তাহলে কেমন নির্বাচন হতে চলেছে?
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফশিলও অচিরেই ঘোষিত হবে। জানুয়ারির শুরুর দিকে ভোটের দিন ধার্য করা হবে বলে খবর রয়েছে। সেদিন গভীর রাতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কারা জয়ী হতে চলেছে। তবে প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দলই যে পুনরায় সরকার গঠন করবে, সেটা ধরেই নেবে মানুষ। এ ধরনের নির্বাচনে সাধারণত কোনো আকর্ষণ থাকে না। মানুষ বরাবরই চায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল অংশ না নিলেও কিছু আসনে হয়তো তেমন নির্বাচন হবে একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী থাকায়। যদিও সেটা জাতীয়ভাবে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ঘটনাধারায় ইতোমধ্যে পরিষ্কার, প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে না। প্রধান সব দল অংশ নিলে কেমন হয় নির্বাচনের পরিবেশ, সেটা আমাদের জানা আছে। তবে দেশের একটি তরুণ জনগোষ্ঠী তেমন পরিবেশ এখনো দেখতে পায়নি। কেননা বিগত দুটি নির্বাচন স্বাভাবিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। এবারকার নির্বাচনেও স্বাভাবিক পরিবেশ নেই, তা ইসি যা-ই বলুক না কেন। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করার ‘বাধ্যবাধকতা’য় নিকট অতীতে তারা যা-ই বলুন না কেন, এখন বলছেন-নির্বাচন আয়োজনে কোনো সমস্যা নেই। নির্বাচন আয়োজনে সমস্যা নেই; তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সমস্যা রয়েছে। নিয়মমাফিক নির্বাচন করাই ইসির কাজ কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। যারা এ প্রশ্ন তোলেন, তারা বলেন-সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই ইসির দায়িত্ব। তেমন নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে তারা কি সেটা বলে তফশিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকতে পারেন? এমন দাবি কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে ইসির উদ্দেশে জানানো হয়েছে। সংবিধানবেত্তারাই এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারবেন।
ইসি অবশ্য নির্বাচন আয়োজনের দিকেই এগোচ্ছে। তাদের মধ্যে এ নিয়ে বড় মতপার্থক্য রয়েছে বলেও শোনা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার যে কোনো মূল্যে নির্বাচনটা সেরে ফেলতে চায়। ২৮ অক্টোবরের ঘটনাবলির পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও চলে গেছে হরতাল-অবরোধে। সরকারও দলীয় লোকজন ও প্রশাসন দিয়ে তাদের প্রতিহত করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনটাই যেন বাস্তবতা!
দলীয় ফোরামে সরকারের তরফ থেকে অবশ্য কর্মীদের সাবধান করে বলা হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিতে পারে বিএনপি। সেটা কোন বিএনপি, এ প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর একটা চেষ্টা আছে বলেই প্রশ্নটি ওঠে। অভিজ্ঞতার নিরিখে মনে হয় না এতে বড় কোনো ফল মিলবে। এর চেয়ে বরং চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে নিজেদের প্রার্থী মনোনয়নে ভিন্নতা আনার। একশ আসনে অন্তত ‘নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন’ আয়োজনের। এতে অবশ্য সহিংসতার শঙ্কা বেড়ে ওঠে। দেশ যেভাবে পরিচালিত হয়ে এসেছে, তাতে প্রার্থী মনোনয়নে অর্থবহ পরিবর্তন আনাও কঠিন। জাতীয় সংসদ কালক্রমে যাদের কবজায় চলে গেছে-ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছায় এটাকে তাদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকলেও তা সম্ভবত ব্যর্থ হবে।
বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন করে ফেলতে হলেও তাতে ভোটার বাড়ানোর একটা পরিকল্পনার কথা মাঝে শোনা গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই তো নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হবে। প্রধান সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে যে কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছিল, সেটার জবাব দিতে গিয়েই ওই বক্তব্য দেওয়া হয়। তবে বাস্তবতা হলো, যেসব দলের উল্লেখযোগ্য ভোট রয়েছে-তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া ভোটার উপস্থিতি বাড়তে দেখা যায় না। অতীতের চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যে যেটিতে বিএনপি সবচেয়ে কম আসন পায়, সেই ২০০৮ সালেও দেখা যাচ্ছে তার ভোট প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আর যে নির্বাচনে দলটি সবচেয়ে বেশি আসন পায়, সেই ২০০১ সালে ভোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশেরও বেশি। গত ১৫ বছর একই দলের সরকার দেশ পরিচালনা করায় তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে বিএনপির ভোট আরও বেড়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। এমন একটি দল নির্বাচনের বাইরে থাকলে তাতে ভোটারের অংশগ্রহণ কেমন থাকবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের ভোটাররাও দলে দলে কেন্দ্রে আসবে না এটা নিশ্চিত জেনে যে, নির্বাচনে কী হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপনির্বাচনে সে চিত্র আমরা দেখতেও পেয়েছি।
এ বাস্তবতা সামনে রেখেই বোধহয় দলীয় ফোরামে বলা হয়েছে, নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়তে হবে-এমন কোনো বিধান নেই। ভোটের হার বাড়িয়ে দেখাতে গিয়ে কারচুপির আশ্রয় নেওয়া যাবে না বলেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে সতর্ক করাটা জরুরি বৈকি। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া দুটি উপনির্বাচনে নৌকা মার্কায় সিল মারার যে ভিডিও কনটেন্ট ‘ভাইরাল’ হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুটির গেজেট প্রকাশ স্থগিত করতে হয়েছে ইসিকে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এমনতর ঘটনা ইসি ও সরকার উভয়ের জন্যই বিশেষ অসুবিধাজনক। সংসদের মেয়াদ শেষের মুহূর্তে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনেও যখন এসব ঘটে-তখন বিরোধী পক্ষের বলার সুযোগ বেড়ে যায় যে, ঠিক কী কারণে তারা আগামী নির্বাচন বর্জন করছে।
দলীয় সরকারের অধীনে হতে যাওয়া নির্বাচনটি প্রতিহত করারও চেষ্টা চালাবে তারা। তফশিল ঘোষণার পর আন্দোলন আরও জোরদারের চেষ্টা থাকবে। সরকারপক্ষ অবশ্য মনে করে, ততদিনে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ফুরিয়ে যাবে। এ অনুমান যে একেবারে ভুল, তা মনে হয় না। ১৫-১৭ বছর টানা চাপে থাকা বিএনপির পক্ষে আর কত শক্তি প্রদর্শনই বা সম্ভব! অপরদিকে কেবল দক্ষ নজরদারির কারণেই পুরোনো ধাঁচের আন্দোলন রচনা এখন কঠিন। প্রশাসনও অদৃষ্টপূর্ব মাত্রায় অনুগত এবং আন্দোলন দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অবস্থায় বিএনপি ও তার মিত্ররা অবশ্য সাধ্যমতো বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। ভোটের দিনও হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকবে নিশ্চয়ই। তাতে জনমনে ভয়ভীতি থাকায়ও ভোট পড়বে সীমিত প্রত্যাশার চাইতেও কম।
অবশ্য শোনা যাচ্ছে, এরই মধ্যে ভোটারদের উৎসাহিত করে, খাতির করে কেন্দ্রে নিয়ে আসার কিছু উদ্যোগ থাকবে। তাতে ক্ষেত্রবিশেষে ভোটের হার বাড়লেও জাতীয়ভাবে সেটা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু হবে না। সত্যি বলতে, আইনশৃঙ্খলার বেশি অবনতি ঘটতে না দিয়ে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সেরে ফেলার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে সরকার। অগত্যা ইসিরও উদ্দেশ্য হবে এটাই। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীক না দিয়ে ‘যে জিতে আসতে পারো আসো’ বলে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। আরেকটি মেয়াদের জন্য সরকার গঠনটাই যদি লক্ষ্য হয়, তাতে কোনো ‘রোমান্টিসিজম’ না রাখাই সংগত বলে বিবেচিত হবে।
অতীতে যে দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে-তা থেকে কী কী ভিন্নতা মিলল পরবর্তী নির্বাচনে, সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই কিছু আলোচনা হবে। অবশ্য এখনো কেউ কেউ মনে করেন, শেষতক পরিস্থিতি বদলাবে; ভিন্নরকম একটি নির্বাচন হবে এবার। তারা অদম্য আশাবাদী। এরা মনে করেন, ‘বাইরের চাপে’ শেষ পর্যন্ত নির্বাচন ঠিকই অংশগ্রহণমূলক হবে। হয়তো তফশিল ঘোষণার পরও পিছিয়ে যাবে নির্বাচন। এমনটি তো এদেশে হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়েই যদি ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হতে হয়, সেটা হতে হবে উপযুক্ত মধ্যস্থতায়।
বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা মনে করেন, ‘আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়’ দলটির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। কিন্তু দুপক্ষে ইতোমধ্যে সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছে, তাতে সেটা কতখানি সম্ভব? এটি সম্ভব করে তুলতে হলে দুপক্ষকেই সংযত করতে হবে। প্রথমে সরকারকে। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দ্রুত মুক্তি দিয়ে মামলার ঝড় থামাতে হবে আগে। অতঃপর আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার এবং সংলাপের ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্রক্রিয়াটিও ঝুলে পড়ার কিংবা তাতে অনেক বেশি সময় লেগে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
নির্বাচনের আগেই নতুন কোনো ‘স্যাংশন’ কি আসবে পশ্চিমা মহল থেকে? বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে তারা তো আগ্রহ হারায়নি। দেশের অর্থনীতিতে ঘনায়মান সংকটের দিকেও তাদের দৃষ্টি রয়েছে। তারা চাইতেই পারে, যে কোনো মূল্যে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার আসুক এখানে। এমন সরকারকে হয়তো তারা কিছু সহায়তাও জোগাবে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে। অপরদিকে নির্বাচন খুবই অগ্রহণযোগ্য হলে তারা কী করবে, এর কিছুটা বলা আছে ভিসানীতিতে। অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টির মতো পদক্ষেপও কি তারা নিতে পারে না? এতে সরকার, অলিগার্ক ও জনগণের মধ্যে কে কতটা ভুগবে, স্পষ্ট নয়। এর মানে, নির্বাচনটা কোনোমতে হয়ে গেলেও এতে স্থিতিশীলতা আসার সুযোগ কম। বাংলাদেশের এবারকার নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের নজিরবিহীন আগ্রহটাই আসলে গড়ে দিয়েছে বড় তফাত। তিন মেয়াদে বেজায় শক্তিশালী হয়ে ওঠা সরকার এটা সামলে ফেলতে পারলে অবশ্য ভিন্ন পরিস্থিতিই আমরা দেখতাম।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক