মিঠে কড়া সংলাপ
গাজা নগরীর আগুনে তেলআবিবও জ্বলবে

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের শক্তিমত্তার দাপটে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে; ইসরাইলি বাহিনী সে স্থানটিকে নরককুণ্ড বানিয়ে ফেলেছে। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গেরিলা সংগঠন গাজার হামাস বাহিনীর কিছু সদস্য গত ৭ অক্টোবর কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে সেখানে আক্রমণ চালানোর পর জানমালের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিশোধ হিসাবে গত কয়দিন ধরে ইসরাইল একনাগাড়ে গাজাসহ আশপাশের এলাকায় বিরতিহীন বোমাবর্ষণ করে চলেছে। ফলস্বরূপ ইসরাইলি বাহিনী গাজা এবং পশ্চিম তীরের কয়েক হাজার স্থাপনা ধ্বংস করে এ লেখাটি লেখা পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে; আরও হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। আর প্রতি মিনিটেই এসব ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলায় সারা পৃথিবীর বিবেকবান মানুষের অন্তর শিহরিত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইসরাইল এবং তার দোসর রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রনায়করা রণহুঙ্কারে মেতে উঠেছেন এবং ইহুদি রাষ্ট্রটির কর্ণধার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জানিয়েছেন, গোটা ফিলিস্তিনের চিত্র তিনি পালটে দেবেন। গাজার গেরিলারা সেদিন অকস্মাৎ আক্রমণ করে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে যেসব মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছেন, তার মাশুল হিসাবে গাজা উপত্যকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী তা বাস্তবায়নের জন্য জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সবস্থান থেকে ফিলিস্তিনের ওপর বোমাবাজি করে চলেছে এবং যে করিডোর দিয়ে গাজায় খাদ্যসামগ্রী, ওষুধপত্র প্রবেশ করত, তা-ও বন্ধ করে দিয়ে সেখানে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং ইসরাইলের এসব কাজে সহায়তা দিতে আমেরিকা জাহাজভর্তি অস্ত্র পাঠিয়েছে। এ অবস্থায় শত শত মানুষের মৃতদেহ এবং হাজার হাজার আহত মানুষকে নিয়ে ফিলিস্তিনিরা নিদারুণ বিপদে আছেন, খাদ্য ও ওষুধের অভাবে বোমায় আহত মানুষ এবং তাদের পরিবারের আর্তনাদে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। জীবিত মানুষও তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছেন। কিছু মানুষ হাসপাতাল এবং স্কুলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ২৩ লাখ জনঅধ্যুষিত গাজা উপত্যকায় ঠাসাঠাসি করে বসবাস করা এসব মানুষের পালানোর স্থানও অত্যন্ত সংকুচিত বিধায় ইসরাইলি বোমা হামলার মুখে অসহায়ভাবে তাদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। আর এ অবস্থার পরও ইসরাইল তাদের সামরিক আক্রমণ আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের মিত্ররাও সমানতালে অস্ত্রশস্ত্র, মন্ত্রণা, সাহস দিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর শক্তি ও সাহস জুগিয়ে চলেছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র দিয়ে ইসরাইলি বাহিনীকে ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ, শিশু হত্যায় উৎসাহিত করে চলেছে। এ অবস্থায় ইসরাইল ও আমেরিকার যৌথ শক্তির তীব্র আক্রমণের মুখে নিরস্ত্র, অসহায় ফিলিস্তিনি জনগণের বুকফাটা আর্তনাদ ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ইসরাইলি বোমা হামলার মুখে নারী, পুরুষ, শিশু বেঘোরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে প্রমাণ করে চলেছে কতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয় ইসরাইলি বাহিনী ও তাদের মিত্ররা।
আর সেই সঙ্গে এটিও আবারও প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে যে আমেরিকার মতো পরাশক্তিও কতটা মতলববাজ; ইহুদিদের দ্বারা প্ররোচিত ও পরিচালিত আমেরিকাও কতটা নির্দয়, নিষ্ঠুর। ইসরাইলি বাহিনী যখন প্রতি মিনিটে নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সব শ্রেণির ফিলিস্তিনিদের প্রাণ সংহার করে চলেছে, তাদের স্থাপনাগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে, সেই মুহূর্তে ইসরাইলি বাহিনীকে মদদ দিতে, তাদের আরও শক্তিশালী করতে যুদ্ধবিমানবাহী রণতরী পাঠিয়ে আমেরিকাও এ ক্ষেত্রে পিশাচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকান ও ইংরেজদের বদান্যতায় মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে ইহুদিদের পুনর্বাসিত করা হয়। আমেরিকা ও ইংল্যান্ড মিলে ইহুদিদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনে বসবাসের জন্য ভূমি নির্ধারণ করে দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়। অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত জায়গা দখল করে মুসলমানদের মধ্যে ইহুদিদের ঢুকিয়ে দেয়। যদিও ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পর থেকেই ইহুদিরা ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করায় ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের দ্বন্দ্ব, সংঘাত অব্যাহত ছিল। এ কথা জানা থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ-আমেরিকান চক্রটি মুসলমানদের জায়গা দখল করে সেখানে ইহুদিদের বসিয়ে দেয় বা বলা চলে মুসলমানদের ঘাড়ে ইহুদিদের চাপিয়ে দেয় এবং শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনি জনগণের মাতৃভূমি কেড়ে নিয়ে ফিলিস্তিনি আরবদের রাষ্ট্রের অধিকার অস্বীকার করে সেখানকার আদিবাসী আরবদের ছিন্নমূল জাতিতে পরিণত করা হয়। যার ফলে পঁচাত্তর বছরের অধিক সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা স্বাধিকার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন; স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর বারবার তাদের সে আন্দোলন- সংগ্রাম-লড়াইয়ের ফসলের চারাগাছ আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। অন্যথায় ইসরাইলের পক্ষে এতটা বাড়াবাড়ি করা সম্ভব হতো না, এতদিনে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হয়ে যেত। কিন্তু ইসরাইলের মিত্রবর্গ বিশেষ করে আমেরিকা তা হতে দেয়নি। কারণ আমেরিকার বড় বড় পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেলসহ বিভিন্ন মিডিয়ার মালিকানা ইহুদিদের হাতে। সারা বিশ্বের দেড় কোটির কিছুটা বেশি জনসংখ্যার ইহুদি জাতির ৫২ লাখ মানুষ ইসরাইলে বসবাস করলেও ৬১ লাখ ইহুদির বসবাস আমেরিকায়। আর বড় বড় করপোরেট হাউজের মালিকানাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও তাদের হাতে। এমনকি সরকারি বড় বড় পদ-পদবি, হোয়াইট হাউজের বড় কর্মকর্তাসহ নাসার গুরুত্বপূর্ণ পদেও ইহুদিদের আধিপত্য রয়েছে। সে অবস্থায়, আমেরিকার নীতিনির্ধারণে ইহুদিরাই যে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন, সে কথাটি বলাই বাহুল্য। আর সে কারণেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা বারবার হোঁচট খেয়েছে; এতদসংক্রান্ত আন্দোলন- সংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছে; ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলনের যুদ্ধ সফলতার মুখ দেখেনি। যুগ যুগ ধরে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা সেখানে মার খাচ্ছেন; মারা যাচ্ছেন। আর ফিলিস্তিনি মায়েরা বুক চাপড়াচ্ছেন, কান্নাকাটি, আহাজারি করে তাদের সন্তানরা স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের জন্য শহিদ হয়েছেন মর্মে সান্ত্বনা খুঁজে নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, দখলদার ইসরাইলের কাছ থেকে দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে বেশ কয়েকবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হলেও আমেরিকার কারণে সেসব যুদ্ধে ফিলিস্তিন তথা আরব রাষ্ট্রের পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। যেমন ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ যা ইয়ম কিপুর যুদ্ধ বলে পরিচিত, সেই যুদ্ধেও মিসর ও সিরিয়ার সম্মিলিত শক্তি ইসরাইলকে কাবু করতে পারেনি। যুদ্ধ শেষে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বলেছিলেন, ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করা! ১৯৭৩ সালের সে যুদ্ধেও আমেরিকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান উড়ে এসে ইসরাইলি বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করায় সে যুদ্ধে ইসরাইল জয়লাভ করে নতুন নতুন আরব ভূমি দখল করে নেয়। তাছাড়া ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল যেসব আরব ভূমি দখল করে নিয়েছিল, সেসব অধিকৃত স্থানে যুগ যুগ ধরে তারা বসতি সম্প্রসারিত করে চলেছে। যদিও ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে মিসরকে সিনাই উপত্যকা ফেরত দেওয়া হয়েছিল।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণেও যে ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরোধ নিষ্পত্তি একটি দুরূহ বা অসম্ভব ব্যাপার, জনান্তিকে সে কথাটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ, আমাদের ইসলাম ধর্মে এমন কিছু বিষয়, এমন কিছু কথার উল্লেখ আছে, যা মানতে গেলে বা পালন করতে গেলে কোনো দিন, কোনোকালেই ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের সমঝোতায় আসা সম্ভব নয়।
লেখাটি আর দীর্ঘয়িত না করে উপসংহার টেনে বলতে চাই, প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে চলে আসা দ্বন্দ্বেরও অবসান হওয়া উচিত। আর এসব দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাও বন্ধ করা উচিত। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, বর্তমান অবস্থায় ইহুদি জাতি জ্ঞান-গরিমা, শিক্ষা-দীক্ষায় একটি উন্নত জাতি হিসাবে পৃথিবীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, যে কারণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বে তাদের কদর আছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে তারা প্রভাব বলয় সৃষ্টি করেছে। এমনকি কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্রও এখন তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে না; ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক বড় দেশ এবং শক্তিও ইসরাইলের পাশে আছে। সুতরাং ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী শক্তি প্রদর্শন করে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না। আবার ঠিক, তেমনি ইসরাইলও গায়ের জোরে চিরদিন ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে পারবে না; মাঝে মধ্যে সীমিত শক্তি নিয়েই তারা রুখে দাঁড়াবে; আর সে কথাটি তারা বারবার প্রমাণও করেছে। যেমন বর্তমান যুদ্ধে ইসরাইলকেও প্রচুর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। সুতরাং ফিলিস্তিনি আরবদের দমিয়ে রাখতে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে ফিলিস্তিনের আরব ভূমিতে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ না করাটাই ইসরাইল ও আমেরিকার জন্য বেহেতর হবে বলে মনে করি। কারণ, ইসরাইল ও আমেরিকা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ফিলিস্তিনি জাতি যখন মরতে শিখেছে, তখন তাদেরও কিন্তু দমিয়ে রাখা যাবে না। ফিলিস্তিন বা গাজার আগুনে তেলআবিও কিন্তু জ্বলবে; যেমনটি ভিয়েতনামের আগুনে পেন্টাগন জ্বলেছিল।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট