মিঠে কড়া সংলাপ
রাজনীতিতে ‘নীতি’ বলতে কিছু কি আর আছে?
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে দেখা যাবে, নীতি বলতে তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট কিছু নেই; এ ক্ষেত্রে যা কিছু আছে, তা কেবলই পরস্পরের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারিতে ভরপুর। রাজনৈতিক নেতারা এখন এক দল অন্য আরেক দলকে ঘায়েল করতে যে কোনো হীন পদ্ধতি অবলম্বনেও পিছপা হন না। এ দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি আদৌ সহনশীল নয়। ফলে স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এ দেশে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক কালচার গড়ে ওঠেনি। পারস্পরিক হানাহানি, মারামারিতেই অর্ধশতকের বেশি সময় পার করে দেওয়ার ফলে আজ এখনো রাজনীতি বলতে দেশ ও জাতির সামনে একটি হতাশাচ্ছন্ন তথা অন্ধকার চিত্রই ভেসে ওঠে; আর সে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসার সম্ভাবনাও দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, এ দেশের রাজনৈতিক নেতারা ভীষণ স্বার্থপর; তাদের প্রায় সবাই রাজনীতি করে খান বলে, ক্ষমতাই তাদের একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান। এ অবস্থায়, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এক দল মানুষ যেমন আবোলতাবোল কথা বলেন; আবোলতাবোল কাজ করেন, ঠিক তেমনি অন্য আরেক দল মানুষ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন; পাগল হয়ে ওঠেন! আর এসব করতে গিয়ে দুই দলের মানুষের মধ্যেই এক ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায়; কখন, কোথায়, কী বলতে হবে বা করতে হবে, সে বিষয়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কথায় এবং কাজের মধ্যে মিল থাকে না; মুখে তারা এক কথা বলেন, আর কাজের সময় অন্য কাজ করে দেশ ও জাতিকে বোকা বানাতে চান। অথচ তারা জানেন না, দেশের মানুষ সবকিছু বোঝেন অথবা বিষয়টি জানলেও তারা সেসব কথা গ্রাহ্য করেন না। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো এক একটি সংগঠিত শক্তিশালী সংগঠন; আর এসব সংগঠন যখন অসুরের মতো শক্তি প্রদর্শন করে, দেশের মানুষ তখন ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি মোকাবিলায় যেহেতু সাধারণ মানুষের পালটা কোনো সংগঠন নেই, সুতরাং ‘জোর যার মুল্লুক তার’ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। আর সেক্ষেত্রে দেশের মানুষের একমাত্র ভরসার স্থান হলো জাতীয় নির্বাচন। কারণ, একমাত্র নির্বাচনের সময় জনসাধারণ স্বাধীন এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়; অন্যথায় অন্যান্য সময়ে তারা ভুক্তভোগী মাত্র। আর সেজন্যই দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচনের দিন ও সময়ের অপেক্ষায় থাকেন যেদিন, সেদিন তারা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চান।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। এ নির্বাচনে ১৪টি দলের ১০৯১ জন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে; বাকি ২৮৯টি আসনেরও ২৮২টিতে বিজয়ী হয়। আর সে নির্বাচনে ছাত্রলীগ ভেঙে সিরাজুল আলম খানের তৈরি জাসদ ৬.৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি মাত্র আসন লাভ করে এবং আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগও একটি আসন পায়; তাছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বাদবাকি ৫টি আসন লাভ করে। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোকাবিলা করার মতো কোনো দল বা প্রার্থী না থাকা সত্ত্বেও অসদুপায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল বলে সে সময়ে অভিযোগ করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের পর ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান একটি গণভোটে তার ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য দেশের মানুষের সমর্থন চান এবং সে ক্ষেত্রে ৮৮.৫ শতাংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে আসে বলে প্রচার করা হয়। আবার ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসন থেকে রাষ্ট্রপতি পদে উত্তরণের জন্য যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসাবে জেনারেল (অব.) ওসমানী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ শেষ রাতে আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে এরশাদ নিজ হাতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। সে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও বাম ধারার পাঁচ দল নির্বাচন বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আর এ নির্বাচনের পর থেকেই নির্বাচনে কারচুপি, ভোট ডাকাতি, ভোট জালিয়াতি, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি শব্দগুলো জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকে; পরবর্তীকালে যার সঙ্গে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আরও একটি কথা যোগ হয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ৫৪ শতাংশের বেশি ভোট প্রদান দেখানো হলেও, প্রকৃতপক্ষে ১৫ শতাংশের বেশি ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসেনি বলে স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা মত প্রকাশ করেছিলেন। এ অবস্থায় সেই নির্বাচন তথা এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং ১৯৮৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভের মুখে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করার পর ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। অতঃপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, সে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়। আর সে নির্বাচনের ফলাফল ছিল বিএনপি ১৪০, আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, জামায়াত ১৮ ও সিপিবিসহ অন্যরা ১৯টি আসন।
এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০০১ সালে বিএনপি এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর উচ্চ আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করা হলে, দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ পরপর তিন দফা সরকার গঠন করে। এ অবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের সে আন্দোলন এখন হরতাল, অবরোধের মতো সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষকে মাশুল গুনতে হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে দেশের সাধারণ মানুষকে মাশুল গুনতে হচ্ছে বলার কারণ হলো, আমাদের দেশে সরকারি দল, বিরোধী দল উভয়ই ক্ষমতার বেনিফিশিয়ারি; ক্ষমতায় গেলে দলের সব নেতাকর্মীই দেশের টাকা লুটে পকেট ভারী করেন। অন্যথায় এক একটি দল ক্ষমতায় এলেই সেসব দলের নেতাকর্মী, বিশেষ করে নেতারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে পারতেন না। আবার এসব নেতার মাধ্যমে দলীয় কর্মীরাও যে ভাগবাটোয়ারা পেয়ে থাকেন, সে কথাটিও বলাই বাহুল্য। আর সেই কারণেই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ক্ষমতার জন্য এতটা পাগল; ক্ষমতা পেতে তারা যে কোনো কিছু করতে বদ্ধপরিকর।
আমার মনে হয়, আমি কী বলতে চেয়েছি, এতক্ষণে সবাই তা বুঝতে পেরেছেন। কারণ, আগেই বলেছি, দেশের মানুষ সবই জানেন ও বোঝেন। সুতরাং, আর কথা না বাড়িয়ে ক্ষমতার লোভে দেশের মানুষকে জিম্মি করে নিজেদের লোভ-লালসা চরিতার্থ করার মনমানসিকতা ত্যাগ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুস্থ মানসিকতার ধারায় ফিরে আসার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েই আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। আর সেই সঙ্গে জনান্তিকে এ কথাটিও জানিয়ে রাখতে চাই, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধারণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ কোনো ব্যক্তি বা দলের জন্যই যেন নেশার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। কারণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্তি যদি কারও ক্ষেত্রে নেশার মতো হয়ে ওঠে, তাহলে তার ক্ষয়ক্ষতি বা খারাপ দিকটা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে দলীয় পর্যায় এবং সেখান থেকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে এবং যাচ্ছে। সুতরাং, সাধু সাবধান! সবশেষে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বিশেষভাবে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, ‘রাজনীতিতে এখন নীতি বলতে আর কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই’; সুতরাং, অচিরেই এ ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু নীতি ফিরিয়ে না আনলে, দেশ ও জাতির যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি কিন্তু অপেক্ষা করছে। আর সে ক্ষতির দায়ভার সম্পূর্ণটাই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদেরই বহন করতে হবে। অতএব যা খুশি তাই করব, এসব চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে সুষ্ঠু ধারার নীতিনৈতিকতাকে প্রাধান্য দেওয়াই এখন সময়ের কাজ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট