নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
অর্থনীতিতে সুখবর নেই

ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের মানুষ কি সুখে আছে, না শান্তিতে? অবশ্য অর্থনীতিবিদরা ভিন্নভাবে প্রশ্নটি করতে পারেন। তাদের জিজ্ঞাসা হতে পারে : অর্থনীতি কি ‘স্বস্তি’তে আছে, না সংকটে বা চাপে? এসব প্রশ্নের উত্তর নানারকম হতে পারে। যার যার অবস্থান থেকে উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ বলবেন, অর্থনীতিতে কোনো সংকট নেই। কেউ বলবেন, যারা অর্থনীতি বোঝেন না, তারা অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেন। আবার কেউ বলবেন, অর্থনীতি সংকটে নয়, কিছুটা চাপের মধ্যে আছে। চাপের কথা পরিকল্পনামন্ত্রী স্বয়ং বলছেন। অনেকে বলেন, রিজার্ভ সংকটের মধ্যে আছে। আবার কেউ বলছেন, না আমাদের খাবার আছে, চিন্তার কোনো করণ নেই। এমন সব উত্তর অর্থনীতি সম্পর্কে। আবার মানুষের কথা বললে বলা হচ্ছে, মানুষ কষ্টে আছে, ভীষণ কষ্টে আছে। আর কুলোতে পারছে না মানুষ। সঞ্চয় ভাঙছে। রোজগার তাদের কমে যাচ্ছে। সুদ আয় কম। খরচ অনেক বেশি। মানুষ দিন দিন বেশি ঋণী হচ্ছে। আরও দরিদ্র হচ্ছে।
এভাবে দেখলে বোঝা যাবে কোথাও একটা সমস্যা আছে, সমস্যা হচ্ছে। এসব কথা দুই বছর আগেও ছিল না। আজ কথা উঠেছে। কেন্দ্রে মূল শত্রু মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ভিন্নভাবে বললে বলা যায়-টাকার ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমছে। এক টাকার জিনিস দুই টাকায় কিনতে হচ্ছে। টাকার দাম দেশে কমছে। একইভাবে কমছে ডলারের বিপরীতে। এখানেই সর্বনাশটা হচ্ছে। কারণ কী? আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। পান থেকে চুন পর্যন্ত আমাদের আমদানি করতে হয়। ডিম, ডাল, পেঁয়াজ, চাল, গম থেকে শুরু করে সবই আমদানি করতে হয়। এমনকি মাছ, মাংস, দুধ পর্যন্ত আমদানি করতে হয়। তাহলে কি আমাদের রপ্তানির কিছু নেই? আছে। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক আর আছে কিছু সামান্য পণ্য। এছাড়া রপ্তানি হচ্ছে জনশক্তি। কিন্তু এই রপ্তানি দ্বারা আমদানির খরচ মেটানো যাচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে নানা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা, চারদিকে অস্থিরতা আমাদের টাকার মান কমিয়ে দিচ্ছে। বহিরাগত এসব কারণেই আমাদের আজকের মূল্যস্ফীতি, যা আমাদের সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত করেছে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু এটাই কি একমাত্র কারণ? নিশ্চয় না। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলংকা-তাদের ক্ষেত্রেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এসব দেশে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাচ্ছে, আমাদের নয়। দেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি গত মাসেও ১২ শতাংশের উপরে ছিল। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। নড়াচড়া নেই। এ মাসে বন্যা হচ্ছে অনেক জায়গায়। উত্তরবঙ্গে সবজি উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে। শত শত মৎস্য খামারের মাছ বিনষ্ট হয়েছে। কয়েক দিন প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ পরিস্থিতি বাজারকে তুলে দিয়েছে তুঙ্গে। অতএব, খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা কম। কেবল এসবের জন্যই কি মূল্যস্ফীতি ঘটছে? মূল্যস্ফীতি অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রথমত রাজস্বনীতি, তারপর রয়েছে মুদ্রানীতি, যা মূল্যস্ফীতির নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করে। দৃশ্যত বোঝাই যাচ্ছে, সরকার রাজস্বনীতিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করছে না। এর মধ্যে পড়ে শুল্ক-কর, ভ্যাট ইত্যাদি। খুব কম ক্ষেত্রেই সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই ‘টুল’ ব্যবহার করছে। এদিকে রয়েছে ‘মুদ্রানীতি’। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মুদ্রানীতির দুর্বলতার জন্য মূল্যস্ফীতি ঘটছে না। তাদের মতে, বৈশ্বিক পণ্য বাজারে সরবরাহ ব্যাঘাতজনিত মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি পণ্যের মূল্য সমন্বয় মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে। এছাড়া রয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন, অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির মতো ঘটনা। সর্বশেষ কারণের মধ্যে বলা হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কথা।
বুঝলাম তারা দায়ী নয়, তাদের মুদ্রানীতি দায়ী নয়। দায়ী বৈশ্বিক অবস্থা, সরবরাহ সংকট এবং ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা। এরপর কি আর কোনো কথা থাকে? যে প্রতিষ্ঠান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত, সেই প্রতিষ্ঠান যদি বলে-আমরা নই, অন্যরা দায়ী-তাহলে আর কী বলার আছে।
বলার আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে একটা কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল আছে, যার প্রধান আমাদের হিসাববিজ্ঞান জানা অর্থমন্ত্রী। এর সদস্য হিসাবে আছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের সচিবরা। রয়েছেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, রয়েছেন অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। রাজস্বনীতি, বাণিজ্যনীতি, মুদ্রানীতি-এই তিনের সমন্বয় ঘটানোর জন্যই এ কাউন্সিল। তারা কী করছেন এ প্রশ্ন ওঠা তো খুবই স্বাভাবিক। যদি না তোলা হয় তাহলে তো মূল্যস্ফীতির জন্য কাউকে দায়ী না করে চুপ করে বসে থাকতে হয়। বলতে হয় রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দায়ী। ঠিক আছে, আলুর মূল্যস্ফীতির কারণ কী? ডিমের মূল্যস্ফীতির কারণ কী? কাগজে দেখলাম, ডিমের বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য দুটি ফার্মকে জরিমানা করা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, আলুর বাজারে কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা চড়াও হয়ে অতিরিক্ত ফায়দা তুলে নিয়েছে। ডিম, আলু বাদে রয়েছে ইলিশের বাজার, সবজির বাজার, মাছ-মাংসের বাজার, রয়েছে নানা ধরনের ভোগ্যপণ্যের বাজার যেমন-পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদি। এটা দিনের মতো পরিষ্কার যে, বাজার দখল করে নিয়েছে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেটকে দমনের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয়-এ কথা কেউ বলবেও না। কিন্তু এটা তো আমরা জানি যে, এসব বড় বড় ব্যবসায়ী যত না নিজেদের পুঁজিতে কাজ করে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ব্যাংকের পুঁজিতে। ‘ব্যাংক ঋণ’ নিয়ন্ত্রণ করেই তো তাদের একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন, উদাহরণ দিই। আলুর ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা এ মুহূর্তে বিশেষভাবে আলোচনায়। ৫০ টাকা আলুর দরের জন্য তারা দায়ী। তারা ব্যাংকের ঋণে ব্যবসা করছে। প্রচুর ‘ক্যাশ’ তারা এ কয়দিনে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে বলে স্বয়ং কৃষিমন্ত্রী বলেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, সরকার কিছু করতে পারেনি ভয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ অবস্থায় কেন, কী কারণে তাদের ঋণের পুনঃতফশিলকরণের অনুমতি দিল? যারা শত শত কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছে, তারা ক্যাশের অভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না- এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? শুধু আলুর ব্যবসায়ী নয়-এ কথা জানা, বহু বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি আছেন, যাদের ব্যাংকের ঋণের কোনো প্রয়োজনই নেই। তারা নিজেদের টাকাতেই ব্যবসা করতে পারেন। টাকার অভাব ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের, ‘এসএমই’ খাতের ব্যবসায়ীদের। তারা ঋণ পায় না। অথচ যাদের নিজস্ব অর্থ আছে, ফান্ড আছে-দেশে ও বিদেশে, তাদের সমানে ঋণ দিয়ে মোটা করা হচ্ছে। বর্তমান ডলার সংকটেও দেখা যাচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ‘হুন্ডি’ ব্যবসায় জড়িত থেকে টাকা কামাই করে নিচ্ছে দুই দিক থেকে। শোনা যায়, এদের কেউ কেউ বিদেশে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বেশি দামে ডলার কিনে নিচ্ছে। এদিকে আমদানি ঋণপত্র খুলতে গিয়ে ডলার না পেয়ে তারা ঋণপত্র খুলছে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ করে। অর্থাৎ বিদেশ থেকে যে পণ্য আসবে তার মূল্য দেখাচ্ছে কম। প্রশ্ন হলো, তাহলে প্রকৃত মূল্য রপ্তানিকারকরা কোত্থেকে পাবে? পাবে ওই হুণ্ডি ব্যবসায়। প্রকৃত মূল্য এবং এলসি মূল্যের ব্যবধানের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে হুন্ডিতে জমা করা ডলার দিয়ে। বিদেশে ডলার সংগ্রহ করে ওই ডলার দিয়ে রপ্তানিকারকদের বাকি পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে সরকারের রাজস্ব কম হচ্ছে; আর ডলার চলে যাচ্ছে হুন্ডিওয়ালাদের হাতে। ডলারের ব্যবসা হচ্ছে বিদেশে। এর ফলস্বরূপ দেশে ডলার আসছে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। দিন দিন রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। রিজার্ভ এখন বড় আলোচনার বিষয়। যেভাবে রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে সেটা হবে আমাদের জন্য খুবই খারাপ খবর। রিজার্ভ যতই কমছে, ততই ডলারের দাম টাকার বিপরীতে বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, অনেক বিদেশি ব্যাংক আমাদের ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র (এলসি) গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, আমরা ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে পারব না। এ কারণে আমাদের ব্যাংকগুলোকে বিদেশি ব্যাংকের ‘অ্যাড কনফারমেশন’ নিতে হচ্ছে। যার অর্থ বিদেশি আরেক ব্যাংক আমাদের পক্ষে এলসি ‘কনফার্ম’ করে পরিশোধের নিশ্চয়তা নিচ্ছে। এতে আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতেও মূল্যস্ফীতি উসকে যাচ্ছে। বিদেশি ঋণদাতারাও সন্দিহান হয়ে পড়ছে আমাদের পরিশোধ (রিপেমেন্ট) ক্ষমতা সম্পর্কে। এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ‘রেটিং এজেন্সিগুলো’। তারা আমাদের দেশের ঋণমান দিচ্ছে হ্রাস করে। এর অর্থ, বিনিয়োগকারীদের তারা সতর্ক করে দিচ্ছে আমাদের পরিশোধ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার বিষয়ে। এক সমস্যা আমাদের জন্য তৈরি করেছে শত শত সমস্যা। মূল ‘কালপ্রিট’ হচ্ছে রিজার্ভ, যা বাড়তে পারে তিনভাবে : রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি, বিদেশি ঋণ বর্ধিত পরিমাণে প্রাপ্তি।
রেমিট্যান্সে সুখবর নেই। ধারাবাহিকভাবে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমছে, হুন্ডিওয়ালাদের হাতে চলে যাচ্ছে ডলার। একমাত্র তৈরি পোশাক ছাড়া বাকি রপ্তানিযোগ্য পণ্যের রপ্তানি কোনোভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তৈরি পোশাকের রপ্তানিতে বড় সুখবর নেই। সুখবর নেই বিদেশি ঋণপ্রাপ্তিতেও। বিনিয়োগও আসছে না সেভাবে। এতসব সমস্যা সত্ত্বেও ভালো একটা খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ শতাংশ, যদিও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রক্ষেপণ কিছুটা কম। মন্দ কী?
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়