০০৬ সালে ডোনাল্ড লু’র পদে যিনি ছিলেন (রিচার্ড বাউচার) তিনিও সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পিটার হাসের মতো ২০০৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পেট্রিসিয়া এ বিউটিনেসও দৌড়ঝাঁপ কম করেননি। ১ নভেম্বর (২০০৬) তিনি ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ১৪ দলের পক্ষ থেকে রেডিসন হোটেলে রাষ্ট্রদূতদের জন্য মধ্যাহ্নভোজেরও আয়োজন করা হয়; কিন্তু কিছুতেই সমঝোতা হয়নি।
রাজপথে আন্দোলনরত শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এমএ আজিজকে নির্বাচন কমিশনে বহাল রেখে কারচুপির নির্বাচন করার চেষ্টা করা হলে দেশে আরও রক্ত ঝরবে।...দাবি না মানলে আমাদের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১২ নভেম্বর থেকে লাগাতার অবরোধ শুরু হবে। রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ, বন্দর সব অচল করে দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায় করা হবে’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ নভেম্বর ২০০৬)। এমন একটি পরিস্থিতিতে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ১২ নভেম্বর থেকে ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে বিএনপি সে সময় সিইসি এমএ আজিজের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়। খালেদা জিয়া বলেন, সিইসি যদি পদত্যাগ করেন বা ছুটি নেন, তাতে বিএনপি আপত্তি জানাবে না। বিএনপির এ সম্মতিসূচক বক্তব্যের পরই সিইসি এমএ আজিজ তিন মাসের ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়া বলেন, সংবিধান রক্ষায় সফল হয়েছি। আর শেখ হাসিনা বলেন, আজিজের ছুটি জনগণের বিজয়। (সমকাল, ২৮ নভেম্বর ২০০৬)।
কমিশন নিয়মরক্ষার তফশিল ঘোষণা করেছে; কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচনের লক্ষ্যে সমঝোতা না হলে এ নিয়মরক্ষায় আদতে কোনো সুফল দেবে না। আমাদের সংবিধান রক্ষায় তফশিল ঘোষণার নজির যেমন আছে, আবার সংবিধান রক্ষায় সিইসির চলে যাওয়ার নজিরও আছে। আমরা চাই সরকার থাকুক, বিরোধী দল থাকুক, সিইসিও থাকুক-থাকুক গণতন্ত্রও।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক