আশঙ্কার পাশাপাশি আছে প্রত্যাশাও

এম হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই মতপার্থক্যের বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করতে হয়। আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগ্রাম করেছি। এখনো আমরা দাবি করি যে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যদি রাষ্ট্র চালাতে হয়, তাহলে আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখি না।
রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে, তারা গণতান্ত্রিক বা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের সময় যেটা প্রত্যাশিত সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তাদের ম্যান্ডেট চাইবে। জনগণ যে মতামত দেবে, সেই মতামতের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এটাই তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এখন এখানে দুটি দিক রয়েছে, একটা হচ্ছে রাজনৈতিক দল; যারা ক্ষমতায় আছেন তারা মনে করেন তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন, এটা তাদের দিকের প্রেক্ষাপট। অন্যদিকে, জনগণের দিক থেকেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের চাহিদা ও প্রাপ্তিতে খানিকটা তফাৎ আছে; এবং আছে বলেই তো আজ অর্থনৈতিকভাবে আমরা যথেষ্ট অগ্রগতি করার পরও বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা বাড়ছে। তারপর আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম বিষয় হচ্ছে, মতামতের ভিত্তিতে সব সমস্যার সমাধান করা বা কনসালটেটিভ প্রক্রিয়া, সেটা কি আমরা যথেষ্ট শক্তিশালীভাবে করতে পারছি? আর সবশেষ বিষটি হচ্ছে, একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থাটাকে শক্তিশালী করে মানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতাকে সুনিশ্চিত করা। এক্ষেত্রেই বা আমরা এখন কোন অবস্থায় আছি? সব ক্ষেত্রেই তো প্রশ্ন আছে।
আজ ২৮ অক্টোবর ঢাকায় দুই প্রধান দল যে পালটাপালটি কর্মসূচি দিয়েছে, তা নিয়ে একটা উৎকণ্ঠা তো আছেই। এর কারণ হলো, দুই পক্ষ থেকেই যেসব বক্তব্য আসছে, সেই বক্তব্যগুলো থেকে উৎকণ্ঠার একটা জায়গা তৈরি হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এখানে আরও কয়েকটা বাস্তবতাও কিন্তু আছে। এর আগেও কিন্তু এরকম দুটি বড় আয়োজন হয়েছে গত কয়েক মাসে। তখনো উৎকণ্ঠা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই তা শেষ হয়েছে। এখন আমার দুই ধরনের ধারণা হচ্ছে, মানে নেতিবাচক আছে আবার ইতিবাচকও আছে। বিরোধীরা বলছে, তারা ঢাকা শহরে বসতে চায়, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে চায় এবং সেটা গতকালও তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি দলও বলছে, বিএনপি যদি সহিংসতা না করে, তাহলে তাতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। ঢাকার পুলিশ কমিশনারও বলেছেন, সংঘাত-সহিংসতার কোনো ইঙ্গিত বা তথ্য তাদের কাছে এখনো আসেনি। কাজেই মনে হচ্ছে, একটা উৎকণ্ঠা আছে, আশঙ্কাও হয়তো আছে এবং সেই সঙ্গে আমি বলবো, প্রত্যাশাও আছে মানুষের। মানুষ তো শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলতে চায়। আমরাও চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকুক। আমি মনে করি, সেই প্রত্যাশাটা যদি জয়ী হয় বা প্রত্যাশাটা যদি টিকে থাকে, তাহলে সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনকই হবে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা পরিচালিত হওয়ার আদর্শগত প্রক্রিয়াটা হচ্ছে, জনগণের মতের ভিত্তিতেই শাসনকার্য পরিচালিত হবে। এটাই তো গণতন্ত্র। কাজেই এখানে মুখ্য নিয়ামত হচ্ছে জনগণ কী চায়। জনগণের মতামত প্রকাশের সুযোগটা আছে কিনা এবং সেই সুযোগটা দেওয়ার জন্য আমি মনে করি, যারাই অংশীদার আছেন তাদের সবারই ইতিবাচকভাবে এখানে অবদান রাখা প্রয়োজন এবং এটা এ মুহূর্তে দরকার। মার্কিন ভিসা পলিসি প্রসঙ্গে বলা যায়, এক্ষেত্রেও কিন্তু তারা বলেছে যে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচনের পথে সব অংশীদাররা যারা আছেন, তারা যাতে ইতিবাচকভাবে কাজ করতে পারেন, সে বিষয়টিকে উৎসাহিত করার জন্যই তারা এ নীতিটা প্রণয়ন করেছে বা প্রয়োগ করছে। আমরা তো মুক্তিযোদ্ধার জাত। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করা জাতি। আমরা আত্মসম্মানের জন্যই মুক্তিযুদ্ধটা করেছি। কাজেই আত্মসম্মানের জায়গাটাতে আমাদের কী করা উচিত সে বিষয়টাতেই আমাদের বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। বাইরের কেউ বললো কিনা, সেটা তো মুখ্য হওয়া উচিত নয়। আর যদি তারা কিছু বলেও থাকে, তাহলে আমরা সেই বলাটা যে যথার্থ বা প্রয়োজনীয় নয়, সেটা আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে আমরা যেন প্রমাণ করতে পারি এবং সেক্ষেত্রে সবারই একটি গঠনমূলক ভূমিকা আছে বলে আমার ধারণা।
এদেশে মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু দেশের সব মানুষ মিলে করেছে এবং সব মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই যুদ্ধে সফলতা এসেছে। এটা তো আমরা মানি, মানতেই হবে। গত বায়ান্ন বছরে যেটুকু অর্জন আমরা করেছি, সেটা অর্থনৈতিকভাবে হোক, সামাজিকভাবে হোক, সব ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই সেটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে যদি বলি, আমাদের কৃষিতে যে বিপ্লব ঘটেছে, এটা সাধারণ মানুষের অবদান। সরকার নিশ্চয়ই নীতি নির্ধারণের পর্যায়ে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে; কিন্তু বাস্তবায়ন করেছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। এবার আসি রেমিট্যান্স ও আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে। রপ্তানি হচ্ছে এখন বায়ান্ন বিলিয়ন ডলারের মতো, যেখানে সাধারণ মানুষের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তারা এ দেশেরই মানুষ-যারা বিদেশে গিয়ে পরিশ্রম করে ডলার পাঠাচ্ছেন। এই সাধারণ মানুষগুলোর দায় আমরা মেটাব কী দিয়ে? এ ক্ষেত্রে তাদের অবদান ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। দায় মেটানোর জায়গাটা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে তাদের মতামত প্রকাশ এবং অংশগ্রহণের সুযোগটা আমরা যারা শাসন করি, আমরা যারা রাজনৈতিক দলের নীতি-নির্ধারণ করি বা প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণ করি তারা যেন সেটা নিশ্চিত করতে পারি। এই দেওয়া-নেওয়াটাই তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
দেশের সব মানুষ সমান অধিকার পাওয়ার অধিকার রাখে। গণতন্ত্রে সবার সমান অধিকারের কথাই বলা হয়েছে। কাজেই কাঠামোগতভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে আমাদের মানুষের চাহিদার জায়গাটা গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বাইরে গিয়েও বাস্তবতার নিরিখেই আমাদের নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এম হুমায়ুন কবির : সাবেক রাষ্ট্রদূত