নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
পরিকল্পনামন্ত্রী এ কী বললেন!
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আর কোনো চিন্তা নেই আমাদের। কলাম লেখকদেরও কালি খরচ করার প্রয়োজন নেই। কারণ ‘ওষুধ’ পাওয়া গেছে। ওষুধ সিন্ডিকেট দমনের। এর আবিষ্কর্তা আমাদের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি এমএ মান্নান। ১৪ অক্টোবরের কাগজে দুটি খবরের শিরোনাম দেখলাম। একটি হচ্ছে : ‘সিন্ডিকেট দেখতে পারলে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’ দ্বিতীয় খবরটির শিরোনাম হচ্ছে : ‘বাজার নিয়ন্ত্রণের শক্তি কারও নেই-পরিকল্পনামন্ত্রী’। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে আরও বলেছেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি দুনিয়ায় কারও নেই। বাজার নিজেকেই নিজে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে কিছু অনুষঙ্গ আছে-সরবরাহ ও চাহিদা।’ মন্ত্রী আরও বিশদভাবে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি উদীয়মান। এ ধরনের অর্থনীতিতে কিছু বিকৃতি থাকবেই, লাভ বা মুনাফার সুযোগ নেবেই। নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। তবে তারা একেবারে নতুন। দাঁত গজাতে হবে। তারা আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ হচ্ছে, কাজ করছে।’ ওই সভায় অনেক কথা তিনি বলেছেন। আমরা আর বিস্তারিত বক্তব্যে যাচ্ছি না। কারণ সিন্ডিকেটের ওষুধ আমরা পেয়ে গেছি। সবাই বলছে, সিন্ডিকেট সব খেয়ে ফেলছে। মানুষের সর্বনাশ করছে। মন্ত্রীরা বলছেন, সংসদে আলোচনা হচ্ছে। এই তো সেদিন কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, আলুর বাজার থেকে ‘সিন্ডিকেট’ করে কোল্ড স্টোরেজওয়ালারা টাকা লুট করে নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্প প্রতিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী আমাদের সিন্ডিকেটের অত্যাচারের কথা শুনিয়েছেন। সরকার যে তাদের কাছে অসহায়, সে কথাও তারা বলেছেন।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত অনেকবার সিন্ডিকেটের কথা বলতে গিয়ে ‘সরকারের ভেতরে সরকার’র কথা বলেছেন। এছাড়া বিভিন্ন কাগজ প্রায় প্রতিদিন স্টোরি করে আমাদের জানাচ্ছে যে, পণ্যভিত্তিক সিন্ডিকেট দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানও এ সম্পর্কে আমাদের নিয়মিত জানাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাবেক আমলারা বলছেন। এসব শুনে শুনে, দেখে দেখে মানুষ দিন দিন দিশেহারা হয়ে ভাবছিল-তাহলে উপায়? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? প্রতিকার হবে না? আমরা কি সিন্ডিকেটীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মার খেতেই থাকব? আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই? সরকারেরও কি কোনো দায়িত্ব নেই? এমন সব প্রশ্ন অনেকদিন ধরে মানুষের মনে জাগছিল। আমি নিজেও অনেক ভেবেছি-তবে কি আমাদের বাঁচার কোনো পথ নেই? আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তেলের দাম বেড়েছে। ডলারের দাম বেড়েছে। আমদানির খরচ বেড়েছে। সবই সত্য। কিন্তু যখন দেখা গেল, যে আলুতে আমরা সবসময় স্বয়ংসম্পূর্ণ, যে আলু খাওয়ার জন্য বিগত ‘কেয়ারটেকার’ সরকারের আমলে আমাদের জনপ্রিয় একজন শিল্পী গান গেয়েছেন, যে গান টেলিভিশনে আমরা দিন-রাত শুনেছি, সেই আলু বিনা কারণে বাজারে ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আলু আমরা আমদানি করি না। ডিমেও তা-ই। সব সময় বলা হচ্ছে, ডিমেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কয়েকদিন আগেই কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের কৃষি, খাদ্য, পশু ও বন মন্ত্রণালয় বলেছে, কৃতিত্ব নিয়েছে কৃষিতে আমাদের পারফরম্যান্সের জন্য। অথচ বাজারে এখন কোনো সবজিতেই হাত দেওয়ার উপায় নেই। একটা ছোট্ট লাউয়ের দামও ১০০ টাকা। হচ্ছেটা কী-এ প্রশ্ন ছিল সবার মনে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, সিন্ডিকেটই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
না, একথা এখন আর বলা যাবে না। কারণ পরিকল্পনামন্ত্রীর নতুন আবিষ্কৃত ‘ওষুধ’। তিনি বলছেন, সিন্ডিকেট নাকি দেখা যায় না। দেখতে পারলে নাকি তিনি তা ধরতেন। সবার পরে বক্তব্য-‘সিন্ডিকেট নেই’। বাজারই সবকিছু। বাজারই সবকিছু ঠিক করে। পাঠক বলুন, এরপর কি আর কিছু বলার আছে? পরিকল্পনামন্ত্রী একজন অভিজ্ঞ আমলা। তিনি মুহিত সাহেবের সঙ্গে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পারফরম্যান্সের জন্য পদোন্নতি পেয়ে তিনি হয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি সব মন্ত্রীর বক্তব্যকে ছাপিয়ে বলে দিচ্ছেন, দেশে কোনো সিন্ডিকেট নেই-আছে বাজার, চাহিদা ও সরবরাহ। এর অর্থ কী?
সরকারের মধ্যে কি সিন্ডিকেট নিয়ে দ্বিমত আছে? দ্বিমত যে আছে, তা তো এখন পরিষ্কার। খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলছেন সিন্ডিকেটকে দায়ী করে; আর পরিকল্পনামন্ত্রী বলছেন ঠিক এর বিপরীত কথা। আমরা এর অর্থ বুঝতে পারছি না। কার বা কাদের কথা সত্য? পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা সত্য, না অন্য মন্ত্রীদের? এ প্রশ্নের জবাব পাচ্ছি না। তবে বাজারের অবস্থা দেখে অস্পষ্ট একটা ধারণা হয় আমাদের। দেখা যাচ্ছে, সরকারি সংস্থার বিচারে দেশে সিন্ডিকেট আছে। এর প্রমাণ দুটি ডিম উৎপাদনকারী কোম্পানি। সিন্ডিকেটীয় কায়দায় বাজার ‘ম্যানিপুলেট’ করার দায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান কোম্পানি দুটিকে আর্থিক জরিমানা করেছে। কেন তা করা হবে, যদি পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয় সঠিক হন? ডিমের দাম বাজার ঠিক করেছে, যেহেতু বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারও নেই। বলা যায় পরিকল্পনামন্ত্রীর ভাষায়-চাহিদা-সরবরাহজনিত কারণে ডিমের দাম বেড়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা সরকারি দপ্তর মানছে না। তারা দুই কোম্পানিকে আর্থিক জরিমানা করেছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বোধহয় বলছেন বাজার অর্থনীতির কথা। এ ধরনের বাজারে চাহিদা-সরবরাহই সবকিছু। সরকারের কিছু করার নেই। এটাই চিরায়ত ধারণা। আমাদের সরকার বাজার অর্থনীতির সরকার। আগের সরকারগুলোও তা-ই ছিল। বস্তুত এখন সরা বিশ্বই বাজার অর্থনীতির কবলে। তাই প্রশ্ন, কেন নানা ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ? যেমন সরকারই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অবশ্য কোনো ব্যবসায়ীই এ নির্ধারিত দাম মানে না। তারা সরকারকে তোয়াক্কা না করে বাজার যা বহন করতে পারে সেই দামেই তা বিক্রি করছে। সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে। তাও করে নির্ধারিত দামে। মিলাররা ওই দামে সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সরকার গ্যাসের দাম, তেলের দাম নির্ধারণ করে। সরকার বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে। সরকারি নীতি বাজার অর্থনীতি হলেও এসব ক্ষেত্রে সরকার আবার হস্তক্ষেপ করে। যেহেতু করে, তাই পরিকল্পনামন্ত্রীর কথার কী মূল্য? সরকার আমানতের ওপর কী সুদ হবে, ঋণের ওপর কী সুদ হবে, ডলারের দাম কত হবে-সব নির্ধারণ করে দেয়। বাজার অর্থনীতিতে এসব কি চলে? পরিকল্পনামন্ত্রীর ভাষ্যমতে, তা হওয়ার কোনো কারণ নেই। অথচ তা হচ্ছে। এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বহু আপত্তি। সারের দাম কম কেন, বিদ্যুতের দাম কম কেন, গ্যাসের দাম কম কেন-এসব প্রশ্ন আইএমএফের। সত্যিই তো, পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা ঠিক হলে, অর্থাৎ বাজারই সব ঠিক করবে এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণেই সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বাজারই ঠিক করবে বাজার। চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম হলে দাম বাড়বে। চাহিদা কম, সবরাহ বেশি হলে দাম কমবে। এ সবই পুরোনো কথা। বইয়ে পড়েছি, মুখস্থ করেছি। কিন্তু এ সবের মধ্যে যে গোমর আছে, তার কথাও তো বলতে হবে। চাহিদা যে তৈরি করা যায়, সরবরাহে যে বিঘ্ন ঘটানো যায় এবং এসব করে যে প্রভাবশালীরা অর্থ লুট করতে পারে, তারও তো প্রমাণ আছে ভূরিভূরি। এই তো সেদিন প্রাণিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইলিশের দাম এত বেশি কেন সে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বললেন, মাছের বড় বড় ব্যবসায়ী বাজার ম্যানিপুলেট করে ইলিশের দাম বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রতিদিনের ঘটনা এসব।
দেখতেই পাচ্ছি বাজার অর্থনীতির মূল নীতিগুলো কেউ মানে না। বাজার অর্থনীতির মূল কথা প্রতিযোগিতা, মেধা, দক্ষতা, শ্রম এবং উদ্ভাবনী/সৃজনী শক্তি। এসব যে বাজার অর্থনীতি অবহেলা করছে, তা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? দৈনন্দিন বাজারে যে প্রতিনিয়ত বাজার অর্থনীতি আগ্রাসী বাজার অর্থনীতি হয়ে উঠছে, তা কি কেউ খেয়াল করেছেন? দিনে দিনে আমাদের ব্যবসায়ীরা ছোট থেকে বড় হয়েছেন, ধনী থেকে অতিধনী হয়েছেন। ব্যাংকের টাকা পেয়েছেন, সরকারের রাজস্বনীতির সুযোগ পেয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুকূল্য পাচ্ছেন। এসব পেয়ে তারা বাজার অর্থনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। তারা একচেটিয়া ব্যবসায়ী হচ্ছেন, মনোপলি ব্যবসা করছেন, কার্টেল করছেন, সিন্ডিকেট করছেন। অথচ আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বলছেন, সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। তিনি তাদের দেখতে পেলে ধরতেন। তার সামনেই দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটকে ধরেছে, জরিমানা করেছে। এ অবস্থায় বলার কী আছে? আমরা কোনদিকে যাব? পরিকল্পনামন্ত্রী এর উত্তর দিয়ে দিলে আমরা শান্তি পাব।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়