শতফুল ফুটতে দাও
একজন জননেত্রীর চিকিৎসা নিয়ে এত উদাসীনতা কেন?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট যখন আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার কথা বলছে, সে সময় খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি দেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তার হার্ট, কিডনি ও লিভারের মতো অঙ্গগুলো নানাবিধ জটিলতায় আক্রান্ত। তার হৃৎপিণ্ড ও পেটে পানি জমছে। অবাঞ্ছিত এবং জমে যাওয়া এই পানি বের করে ফেলতে হয়। তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া না গেলেও বুঝতে কষ্ট হয়নি, তিনি কতটা অসুস্থ। তার লিভারে সিরোসিস হয়ে গেছে। সিরোসিস হলে লিভার পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায় এবং লিভার জীবন রক্ষা করার স্পর্শকাতর ভূমিকাটি পালন করতে পারে না। লিভার সিরোসিস হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি ডায়াবেটিসজনিত কারণে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
প্রায় দুই মাস বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। লিভার সিরোসিসের কারণে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় মেডিকেল বোর্ড আবারও তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেয়। এর আগেও মেডিকেল বোর্ড কয়েকবার এ পরামর্শ দিয়েছে। এবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামিম ইস্কান্দার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন ২৫ সেপ্টেম্বর।
খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন নাকচ করে আইনমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আইনগত মতামত ১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এর ব্যাখ্যায় আইনমন্ত্রী সরকারের হাতে অনুমতি দেওয়ার সুযোগ না থাকায় বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার ব্যাপারে না বলে দিয়েছেন। এর ফলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ সিদ্ধান্ত নিয়ে হৃদয়হীনতার অভিযোগ তুলছেন। আইনমন্ত্রীর মতামতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীদের অনেকে। তারা মনে করেন, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেই খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে পারে। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এমন নজির আছে। তাছাড়া বুদ্ধিদীপ্তভাবে আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করলে ইস্যুটির একটা সমাধান বের হতে পারে।
আইনমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিকভাবে মতামত দেওয়ার আগেই গত কয়েকদিনে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি প্রশ্নে আইনগত জটিলতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। বিএনপি সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবির পাশাপাশি খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দাবি উত্থাপন করে কিছু কর্মসূচিও পালন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন সফরের সময় ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে এখন যে সাজা স্থগিত করে তাকে বাসায় থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আবার তাকে জেলে যেতে হবে, আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে তাকে অনুমতি নিতে হবে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর এমন অবস্থানের পর আইনমন্ত্রী কী মতামত দিতে পারেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা মামুলি কোনো বিষয় নয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ৭৮ বছর বয়সি সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে একাধিকবার করোনারি কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। মাঝেমধ্যেই তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বয়স্ক মানুষের জন্য শ্বাসকষ্ট একটি বিপজ্জনক শারীরিক উপসর্গ। সোমবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও চিকিৎসকের বরাতে জানানো হয়েছে, ডায়াবেটিসের উচ্চমাত্রাজনিত শারীরিক দুর্বলতার পাশাপাশি তার লিভার সিরোসিস গুরুতর হয়ে পড়েছে। এ রকম অসুস্থতার চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয় বলে চিকিৎসকরা বিদেশের কোনো আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন। এ অবস্থায় তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বশেষ দাখিল করা আবেদনটিও আইন মন্ত্রণালয়ে নাকচ হয়ে যাওয়ায় বয়োবৃদ্ধ এ রাজনীতিকের জীবন নিয়ে জনমনে গভীর শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তিন-তিনবার শপথগ্রহণকারী বাংলাদেশের এ সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রীর এভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে না পারা খুবই বেদনাদায়ক। পাকিস্তান আমলে আমাদের স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতারা বলতেন, যে আইন জনগণের কল্যাণ করে না, সে আইন জনগণের মানার বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না। তখন মৌলিক গণতন্ত্রনামীয় তথাকথিত যে গণতন্ত্র চালু হয়েছিল, তারই প্রতিবাদে রাজনৈতিক নেতারা এ কথাটি বলতেন। মানুষের জীবন আইনের চেয়েও মূল্যবান। যে আইন মানুষের জীবনকে যথাযথ মূল্য দেয় না, তাকে ভালো আইন বলা যায় কি? খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড নয়।
অস্বীকার করা যাবে না, খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় উচ্চ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যত কারাবন্দি। ২০২০ সালের মার্চে সরকারের নির্বাহী আদেশে তার সাজা স্থগিত হওয়ার পর শর্তসাপেক্ষে ৬ মাস করে তার মেয়াদ বৃদ্ধি হচ্ছে। সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসেও এটি অষ্টমবারের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের নেতারা এটাকে বিশেষ বিবেচনা বা বিশেষ সুবিধারূপে বর্ণনা করছেন। অপরদিকে দেশের জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, খালেদা জিয়া বঞ্চনার শিকার। অনেকেই মনে করেন, খালেদা জিয়া সুবিচার পাননি। অথবা এ বিচার সুবিচার বলে প্রতীয়মান হয়নি। এমনকি এদেশের জনগণের বিরাট একটি অংশ মনে করে ‘আইনের অধীনে’ এবং অতীতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বারবার সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ, এমনকি ‘ক্ষমা করিবার’ দৃষ্টান্ত আমলে লইয়া এই ক্ষেত্রে উদার হইলে কোনো ক্ষতি নাই। (সূত্র : সম্পাদকীয় সমকাল)।
যত রকম যুক্তিই থাকুক না কেন, খালেদা জিয়ার বয়স, শারীরিক অবস্থা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এবং গণতন্ত্রের জন্য তার অবদান বিবেচনায় নিলে, তাকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। এতে ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের বিশেষ ব্যক্তিদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, অনুজ্জ্বল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশবাসীর মনের কথা এটাই। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে অনেক অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করে পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার উদ্ভব ঘটলে তার সমাধান দুরূহ মনে হয়। পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে ফেলার জন্য কুশীলবদের অভাব হয় না। প্রশ্ন জাগে, এভাবে আর কতদিন? তীব্র প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণের অর্জনের ঝাঁপি খুব ক্ষুদ্র নয়। রাজনৈতিক বিরোধকে সংকটে পরিণত না করে সমাধানের পথে কীভাবে হাঁটা যায়, তা যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা একটু ভেবে দেখতেন, তাহলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। বিগত দিনগুলোয় অনেক বড় সাফল্য অর্জনের দাবিদার আমরা হতে পারতাম। গৌরবের দাবিদার হওয়ার মতো মন মানসিকতা না থাকলে জাতীয় জীবনে যে অপরিমেয় ক্ষতির সৃষ্টি হয়, তা উপলব্ধি করার মতো শক্তি ও সাহস কেন আমরা দেখাতে পারছি না। আমাদের মঙ্গল চায় না এমন কোনো শক্তি কি বিরামহীনভাবে আমাদের মধ্যে বিভেদের বীজ রোপণ করছে!
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