Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

জাতীয় নির্বাচন ইস্যু যেন কোনো ট্র্যাজেডি ডেকে না আনে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় নির্বাচন ইস্যু যেন কোনো ট্র্যাজেডি ডেকে না আনে

দেশে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে নিয়ম রয়েছে, সে অনুযায়ী এ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩-এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা ২০২৪-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। একজন রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তি হিসাবে আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, দেশে কী হতে যাচ্ছে? নির্বাচনের প্রশ্নে দেশে যে বিশাল রাজনৈতিক বিভাজন বিদ্যমান, তার কি কোনো সুরাহা হবে?

অনেকে যারা বর্তমান সরকারের জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমার শিকার হয়ে কষ্ট ভোগ করেছেন, তারা জানতে চান এমন দুঃসময়ের অবসান হবে কি? প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এসব প্রশ্নের আমি কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে পারি না। ক্ষমতার অন্ধ মোহে নিমজ্জিত হয়ে যে রাজনীতি যুক্তিহীন হয়ে পড়েছে, তার প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের দেশটি যেন একটি হালভাঙা তরী, যেটি ভেসে চলেছে অজানা গন্তব্যে। হালভাঙা তরী নিয়ে যে কথা সহজে বলা যায়, তেমন কথা একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে বলা যায় না। একটি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে এর জনগণ।

জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হয়। দেশের দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের অনেক কিছু বিবেচনা করে দেশ চালাতে হয়। দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা মতের, নানা আদর্শের মানুষ থাকে। এ মানুষগুলো ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে একক কোনো ধর্মের অনুসারী হয় না। এমনকি তারা একই ভাষায় কথা বলে না। এ রকম বিচিত্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহমত গড়ে তুলতে হয়।

যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তাদের ঐক্য ও সংহতি নিশ্চিত করা যায় গণতন্ত্রের মাধ্যমে। গণতন্ত্র কোনো ত্রুটিমুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়। তা সত্ত্বেও আজকের দিনটি পর্যন্ত মানবজাতি যেসব রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, তার মধ্যে গণতন্ত্র সবচেয়ে আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাগুলোর মধ্যে অনন্য অবস্থানে রয়েছে গণতন্ত্র। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছরেও আমরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। সামরিক শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, ফ্যাসিস্ট শাসনসহ দুঃসহ শাসনের চাপে জনগণ চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছে। মানুষ ভোট দিতে চায়, কিন্তু ভোট দিতে পারে না। মাফিয়া চক্রের মতো যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে, তারা নানামুখী ছলাকলা করে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে। যে জনগণ শাসকগোষ্ঠীর শাসন বজায় রাখতে কর, খাজনা দিয়ে ব্যবস্থাটিকে চালু রাখে, তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই এই কৃতঘ্ন শাসকগোষ্ঠীর। যেভাবে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে পারে, তেমন নির্বাচনের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আগ্রহের পরিবর্তে নিজেদের মতকেই চাপিয়ে দিতে চাইছে।

বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শুধু দেশের মানুষই নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বও চাইছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলে দিয়েছে, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। পরে যখন দেখল এতে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না, তখন তারা প্রয়োগ শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সাম্প্রতিক এসব সিদ্ধান্ত একটা স্পষ্ট বার্তা। তারা মনে করছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে না।

