Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শ্রীলংকা পেরেছে, আমরা কেন পারছি না?

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শ্রীলংকা পেরেছে, আমরা কেন পারছি না?

প্রসঙ্গটা মূল্যস্ফীতি নিয়ে। মানবসমাজ সব সময়, সবকালে কোনো না কোনো সংকটের ভেতর দিয়ে এবং সংকট মোকাবিলা করে বিকশিত হয়েছে। আজকের যে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, তা প্রতিনিয়ত সংকট মোকাবিলা করে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে।

সমাজ থেকে সমাজে পরিবর্তিত হয়েছে তদারকি ও পরিচালন ব্যবস্থাপনা। একসময়কার দাসব্যবস্থার পরিবর্তিত উন্নত সমাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আজকের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন পরিবর্তিত হয়, তখন কেবল মানুষের ভাত-কাপড়ের প্রাপ্তির পরিবর্তন হয় না; হয় মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিরও।

একসময়কার সামন্ত রাজা প্রজাদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন, আজকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের প্রতি সরকারের সেরকম দৃষ্টিভঙ্গি অমূলক। একসময় রাজা অধিষ্ঠিত হতেন, আজকে (রাজা) প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে সেদেশের জনগণ। এবং সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় ১১ কোটি ভোটারের প্রত্যেকের রয়েছে সমান ক্ষমতা ও অধিকার। মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও ১ ভোট, আবার আমার মতো সাধারণ মানুষেরও ১ ভোট। সবার সম্মতির মূল্য ও গুরুত্ব সমান। এ কারণে আজকের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো কিছু লুকোছাপার প্রয়োজন নেই। সরকারি কর্মকাণ্ডের কোনো সফলতা থাকলে তার কৃতিত্ব সরকারকে দিতে হবে। পাশাপাশি ব্যর্থতার কোনো উদাহরণ থাকলে তার দায় সরকারকে নিতে হবে। কোনো ব্যর্থতাকে সফলতা বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আজকের আধুনিক সমাজে বেমানান।

আমরা প্রায়ই এ কথাগুলো ভুলে যাই। সাধারণ মানুষকে অসম তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে নিজের কৃতিত্বকে অক্ষুণ্ন রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন ফুরিয়ে গেছে। কেবল আমাদের উপলব্ধিতে আসতে সময় নিচ্ছে, এই যা। করোনা অতিমারি শেষ হতে না হতেই এ বছরের শুরুর দিকে বেধে গেল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বিশ্বের জ্বালানি ও পণ্যবাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দিল। সরবরাহ চেইনে সমস্যা দেখা দিল। স্বাভাকিভাবেই এর প্রভাব পণ্যমূল্যের ওপর গিয়ে পড়ল। হু হু করে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব পণ্যের দাম বাড়তে থাকল।

যে কোনো দেশের বেলাতেই দ্রব্যমূল্যের বেসামাল ঊর্ধ্বগতি সেদেশের জনগণের জন্য পীড়াদায়ক আর সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। এ সংকট সামাল দিতে বিভিন্ন দেশ নতুন করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও ঘোষণা করেছে। চেষ্টা করেছে সামগ্রিক চাহিদাকে সংকুচিত করতে; অর্থের সরবরাহ কমানোর জন্য নতুন করে সুদহার ধার্য করেছে। সব সরকারই মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে উৎকণ্ঠিত ছিল। আমাদের দেশেও বছরের দ্বিতীয় ছয় মাসের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা ওই মূল্যস্ফীতিকে সামনে রেখেই। বাস্তবে এ থেকে কতটা ফল পাওয়া যাবে তা সময়ই বলতে পারবে, তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। তবে দায়িত্বহীনতা এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা আমাদের আহত করেছে। সরকারি মহল থেকে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির মতো উন্নত দেশের উদাহরণ দিয়ে আমাদের বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তারা উৎসাহী কণ্ঠে বলতে কুণ্ঠিত হননি যে, ওইসব দেশে আমাদের থেকে বেশি মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, সে তুলনায় আমরা স্বর্গে আছি। আমি নিশ্চিত, স্বর্গের অবস্থা যদি সত্যি সত্যি এরকমই হয়, তাহলে অনেকেই স্বর্গলাভের মোহ ত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। তাহলে সরকারি মহল কি মিথ্যা কথা বলেছে? না, সত্য আড়াল করেছে। উল্লেখিত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতির কথাটি সঠিক বলেছে, কিন্তু আমাদের তুলনায় তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি আড়াল করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাথাপিছু আয় ৬৩ হাজার ৯৩৫ ডলার; যুক্তরাজ্যের ৪৭ হাজার ৩৭৪ ডলার, আর জার্মানির ৫১ হাজার ৩৮৩ ডলার। সেখানে একই সময়ে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় মাত্র ২ হাজার ৬৮৭ ডলার। আমাদের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাথাপিছু আয় প্রায় ২৪ গুণ বেশি। সেখানকার মূল্যস্ফীতি বার-ক্যাসিনোর চাহিদা কমাতে পারে, কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি পেটের পাকস্থলীকে চেপে ধরে। এ পার্থক্যটি আমাদের কাছে সচেতনভাবে গোপন করা হয়েছে। মানুষের দুর্গতি নিয়ে তামাশা করাটা সভ্য সমাজে অন্যায়।

সরকারি মহল উল্লেখিত উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থার তুলনা করে যে সুখের আমেজে রয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের রোল মডেলের বাংলাদেশের সঙ্গে সর্বজনস্বীকৃত দেউলিয়া শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতির অবস্থার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে চাই। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে। বছরের শুরুতে থাকা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বছর শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। দেশটিতে অর্থনীতি বলতে কিছুই ছিল না। দেশটি নিজেই নিজেকে দেউলিয়া রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। সবার নিরাশার ভেতরেও শ্রীলংকা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যায়। শ্রীলংকার এ মহাবিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণ বলে যা চিহ্নিত করা হয়েছিল তা হলো, ক্রমাগত রুপি ছাপিয়ে বাজারে তারল্য বাড়ানো। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর নন্দলাল বীরসিংহ এ সময়ে রুপি ছাপানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলংকা (সিবিএসএল) এখন আর অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের প্রবাহ কমিয়ে আনার জন্য সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এ সুদহার বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে বাজারভিত্তিক পদ্ধতি। ব্যাংকগুলোকে এ সময়ে ঋণ বাড়ানোর পরিবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দিষ্ট হারে তারল্য আমানত হিসাবে রাখতে হচ্ছে। আবার নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে ডলার ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পড়ে যাওয়া রুপির মান উন্নীত করা হয়। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা ছাড় করায় নগদ অর্থের পরিবর্তে ব্যবহার করছে বিনিময়যোগ্য অন্যান্য সম্পদ। যেভাবেই হোক, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যে শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সেই হার প্রায় ১০ গুণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬ দশমিক ৩ শতাংশে। যে সময়ে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ, একই সময়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএসএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার গত এক যুগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশে পৌঁছায়। দেউলিয়া শ্রীলংকা যা পেরেছে, তা রোল মডেলের বাংলাদেশ পারল না কেন এ প্রশ্ন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ কথা মানতেই হবে যে, প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অভিন্ন নয়। সমস্যাগুলোও একই ধরনের নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শ্রীলংকা তার জনগণকে স্বস্তি দিতে পেরেছে, যা আমরা পারিনি। এ সত্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে অস্থিতিশীল করেছিল সন্দেহ নেই। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে-এ সাধারণ সত্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা আমরা ধারণ করি। কিন্তু এর বিপরীতে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে তার ইতিবাচক প্রভাব দেশের বাজারে আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। তবে আমাদের পাওনা ওই প্রত্যাশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবতার মধ্যে নয়। আজ রাতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে কাল ভোরেই বাংলাদেশে তার দাম বেড়ে যায়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে দুমাসেও আমরা তার সুফল ভোগ করতে পারি না। এর পক্ষে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরতে পারি। জুন ২০২২-এ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১১২ দশমিক ৭ ডলার। এক বছর পর ২০২৩ সালে জুন মাসে সেই জ্বালানি তেলের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৯ ডলারে। এ কমতির হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। পাম অয়েলের দাম তো প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ২০২২-এর জুনে প্রতি টন পাম অয়েলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ছিল ১ হাজার ৬৩৪ ডলার। ২০২৩ সালের জুনে সেই পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি ৮১৭ ডলার। সয়াবিন তেলের দামও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এক বছর আগে সয়াবিনের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সেই তেলের দাম এখন টনপ্রতি ১ হাজার ৭ ডলার। দাম কমেছে ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের। গত বছর ডিএপি সারের বিশ্ববাজারে দাম ছিল টনপ্রতি ৮৬০ ডলার। সেই সারের দাম এখন ৪৫৫ ডলার। গমের দামও কমেছে। ২০২২ সালের জুনে প্রতি টন গমের দাম ছিল ৪৯২ ডলার। ২০২৩ সালের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫ ডলারে। তাই বলছিলাম, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব পণ্যের দাম বাড়ার সময় থাকে, কিন্তু কমার বেলায় থাকে না।

বাজার অর্থনীতির চিরায়ত যে নিয়ম তা হলো, জোগান ও চাহিদা দাম নির্ধারণে নির্ণায়ক ভূমিকায় থাকে। কিন্তু যদি জোগানে কোনো কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়, তাহলে কৃত্রিমভাবেই মূল্য নির্ধারিত হবে। সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। শ্রীলংকার বিপরীতে আমরা কেন মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না, এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেনের বক্তব্য দিয়েই শেষ করব। তিনি মনে করেন, ‘সারা বিশ্বে গত এক বছরে ধনী, মধ্যম আয় ও গরিবসহ সব দেশের মূল্যস্ফীতিই নিুমুখী। আমাদের এখানে কেন কমল না, এর উত্তর খুঁজতে হবে দুদিক থেকে। সেটি হলো, আমাদের এখানে চাহিদা ও জোগানের দিক থেকে কী হয়েছে? বিশ্বে সবাই চাহিদাকে সংকুচিত করেছে। সুদহার বৃদ্ধি করেছে। আমরা সেটা করিনি। আমরা সুদহার বৃদ্ধি করেছি ব্যাংকিং সিস্টেমের ভেতরে। এর ফলে ব্যাংকারদের টাকা নেওয়ার খরচ বেড়েছে, কিন্তু বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। কাজেই সুদহারের বৃদ্ধি আমাদের চাহিদা নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, টাকা ছাপিয়ে সরকারি কাজে অর্থায়ন করা হয়েছে, অর্থনীতিতে টাকার জোগান হয়েছে প্রচুর। ফলে চাহিদা সংকোচনের জায়গায় সম্প্রসারণ হয়েছে অনেক বেশি। এটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে।’

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম