ব্রিকস কি উগ্র পুঁজিবাদকে পরাস্ত করতে পারবে?
রামজি বারুদ
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্রিকস গ্রুপের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাবের কথা বললে তা বাড়িয়ে বলা হবে না। অর্থনৈতিক শক্তির জন্য রাজনৈতিক প্রভাবও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা ব্রিকসের সদস্যরা সম্ভবত আগামী বছরগুলোতে নিয়ন্ত্রণ করবে। গত ৩ নভেম্বর প্রকাশিত ব্লুমবার্গের এক নতুন প্রতিবেদন ব্রিকস সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ব্লুমবার্গ বলেছে, ব্রিকসের পাঁচটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য-ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্য ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৪২২ বিলিয়ন ডলার। ব্রিকস এখন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, কারণ জানুয়ারিতে কয়েকটি নতুন দেশ যেমন-আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই শক্তিশালী গ্লোবাল সাউথ অর্থনৈতিক ক্লাবে যোগ দেবে।
পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক গতিশীলতা
২০২৩ সাল ইতোমধ্যেই ব্রিকসের জন্য একটি ভালো বছর হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। যেমন রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মস্কোকে নতুন বাজারের সন্ধানে, বিশেষ করে তার প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রেলিয়াম পণ্য রপ্তানির জন্য দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছে। যদি প্রবৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকে, তাহলে সম্প্রসারিত ব্রিকস ২০৪০ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেকই অবদান রাখবে। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বলা যায়, আগামী বছরগুলোতে ব্রিকসের অর্থনীতির অংশীদারত্ব জি-৭-এর দ্বিগুণ হবে। এর স্পষ্ট অর্থ হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভাগ্যের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রটির মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে, যা চূড়ান্তভাবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক গতিশীলতায়ও পরিবর্তন আনবে।
যেসব ছোট অর্থনীতি শিগগিরই এ ক্লাবে যোগদান করবে, তারা একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিনের অংশ হতে চায়। ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুটি ধারার নিয়মের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বকে পরিচালনা করে : একটি হলো পারস্পরিক সুবিধা ও সহযোগিতা, যা পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; আর দ্বিতীয়টি হলো নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য এবং কখনো কখনো জবরদস্তি, যা গ্লোবাল সাউথের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্রিকস বুঝতে পারছে, কোনো পশ্চিমা সংস্থা একটি নিখুঁত অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও সমতার ভিত্তিতে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের নিজস্ব বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক এবং বাকি সব প্রতিষ্ঠানের শর্ত থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা যায়।
নতুন বিকল্পের অগ্রগতি
কার্ল মার্কস তার ‘কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘পুরোনো সমাজের গর্ভে উৎপাদনের নতুন উচ্চ সম্পর্ক তার অস্তিত্বের বস্তুগত অবস্থা পরিপক্ব হওয়ার আগে কখনই আবির্ভূত হয় না।’ ব্রিকস সদস্যরা সচেতন যে, ‘উৎপাদনের উচ্চ সম্পর্ক’ কেবল তখনই পরিবর্তিত হতে পারে, যদি পশ্চিম এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে সম্পর্কও পরিবর্তিত হয়। ব্রিকস যখন আধুনিক বিশ্বায়নের প্রকৃতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ, তখন এটি বর্তমানে পুঁজিবাদের একটি নমনীয় সংস্করণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, যা মিল্টন ফ্রিডম্যান এবং তার শিকাগো স্কুল অফ ইকোনমিক্সের ‘শক মতবাদের’ ধ্বংসাত্মক তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়। ফ্রিডম্যান ‘ক্যাপিটাল অ্যান্ড ফ্রিডমে’র ১৯৮২ সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘কেবল একটি সংকট-প্রকৃত বা অনুভূত-প্রকৃত পরিবর্তন আনে।’ ফ্রিডম্যানের তত্ত্বগুলো প্রায়ই ধ্বংসাত্মক নীতিগুলোর সঙ্গে যুক্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশকে অর্থনৈতিক পতন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে গেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, পশ্চিমা দেশগুলোকে তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ধরে রাখার জন্য বাকি বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের মৌলিক কাজ হলো বিদ্যমান নীতির বিকল্প বের করা, যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসম্ভব বিষয়গুলো রাজনৈতিকভাবে অনিবার্য হয়ে ওঠে।’
সম্পর্কের মৌলিক পরিবর্তন
সম্পর্কের এ পরিবর্তনের জন্য ব্রিকসকে গ্লোবাল সাউথের প্রতি পশ্চিমা মতবাদ থেকে রক্ষায় কাজ করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান ব্যক্তি জোসেপ বোরেলের মন্তব্য-‘ইউরোপ একটি বাগান’ এবং ‘বাকি বিশ্ব একটি জঙ্গল’ ২০২২ সালের অক্টোবরের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু অনুভূতিটি রয়ে গেছে।
তবে বোরেলের ধারণা ভুল, একইভাবে ফ্রিডম্যানের ধারণাও ভুল ছিল। তথাকথিত ‘জঙ্গল’ ইউরোপের ‘বাগানে’র প্রতি আগ্রহী নয়। প্রকৃতপক্ষে গ্লোবাল সাউথের নিজস্ব একটি বাগান রয়েছে-অফুরন্ত সম্পদ, মানবশক্তি এবং অকল্পনীয় সম্ভাবনাসহ। যদিও গ্লোবাল সাউথের সম্ভাবনা ব্রিকসে কমবে না, এই শক্তিশালী নতুন প্ল্যাটফর্মটি অনেক আশা জাগায় যে, পশ্চিম এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের একটি মৌলিক পরিবর্তন অবশেষে সম্ভব হবে।
গাল্ফ নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
ড. রামজি বারুদ : মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক লেখক; প্যালেস্টাইন ক্রোনিকেলের সম্পাদক