আন্তর্জাতিক মহলের এ বার্তা আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা না নিয়ে উলটোপথে হাঁটছি। অর্থাৎ শরীরে রোগ আছে, সেটা স্বীকারই করছি না। ফলে চিকিৎসা নেওয়ার কোনো তাগিদ নেই। এ পরিস্থিতিতে সম্ভবত একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এমনটা হলে দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাবে। এর মাশুল পুরো জাতিকে দিতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনসংক্রান্ত বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যে দলীয়করণ রয়েছে, তা থেকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। অতীতেও তা হয়নি। আগামী নির্বাচনেও তা হবে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও অনেক সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা মনে করেনি যে, তাদের নাগরিকদের করের টাকা খরচ করে এমন একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন আছে। ফলে শক্ত বক্তব্য দিয়ে কোনো কিছু পরিবর্তন করা যাবে না। আস্থা তৈরির জন্য সত্যিকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কথাগুলো বলেছেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। (সূত্র : প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার ওপর গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে আসছেন। তার গবেষণা নিছক চেয়ার-টেবিলনির্ভর নয়। মাঠ পর্যায়ে একটি ভালো নির্বাচন কীভাবে হতে পারে, তার ওপর তিনি দেশব্যাপী বহু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেছেন। এসব সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যারা যোগ দিতেন, তারা তাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন এবং এখনো করছেন। তাই তিনি ভালো করে জানেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্ব শর্তগুলো কী কী? এবং নির্বাচনের ফলাফলে দুর্বৃত্তরা কত রকমের দুর্বৃত্তপনা করে থাকে। সাধারণ মানুষ আমাকে যেসব প্রশ্ন করেন, তার জবাব ড. বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্যে খুঁজে পাওয়া যায়। ড. বদিউল আলম মজুমদারের পাশাপাশি সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ভালো নির্বাচন হবে না, এমনটি ধারণা করছে আন্তর্জাতিক মহল। তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচন কমিশন এখন অসহায়। তাদের কিছু করণীয় নেই। তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমিশন সংবিধানের বাইরে যেতে পারবে না। কমিশনের একমাত্র উপায় হচ্ছে, একতরফা নির্বাচন করব না-এমনটি বলা। তবে নির্বাচনের জন্য কমিশন নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে যে কমিশনই নির্বাচন করবে তাদের জন্য তা ক্রেডিট হবে না, বরং ডিসক্রেডিট হবে। কিন্তু তারা বলতে পারে, তাদের কী করণীয় আছে। নৈতিকভাবে নির্বাচন কমিশনের করণীয় আছে। কিন্তু আইনগতভাবে করণীয় নেই। এটা আমরা বাইরে থেকে বলতে পারি। তবে যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের সীমাবদ্ধতাও আছে। আর সিদ্ধান্ত তো সরকারকে নিতে হবে।

ভালো নির্বাচন হবে না, এমন একটি ধারণা ইতোমধ্যে নিয়ে নিয়েছে আন্তর্জাতিক কমিউনিটি। নির্বাচন যেভাবে হওয়ার কথা, গত দুই নির্বাচন ওইভাবে ভালো হয়নি। এবার যে ভালো হবে, তার নিশ্চয়তা তো সরকার জনগণকে, রাজনৈতিক দলগুলোকে দিতে পারছে না। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। যদি সরকার এভাবে নির্বাচন করে ফেলে, তাহলে সেটা হবে আরেকটি একতরফা নির্বাচন। ইতোমধ্যে আমরা আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে পড়েছি। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানা তালিকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরপরও যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, যেখানে বহু দল এবং প্রধান বড় রাজনৈতিক শক্তি, যাদের সরকার গঠনের ক্ষমতা আছে, তারা অংশ না নেয়, তাহলে সে নির্বাচন স্বীকৃতি পাবে না। বরং অন্য রকমের কোনো নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এটা আমার ধারণা। (সূত্র : প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এবং বাস্তব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন, এমন দুজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির বক্তব্য আমরা উদ্ধৃত করেছি। দুজনের বক্তব্যের সুর প্রায় এক রকম। শুধু এই দুজন স্বনামধন্য ব্যক্তিই নন, দেশের অগণিত চিন্তাশীল মানুষ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে একই ধরনের ধারণা পোষণ করেন। নানা বাধা বিপত্তি সৃষ্টি করে এবং বিচিত্র ধরনের অপকৌশল অনুসরণ করে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে যে বাধার সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে, তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া থেকে বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে। মানুষের মধ্যে ভীষণ হতাশাবোধের সৃষ্টি হবে। এ ধরনের হতাশাবোধ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির জন্য বিশাল বাধা হিসাবে কাজ করবে। এ ধরনের বাধার মধ্যে পড়ে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের মধ্য বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করলে তার ফল হবে ভয়াবহ। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে বিশাল জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করা হলে কোনো এক সময়ে প্রতিশোধ হিসাবে তা ফিরে আসতে পারে। এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। আমাদের রাষ্ট্রের মালিক দেশের জনগণ। যেদিন দেশের জনগণের একটি বড় অংশ মালিকানাবোধ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্নবোধ করবে, সেদিন হবে বড় একটি ট্র্যাজেডির দিন। এমন ট্র্যাজেডি আসবে না বলে বিশ্বাস করতে চাই।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম