Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল জনজীবন

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল জনজীবন

যুদ্ধ-সংঘাতের নতুন অধ্যায় পুরো বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের অব্যাহত বর্বর হামলা, বিভিন্ন দেশে নানামুখী সংঘাত-সংঘর্ষ বিশ্বব্যাপী মানুষের মনে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে।

এসব ঘটনার প্রভাবে বিশ্ব টালমাটাল। জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি-মূল্যবৃদ্ধির উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারই সংকট উত্তরণে বিভিন্ন প্রায়োগিক পরিকল্পনা-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বৃহত্তর জনস্বার্থে আগামী দিনের সম্ভাব্য সমস্যা অনুধাবনে গৃহীত পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রে নতুন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। কর্মহীনতা, আয়বৈষম্য, জনজীবনের হাহাকার প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞার অভাব দৃশ্যমান।

দেশে বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পেশাজীবী, শিক্ষার্থীসহ নিম্ন-আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবন ওষ্ঠাগত। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশের সিংহভাগ মানুষ তাদের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। দ্রব্যমূল্য বর্তমানে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি রোধকল্পে সরকার পেঁয়াজ, চিনি ও ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও ভোক্তারা সেই দামের চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। জনশ্রুতিমতে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকরে মাঠ পর্যায়ে বাজার তদারকিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছাড়া সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য তৎপরতা পরিলক্ষিত নয়। বাজারের ওপর সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলবেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের বাজারে একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর না কমার দৃষ্টান্তও অনেক। অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর কারণে বারবার দুর্ভোগে পড়ছে দেশের নিম্ন-আয়ের মানুষ। আইনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম যখন কমছে, তখন বাংলাদেশে ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করার সুযোগ নেই। এ মূল্যস্ফীতির পেছনে সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বারবার মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে মূল্যহ্রাস, আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো প্রভৃতি বিষয়ের প্রভাবই মুখ্য।

তবে হঠাৎ করে বাজারে দেশে উৎপাদিত ডিম, মুরগি, পেঁয়াজ, আলু, ডাল, চিনি, তেল ইত্যাদি নিত্যপণ্যের চক্রাকারে একেক সময় একেকটির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাগুলো পৃথক করা যায় না। বাজারে মুষ্টিমেয় অসাধু ও করপোরেট ব্যবসায়ীর একচেটিয়া আধিপত্য, অতিমুনাফা এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবের বিষয়টিও কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা বছরওয়ারি হিসাবে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু চলতি বছরের আগস্টে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বর্তমানে একটি পরিবারে যত অর্থ খরচ হয়, তার ৪৮ শতাংশের মতো খরচ হচ্ছে খাবার ক্রয়ে। ফলে ধারাবাহিকভাবে খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় নির্দিষ্ট ও মধ্য-আয়ের মানুষ ভীষণ সংকটে পড়েছে।

এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী ১০ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফলে জানা যায়, ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

৩ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য চারটি বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন মতে, যেসব কারণে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তা হলো-অভ্যন্তরীণ জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রা কমে যাওয়ায় আমদানি কমে যাওয়া প্রভৃতি।

একই প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমিয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০২৫ সালে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও মালদ্বীপে হবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৩ ও ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৩ সালে শ্রীলংকার প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৩ দশমিক ৮ শতাংশের বিপরীতে ২০২৪ সালে দেশটি ঘুরে দাঁড়াবে এবং প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্য কমে বর্তমানে ৫ শতাংশ হয়েছে, যা ২০১৬ সালে ছিল ৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ১ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল।

চলমি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে ভোক্তাদের স্বার্থ বজায় রাখা হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আইনের দুর্বলতা ও ভোক্তাদের অসচেতনতার কারণে এসব ব্যবসায়ীকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। প্রয়োজনে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আরও কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বর্তমানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার মান কমে যাওয়া দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এটি দেশের ১৭ কোটি মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা ঘটনার প্রভাব পড়ছে দেশের দ্রব্যমূল্যের ওপর। তবে এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা এমন কিছু পণ্য নিয়ে কারসাজি করছে, অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছে, যার সঙ্গে এসব আন্তর্জাতিক ঘটনার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, এসব খাদ্যপণ্যের অধিকাংশই উৎপন্ন হয় আমাদের দেশে।’

ডিম, কাঁচা মরিচ, আলুর দাম আকস্মিকভাবে বেড়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে দাম বাড়ায় কোনো ফর্মুলা কাজ করে না। এগুলো অস্বাভাবিক আচরণ। তবে দেশের নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সীমিত লোকবল দিয়ে হলেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।’

১৫ অক্টোবর রাজধানীতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কর্তৃক দেশব্যাপী অক্টোবরে এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীদের কাছে চালসহ টিসিবির পণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রয় কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী গরিব-দুঃখী, অসহায় মানুষের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকার টিসিবির মাধ্যমে দেশের এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারী অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষের মাঝে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় করছে। তেল, চিনি, ডালের পাশাপাশি জুলাই থেকে দেওয়া হচ্ছে চাল।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি, বৈশ্বিক কারণে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে রাখতে। কিন্তু আমদানিকৃত পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। যার জন্য চাইলেও কমানো সম্ভব হয় না। তবে আমরা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’

এছাড়াও বর্তমানে ডিমের বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজারে ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজারদর স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১৫ কোটি ডিম আমদানির জন্য ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। দেশে পর্যাপ্ত আলু মজুত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বাজার মনিটরিং অব্যাহত রাখার এবং প্রয়োজনে সরকার কর্তৃক আলু আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টিও তার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে।

ভৌত অবকাঠামো, ডিজিটালাইজেশন, সড়ক-জনপথ-সেতু ও জীবনমান উন্নয়নে দেশের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন শুধু কতিপয় দুষ্টচক্রের কারসাজিতে ম্লান হতে পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হায়েনা কর্তৃক সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাধীন মাতৃভূমি পুনর্গঠনে সততা-নিষ্ঠা-প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। ঘুস-দুর্নীতি-কালোবাজার্রি-মুনাফাখোরির বিরুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক আমলাসহ দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।

অর্থলিপ্সু বাজার সিন্ডিকেট নানা অপকৌশলে দ্রব্যমূল্য শুধু অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে না, দেশে অরাজক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতেও এদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা ভেবে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও চাহিদা মোতাবেক পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। একই সঙ্গে মজুতদারি সিন্ডিকেটগুলোকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে আগামী দিনে বাজার পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম